প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করো

প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করো

অথবা, কীভাবে জ্যোতিষশাস্ত্রের সূত্রপাত হয়েছে

প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করো
প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করো

প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার উৎপত্তি

প্রাচীন কালে পৃথিবীর সর্বত্র গণিতচর্চার প্রধান অনুপ্রেরণা ছিল জ্যোতিষচর্চা। প্রথমে দিন ও রাত্রির পরিবর্তন এবং সূর্যের উদয় ও অস্তে যাত্রাকালের গতি সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে চন্দ্রকলার নিয়মিত হ্রাসবৃদ্ধির প্রতি মানুষের দৃষ্টি পড়ে। চন্দ্রের পর্যায়কাল নিরূপিত হওয়ার পর ঋতুপরিবর্তনের হিসাব রাখা সহজ হয়। এইভাবে মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের প্রাথমিক ধারণা জ্যোতিষচর্চার হাত ধরে গড়ে উঠতে থাকে।

(1) ব্যাবিলন : ব্যাবিলনীয়রা জ্যোতির্বিদ্যার আবির্ভাবের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। আনুমানিক ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ব্যাবিলনে জ্যোতির্বিদ্যার বিকাশ ঘটে। ব্যাবিলনীয়রা কৃষির উন্নতিতে কালের হিসাব রাখা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। এই সূত্র ধরেই রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা নিয়মিত গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান অনুযায়ী মাস, বছর ও ঋতুপরিবর্তন নির্ণয় করতে থাকেন। এগুলি পর্যবেক্ষণ করার জন্য জিগুরাত নামক কেন্দ্রও গড়ে তোলা হয়। এর পাশাপাশি ব্যাবিলনীয়রা প্রথম রাশিচক্রের ধারণা দেন। এ ছাড়াও তারা খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দেরও পূর্বে পঞ্জিকা ব্যবহার করতেন। এভাবেই প্রাথমিক জ্যোতির্বিদ্যার আবির্ভাব ঘটান ব্যাবিলনীয়রা। তাদের অপর উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল সপ্তাহ ও বার এবং সময় মাপার জন্য সূর্যঘড়ি, জলঘড়ি, বালিঘড়ি প্রভৃতি।

(2) গ্রিস : গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার ব্যাবিলন জয় করার পর জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রগতি ঘটে। আলেকজান্ডার নিজেও জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি গভীর আস্থাবান ছিলেন। গ্রিক- ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিদ্যার সমন্বয়ের দরুন জ্যোতিষশাস্ত্র আরও বিকশিত হয়। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে প্রাচীন গ্রিক গণিতবিদ ইউডোক্সাস (Eudoxus) প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহদের গতিবিধি ব্যাখ্যা করেন। জ্যোতিষশাস্ত্রের সঙ্গে রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা ও জীববিদ্যার মতো বিজ্ঞানের নানান শাখার সংযুক্তি ঘটে।

(3) মিশর: জ্যোতিষীয় গবেষণায় বিশেষত পর্যবেক্ষণ ও পঞ্জিকা রচনাতে মিশরের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ৩০০ অব্দের মধ্যে মিশরীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের বিকাশ ঘটে। মিশরীয় জ্যোতির্বিদগণ প্রথমদিকে চান্দ্রবৎসর এবং সৌরবৎসর গণনা করতেন। তাদের গণনা অনুযায়ী ৩৬৫ দিনে এক বছর, যার মধ্যে ৩০ দিনে এক মাস, ১২ মাসে এক বছর হত। এরপরেও অবশিষ্ট ৫ দিন দেবদেবীর পূজার্চনার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। মিশরীয়গণই প্রথম গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান অনুযায়ী শিশুর জন্মসময়ের নিরিখে কুষ্ঠি (Horoscope) তৈরি করে ভাগ্যগণনার রীতি চালু করেন। এ ছাড়াও তারা রাশিচক্রের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন।

(4) রোম: মনে করা হয়, রোমে জ্যোতিষশাস্ত্র প্রবেশ করে গ্রিক দাসদের মাধ্যমে। রোমানরা জ্যোতিষশাস্ত্রের বিকাশ ঘটায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের মধ্যে। সেখানকার রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকগণ ব্যক্তিগতভাবে নানা প্রয়োজনে জ্যোতিষীর কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতেন। পরবর্তীকালে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে ভাঙন দেখা দিলে জ্যোতিষচর্চাও হ্রাস পেতে থাকে।

(5) ভারতবর্ষ: ভারতের ক্ষেত্রেও কৃষিকাজে হিসাব রাখার জন্য মাস, বছর সংক্রান্ত ধারণার প্রয়োজন ছিল। এর পাশাপাশি যাগযজ্ঞাদির মতো নানা ধর্মানুষ্ঠানের সহায়ক হিসেবেও ভারতে জ্যোতিষচর্চা বিকশিত হয়।। ভারতে বৈদিক যুগে জ্যোতিষ একটি স্বতন্ত্র বিদ্যা হিসেবে পরিগণিত হত। প্রথম দিকে বৈদিক হিন্দুরা ৩০ দিনে এক মাস ও ১২ মাস বা ৩৬০ দিনে এক বছর ধরে পঞ্জিকা প্রণয়ন করতেন। আবার অনেকসময় ১৩ মাসেও বছর গণনা করা হত, যেখানে অতিরিক্ত ১ মাসকে মলমাস হিসেবে ধরা হত। এর পাশাপাশি ১২টি রাশিচক্রের ও ৭টি গ্রহ সম্পর্কেও জ্ঞান ছিল তাদের। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে আর্যভট্ট তাঁর আর্যভটীয় গ্রন্থে সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা তুলে ধরেন। এ ছাড়াও লাটদেব, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত প্রমুখ জ্যোতির্বিদদের চর্চায় গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান-সহ নানাবিধ বিষয় স্থান পেয়েছে। এইভাবেই ভারতে জ্যোতিষশাস্ত্র ধীরে ধীরে বিকশিত হয়।

(6) চিন: চিনে জ্যোতিষচর্চার সূত্রপাত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের কিছু আগে। সম্রাট হুয়াং তি সূর্য, চন্দ্র ও গ্রহদের পর্যবেক্ষণ করে পঞ্জিকা তৈরির জন্য মানমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে সম্রাট ইয়াও রাজজ্যোতিষীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ক্রান্তিবিন্দু ও অয়নবিন্দু নির্ভুলভাবে গণনা করার জন্য। পিটার ডোইগ (Peter Doig) লিখেছেন যে, এই সময় থেকে চিনে ৩৬৫ দিনে বৎসর গণনা আরম্ভ হয়েছিল। এর পাশাপাশি শোনা যায়, জনৈক একজন চিনা শাসক বারোটি রাশিচক্রের নামকরণ করেন। এ ছাড়া ধূমকেতু, নোভা (অতিথি তারা)-র উল্লেখও চৈনিক বিবরণ থেকে পাওয়া যায়।

(7) আরব: জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায় আরবদের অবদান ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রে খলিফা অল মনসুর সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। অল মনসুরের সভাসদদের মধ্যে বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ নাওবস্তু ও মাশাল্লাহ্ ইবন আথারি-র ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। নাওবখ্য একটি জ্যোতিষীয় তালিকা প্রস্তুত করেন, অপরদিকে মাশাল্লাহ্ রচনা করেন জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত কয়েকটি গ্রন্থ। আরবে ব্রহ্মগুপ্তের রচিত সিদ্ধান্ত আরবি ভাষায় অনূদিত হলে জ্যোতিষচর্চায় আরও বেশি আগ্রহ লক্ষ করা যায়। চন্দ্রের অবস্থান অনুযায়ী নানান ধর্মাচারের জন্য আরবদের জ্যোতিষচর্চা গুরুত্ব পায়। পরবর্তীতে নবম শতকে জ্যোতিষচর্চায় অগ্রগতি ঘটে জ্যোতির্বিদ অল বাত্তানির সহায়তায়। তিনি গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে নতুন এক জ্যোতিষীয় সারণি তৈরি করেন। এইভাবেই হাজার হাজার বছরের মানুষের কৌতূহল এবং মহাজাগতিক তথ্য সম্বন্ধে প্রশ্নের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে, নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হতে থাকে। ক্রমশ জ্যোতিষশাস্ত্র বা জ্যোতির্বিদ্যা বিকশিত হয় এবং এর উপর নির্ভর করেই আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার আবির্ভাব ঘটে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment