কোপারনিকাস থেকে নিউটনের কালপর্বে পৃথিবীর অবস্থানের ধারণা কীভাবে গড়ে উঠেছিল
অথবা, পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাকাশ জগৎ থেকে সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বে উত্তরণের ইতিহাস বর্ণনা করো
অথবা, আধুনিক জ্যোতির্বিদদের সৌরজগতের গঠন সম্পর্কিত মতবাদ সংক্ষেপে আলোচনা করো
অথবা, সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বব্রহ্লান্ডের ধারণাটি বিশ্লেষণ করো

প্রাচীন কাল থেকে মানুষ মূলত পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাকাশ জগতের তত্ত্বেই বিশ্বাসী ছিলেন, যদিও তা বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। কিন্তু পঞ্চদশ শতকে পর্যবেক্ষণ বা নিরীক্ষামূলক বিজ্ঞানচর্চা গুরুত্ব পায়। গাণিতিক সূত্রের মাধ্যমে প্রকৃতিকে অনুধাবন করার কাজ শুরু হলে মহাবিশ্বের ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে। নতুন তত্ত্বে প্রমাণ করা হয় যে, ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে পৃথিবীর অবস্থান নয়, সূর্যকে কেন্দ্র করেই মূলত গ্রহমণ্ডলী আবর্তিত হচ্ছে। এই ধারণাকে পরবর্তীতে কোপারনিকাস থেকে শুরু করে নিউটন প্রমুখ জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি দান করেন।
কোপারনিকাস থেকে নিউটনের কালপর্বে পৃথিবীর অবস্থানের ধারণা / সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণার বিকাশ
সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণাটি একদিনে গড়ে ওঠেনি। প্রচলিত পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের বদ্ধমূল ধারণাকে পরিবর্তিত করার ক্ষেত্রে আধুনিক জ্যোতির্বিদদের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট।
(1) মহাবিশ্ব সম্পর্কে আদি ধারণা: অ্যারিস্টটল, টলেমি-র গবেষণাকাল পর্যন্ত অধিকাংশ জ্যোতির্বিদ ভূকেন্দ্রিক ব্রহ্মান্ডের তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। এঁরা মনে করতেন যে, ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রে পৃথিবীর অবস্থান এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে গ্রহমণ্ডলী অবস্থান ও পরিক্রমা করে। সেসময় খ্রিস্টান চার্চও এই ধারণাকেই সমর্থন করেছিল। পঞ্চদশ শতকের আগে পর্যন্ত সমগ্র ইউরোপীয় সমাজে ভূকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের ধারণাই বদ্ধমূল ছিল।
(2) কোপারনিকাসের ভূমিকা: পোল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপারনিকাস পর্যবেক্ষণ ও গাণিতিক বিচার দ্বারা প্রচলিত টলেমির তত্ত্বের বিপরীতে নতুন এক তত্ত্বের প্রচলন করেন। তাঁর মতে, ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রে পৃথিবী নয়, সূর্যের অবস্থান। এই সূর্যকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন গ্রহ আবর্তিত হচ্ছে। যদিও কোপারনিকাসের পূর্বে গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টারকাস সূর্যকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ড পরিকল্পনার আভাস দেন, কিন্তু তিনি তা প্রমাণ করতে পারেননি। কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ড পরিকল্পনার তত্ত্ব জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। তিনি তাঁর মহাকাশ বিষয়ক তত্ত্ব ডে রেভলিউশনিবাস গ্রন্থটিতে প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর কোপারনিকাসের তত্ত্ব সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করানো সহজসাধ্য ছিল না। কিন্তু তাঁর এই মহাসত্য পরবর্তী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তাঁর মতবাদকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল বিশ্বব্রহ্মান্ডের গঠন সংক্রান্ত আধুনিক ধারণাটি, যা কোপারনিকাসের বিপ্লব নামে পরিচিত।
(3) জিওরদানো বুনোর ভূমিকা: কোপারনিকাসের মৃত্যুর পর তাঁর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠন সংক্রান্ত তত্ত্বকে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলেন ইটালির বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ জিওরদানো ব্রুনো। তিনি ডে ল’ ইনফিনিটো ইউনিভার্সো এ মোন্ডি (De L’infinito Universo E Mondi) বা ‘অনন্ত মহাবিশ্ব ও বহুবিশ্ব নিয়ে’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থান করে না। সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত। এর পাশাপাশি তিনি বলেন, মহাবিশ্বের সংখ্যা অসীম এবং সৌরজগতের মতোই অসংখ্য জগতের সমন্বয়ে গঠিত।
(4) টাইকো বাছের ভূমিকা: ষোড়শ শতকে ডেনমার্কের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে তাঁর De mundi গ্রন্থে ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে এক পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেন। তিনি টলেমিকে অনুসরণ করে ধারণা প্রদান করেছিলেন, ব্র্যান্ডের কেন্দ্রে পৃথিবী অবস্থিত। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য প্রদক্ষিণ করছে। আবার সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতির মতো গ্রহগুলি।
(5) কেপলারের ভূমিকা: প্রখ্যাত জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও টাইকো ব্রাহের সহকারী ছিলেন জোহানেস কেপলার। তিনি ছাত্রাবস্থা থেকে কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক ব্রহ্মান্ডের পরিকল্পনাকে সমর্থন করতেন। কেপলার গ্রহনক্ষত্র সংক্রান্ত প্রশ্নের সমাধানের জন্য তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন। তার মধ্যে প্রথম সূত্রেই তিনি ব্যাখ্যা করেন সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহরা উপবৃত্তাকার পথে পরিক্রমা করে। কেপলার যুক্তিসহকারে সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বব্র্যান্ডের ধারণা দেন। তাঁর হাত ধরেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় এক { অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে।
(6) গ্যালিলিও-র ভূমিকা: ইটালির প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক ছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। তিনি ছিলেন কোপারনিকাসের মতবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক। নিজ আবিষ্কৃত দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে গ্যালিলিও মহাকাশ সম্পর্কে বহু তথ্য তুলে ধরেন। এই যন্ত্রের সাহায্যেই প্রমাণ করেন যে, সূর্য ব্র্যান্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং পৃথিবী-সহ অন্যান্য গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। তাঁর গ্রন্থ Dialogue-এ কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধারণাকে সমর্থন করা হলে, চার্চ তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হয়। তাই গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্যালিলিও ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত হন। তাঁকে দিয়ে বলপূর্বক স্বীকার করানো হয় যে তিনি যা বলেছেন তা সবই মিথ্যা। নানাভাবে গ্যালিলিও-কে দমন করার চেষ্টা করা হলেও তাঁর মতবাদের সম্প্রসারণকে আটকে রাখা সম্ভবপর হয়নি।
(7) নিউটনের ভূমিকা: নবজাগরণ-প্রসূত আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। তিনি পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিবর্তন এনেছিলেন। কোপারনিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও-র মতো তিনিও সূর্যকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের ধারণাকে তাঁর গবেষণার অন্যতম সূত্র বলে বিবেচিত করেন। তিনি সূর্যকে কেন্দ্র করে কীভাবে গ্রহ আবর্তিত হয় এবং চাঁদ কীভাবে পৃথিবীকে পরিক্রমণ করে-এইসব প্রশ্নের সন্ধানে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন। এই সূত্রের উপর নির্ভর করে বৈজ্ঞানিকভাবে নিউটন প্রমাণ করেন, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী-সহ অন্যান্য গ্রহগুলি সূর্যের চারদিকে আবর্তিত হয়। সবশেষে বলা যায়, কোপারনিকাস যে সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা গড়ে তুলেছিলেন তা ধীরে ধীরে ব্রুনো, কেপলার, গ্যালিলিও প্রমুখ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অবদানে উন্নত রূপ লাভ করে। পরবর্তীতে নিউটনের গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়বস্তু কোপারনিকাসের আমল থেকে চলে আসা সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণাকে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরে। তাঁর হাত ধরেই সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর