কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বব্রহ্মান্ডের ধারণাটি ব্যাখ্যা করো
অথবা, জ্যোতির্বিদ্যা/ জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিকাশে কোপারনিকাসের ভূমিকা আলোচনা করো

সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বব্র্যান্ডের মতবাদের প্রথম আধুনিক প্রবক্তা ছিলেন পোল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপারনিকাস (Nicolaus Copernicus, ১৪৭৩-১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক হিসেবেও সমাদৃত হন।
কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধারণা / জ্যোতির্বিদ্যার বিকাশে ভূমিকা :
(1) সংক্ষিপ্ত পরিচয়: কোপারনিকাস পোল্যান্ডের তোরান (Torun) বা থর্ন (Thorn) নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮ বছর বয়সে ব্র্যাকো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি সেসময়কার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও দার্শনিক অ্যালবার্ট বুজেস্কি (Albert Brudzewski)-এর সংস্পর্শে আসেন ও জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন।
পরবর্তীকালে জ্যোতিষশাস্ত্রের পাশাপাশি আইন ও চিকিৎসাবিদ্যাতেও তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেন। ইটালির বোলোনা, পাদুয়া, ফেররারার মতো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ শেষ করে তিনি ফ্রয়েনবার্গ গির্জায় ক্যাসন পদে যোগ দেন। আমৃত্যু তিনি এই পদে আসীন ছিলেন। ফ্রয়েনবার্গ এলাকার একপাশে টিউটনিক নাইট সম্প্রদায় ও অন্যদিকে পোল্যান্ডের রাজার বিতর্কিত অঞ্চলের অবস্থান ছিল। তাই প্রশাসন ও যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে কোপারনিকাসকে সর্বদাই ব্যস্ত থাকতে হত। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞান তাঁর মূল আকর্ষণের বিষয় হওয়ায়, যাজকবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে তিনি মহাকাশ ও গ্রহনক্ষত্র বিষয়েও পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যান।
(2) টলেমির ধারণার বিরোধিতা: কোপারনিকাস জ্যোতিষ্ক সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণ ও গাণিতিক বিচারবিশ্লেষণ করে নতুন তত্ত্বের প্রবর্তন করেন, যা ছিল টলেমির ধারণার বিপরীত। তাঁর মতে, ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রে পৃথিবী নয় সূর্যের অবস্থান এবং বিভিন্ন গ্রহ এই সূর্যকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। পৃথিবী গতিশীল হওয়ায় দূরের গ্রহগুলিকে চলমান মনে হয়। বস্তুতপক্ষে কোপারনিকাস জ্যোতির্বিজ্ঞানকে নতুন রূপে প্রবর্তন করেন।
(3) সূর্যকেন্দ্রিক ব্রহ্মান্ডের পরিকল্পনা:
- সূর্য পরিক্রমণকাল: কোপারনিকাসের ব্রহ্মান্ড পরিকল্পনা অনুসারে সূর্যকে কেন্দ্রে স্থাপন করলে, সবথেকে দূরে এবং সবার উপরে আছে স্থির নক্ষত্র গোলক। গতিশীল বস্তুদের মধ্যে প্রথমে আসে শনি। এটি ত্রিশ বছরে একবার কক্ষ পরিক্রমা সম্পূর্ণ করে। তারপর আছে বৃহস্পতি, যা বারো বছরে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ সম্পূর্ণ করে। এরপর মঙ্গলের স্থান, যে দুবছরে একবার সূর্য পরিক্রমা সম্পূর্ণ করে। তারও পরে পৃথিবীর অবস্থান। পৃথিবী বছরে একবার সূর্যকে পরিক্রমা সম্পূর্ণ করে। পৃথিবীর সঙ্গেই আবর্তিত হয় চন্দ্রের পরিবৃত্ত। পঞ্চম স্থানে আছে শুক্র, যে নয় মাসে প্রদক্ষিণ সম্পূর্ণ করে। তারপর বুধের অবস্থান। এর সূর্য পরিক্রমার সময়কাল আশি দিন।
- পরিক্রমণ সংক্রান্ত তথ্য: কোপারনিকাসের মতে, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলি নির্দিষ্ট বৃত্তাকার কক্ষপথে পরিক্রমা করছে। বুধ ও শুক্র গ্রহ শুধু সকাল ও সন্ধ্যায় দেখা যায় কেন, বা রাতের যে-কোনো সময়ে মঙ্গল, শনি বা বৃহস্পতি গ্রহকে কেন দেখতে পাওয়া যায়- এরূপ প্রশ্নের উত্তরে টলেমি বলেছিলেন যে, সূর্যের বার্ষিক গতির পুরো সময় জুড়ে সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে বুধ এবং শুক্র, পৃথিবীর চারপাশে ঘূর্ণন করে। কিন্তু কোপারনিকাস দেখান যে, বুধ-শুক্রের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথের তুলনায় ছোটো, কিন্তু অন্য গ্রহের কক্ষপথ পৃথিবীর তুলনায় বড়ো। তাছাড়া, বুধ, শুক্র পৃথিবীর তুলনায় সূর্যের কাছে এবং অন্যান্য গ্রহগুলি পৃথিবীর তুলনায় সূর্যের থেকে দূরে অবস্থিত। কাজেই দূরত্বের তফাতের জন্যই গ্রহগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দেখা যায়।
(4) কোপারনিকাসের দ্বিধাগ্রস্ততা: কোপারনিকাসের মহাকাশ তত্ত্বকে বিজ্ঞান বিপ্লবের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বৃত্তিগতভাবে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল ধর্মযাজক। টমাস কুনের মতে, খ্রিস্ট ধর্মের অনুষ্ঠানগুলির দিনক্ষণ সম্পর্কে মতভেদ দূর করাই ছিল কোপারনিকাসের লক্ষ্য। গ্রহনক্ষত্রের সঠিক অবস্থান বিচার করে পঞ্জিকা লেখার জন্য তিনি মহাকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করেছিলেন। তাঁর মতবাদের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি হয়। ঘটনাচক্রে তিনি ব্রহ্মান্ডের যে চরিত্র আবিষ্কার করেন, অর্থাৎ সৌরকেন্দ্রিক আবর্তন, তা প্রচলিত জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং খ্রিস্ট ধর্মের বিশ্বাসের পরিপন্থী ছিল। তাই মহাসত্য আবিষ্কারের পরেও তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত প্রকাশ করতে চাননি। শেষপর্যন্ত বন্ধুদের উদ্যোগে কোপারনিকাসের তত্ত্ব সংবলিত পুস্তক ডে রেভলিউশনিবাস যখন প্রকাশিত হয়, তখন তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত।
(5) গ্রন্থ রচনা: কোপারনিকাসের মহাকাশ তত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থের নাম ডে রেভলিউশনিবাস (পুরো নাম Nicolai Copernici to Rinensis De Revolutionibus Orbium Coelestium, Libri VI)। কোপারনিকাস প্রথমে বন্ধুমহলের অনুরোধে তাঁর আবিষ্কারের সংক্ষিপ্তসার কমেন্টারিওলাস (Commentariolus) নামে প্রকাশ করেন (১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ)। পরবর্তীকালে উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ জোয়াকিম ডে পরিস (Georg Joachim de Porris, রেটিকাস নামে প্রসিদ্ধ) মূলগ্রন্থ প্রকাশে কোপারনিকাসের সম্মতি লাভ করেন। নানা বিপত্তির পর ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে ছয়টি খন্ড সংবলিত De Revolutionibus গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
(6) কোপারনিকান বিপ্লব: পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক ছিল ইউরোপে নবজাগরণের যুগ। এসময় শিল্প-সাহিত্যের মতো বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও যুক্তি ও মানবতাবাদকে কেন্দ্র করে, মধ্যযুগীয় কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বেড়াজাল ছিন্ন করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এরই এক অন্যতম উদাহরণ হল- কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বব্র্যান্ডের ধারণাটি। এই ধারণা সমকালীন সময়ের তুলনায় এতটাই এগিয়ে ছিল, যে তা মানুষকে বিশ্বাস করানো ছিল কঠিন। তাঁর এই মতবাদকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে কোপারনিকাসের বিপ্লব (Copernican Revolution) দেখা দেয়।
মূল্যায়ন
ষোড়শ শতকের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় কোপারনিকাসের তত্ত্ব বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে। ব্যক্তিগতভাবে যাজক হওয়ার কারণে নিজের বিশ্বাস ও আবিষ্কার প্রকাশ করতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ততা দেখান। এজন্য তাঁকে অবশ্য দোষী করা যায় না। দোষ সমাজব্যবস্থার, দোষ যাজকতন্ত্রের। কিন্তু যা সত্য, তার আবিষ্কারের কাজে কোপারনিকাস ছিলেন আন্তরিক। তিনিই ছিলেন সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের আধুনিক ধারণার পথপ্রদর্শক। কোপারনিকাসের বৈপ্লবিক তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে জ্যোতির্বিজ্ঞান আধুনিক পদার্থবিদ্যার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর