জ্যোতির্বিদ্যার বিকাশে টাইকো ব্রাহের ভূমিকা লেখো

জ্যোতির্বিদ্যার বিকাশে টাইকো ব্রাহের ভূমিকা লেখো

জ্যোতির্বিদ্যার বিকাশে টাইকো ব্রাহের ভূমিকা লেখো
জ্যোতির্বিদ্যার বিকাশে টাইকো ব্রাহের ভূমিকা লেখো

জ্যোতির্বিদ্যার বিকাশে টাইকো ব্রাহের ভূমিকা

ষোড়শ শতকের জ্যোতির্বিদ্যার জগতে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন টাইকো ব্রাহে (Tycho Brahe, ১৫৪৬-১৬০১ খ্রিস্টাব্দ)। আধুনিক পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতিষবিদ্যার উৎপত্তি মূলত তাঁর গবেষণা থেকেই। তিনি জ্যোতির্বিদ্যার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

(1) সংক্ষিপ্ত পরিচয়: ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের স্ক্যানিয়া (Scania) প্রদেশে এক অভিজাত পরিবারে জন্ম হয় টাইকো ব্রাহের। তিনি প্রথমে কোপেনহেগেন ও পরবর্তীকালে লাইপজিগ, উইটেনবার্গ, রসটক প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন। ছাত্র থাকাকালীন একবার নির্দিষ্ট সময়ে সংঘটিত সূর্যগ্রহণ লক্ষ করে তিনি জ্যোতিষচর্চাতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে এই ক্ষেত্রে ব্রাহে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও বিভিন্ন তথ্য আবিষ্কার করেন।

(2) উরানিবোর্গ প্রতিষ্ঠা: টাইকো ব্রাহে ডেনমার্কের সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিখের (Frederick II) সাহায্যে ভেন (Hven) দ্বীপে গড়ে তোলেন এক আধুনিক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ‘উরানিবোর্গ’ (Uraniborg)। এখানে নানান যন্ত্রপাতি বসিয়ে তিনি জ্যোতিষচর্চা করতে থাকেন। এ ছাড়া এই স্থানে মাটির নীচেও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি গবেষণাকেন্দ্র।

(3) টাইকো ব্রাহের পর্যবেক্ষণ: টাইকো ব্রাহে যখন জ্যোতিষচর্চা করছিলেন, তখনও পর্যন্ত দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু তিনি খালি চোখে দেখেই মহাবিশ্বের বিভিন্ন নক্ষত্র সম্পর্কে নিখুঁত পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হন।

  • নোভা-র আবিষ্কার: ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহে নতুন নক্ষত্র নোভা (Nova)-র অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ দ্বারা নোভার কৌণিক দূরত্ব, ঔজ্জ্বল্য ও বর্ণের পরিবর্তন সম্পর্কে অবহিত হন। তিনি গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়ে দেন যে, এই নতুন নক্ষত্রটি পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত নয়, তারকাক্ষেত্রের মধ্যেই অবস্থিত।
  • অ্যারিস্টটলের মতবাদকে অস্বীকার: ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহে রচনা করেন ডে নোভা স্টেলা (De Nova Stella) নামক গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে তিনি অ্যারিস্টটলের স্থির ও অপরিবর্তনীয় পৃথিবীর তত্ত্বকে এক ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে তুলে ধরার পাশাপাশি ‘নোভা’-র অস্তিত্ব সম্পর্কিত তথ্যও তুলে ধরেন।
  • ধূমকেতুর আবির্ভাব : ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহে ধূমকেতু সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে জানান যে, চন্দ্রলোকের বাইরে বহুদূরে মহাশূন্যে ধূমকেতুর আবির্ভাব ঘটে। ধূমকেতু সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের ফল De Mundi গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন তিনি।
  • ব্লুডলফাইন টেবিল: পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফের পৃষ্ঠপোষকতায় টাইকো ব্রাহে সূর্যের চারপাশে বিভিন্ন গ্রহের অবস্থান ও আবর্তন সম্পর্কে একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। এটি পরবর্তীকালে জোহানেস কেপলার কর্তৃক রুডলফাইন টেবিল (Rudolphine Tables) নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
  • বিশ্বব্রহ্মান্ডের গঠন সম্পর্কে ধারণা: টাইকো ব্রাহে তাঁর De mundi (De mundi Aetherei Recentioribus Phaenomenis Liber Secundus) গ্রন্থে ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কেও এক পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেন। টলেমিকে অনুসরণ করে তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রে রয়েছে পৃথিবী। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য প্রদক্ষিণ করছে। আবার সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি গ্রহগুলি। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যবেক্ষণ ছিল যে, মঙ্গল গ্রহের সূর্যকে প্রদক্ষিণের পথটি বৃত্তাকার নয় এবং সূর্যের নিকটবর্তী হলে তার গতি বৃদ্ধি পায়। ব্রাহের এই পরিকল্পনায় টলেমি ও কোপারনিকাসের মতামতের মধ্যে আপোস রক্ষার একটা প্রয়াস দেখা যায়। তিনি পৃথিবী সম্পর্কিত কোপারনিকাসের জ্যামিতিক সুবিধা এবং টলেমির দার্শনিক সুবিধার সমন্বয় ঘটানোর মধ্য দিয়ে যে নতুন বিশ্বজগতের কল্পনা করেন, তাকে বলা হয় টাইকোনীয় জগৎ।

(4) দ্বিতীয় বুডলফের সহায়তা: ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডরিখের মৃত্যু হয়। এরপর ডেনমার্কের পরবর্তী রাজা ও শাসকবর্গের সঙ্গে টাইকো ব্রাহের মতবিরোধ দেখা দিলে, তিনি রাজসভার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হন। ১৫৯৯ (মতান্তরে ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দ) খ্রিস্টাব্দে পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফ তাঁকে প্রাগ-এ আহ্বান করেন। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ব্রাহে প্রাগে যান ও সেখানে একটি মানমন্দির বা পর্যবেক্ষণাগার (Observatory) গড়ে তোলেন। এখানেই আমৃত্যু তিনি তাঁর কাজ চালিয়ে যান।

(5) কেপলারের সান্নিধ্যলাভ: শেষজীবনে তাঁর কাজের ক্ষেত্রে সহযোগী ছিলেন জোহানেস কেপলার। মৃত্যুশয্যায় থাকার সময় ব্রাহে তাঁর যাবতীয় পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যসমূহ তুলে দেন কেপলারের হাতে। ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে এই প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রয়াত হন।

মূল্যায়ন

সবশেষে বলা যায়, টাইকো ব্রাহের ভূকেন্দ্রিক ব্রহ্মান্ডের ধারণা পরবর্তীকালে ভ্রান্ত বলেই প্রমাণিত হয়েছে। তবে তাঁর মতবাদে মৌলিকত্ব না থাকলেও সূর্যকে কেন্দ্র করে যে গ্রহগুলি আবর্তিত হচ্ছে, সেই সত্য উঠে এসেছিল ব্রাহের বক্তব্যে যা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয়। তাছাড়া ব্রাহের সহকারী জোহানেস কেপলার, তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বিশ্বব্র্যান্ডের গঠন সম্পর্কিত ধারণা আরও স্পষ্টভাবে প্রদান করতে সক্ষম হন।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment