কৃষি বিপ্লব বলতে কী বোঝো? ষোড়শ শতকের ইউরোপে কৃষি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে লেখো

কৃষি বিপ্লব
পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে ম্যানর ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়লে কৃষিকাঠামোয় বেশকিছু পরিবর্তন ঘটে। গতানুগতিক কৃষি পদ্ধতির বদলে এই সময় নতুন পদ্ধতি ও নতুন উপকরণ যুক্ত হলে কৃষি উৎপাদন বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। ষোড়শ শতকের সূচনাকাল থেকে ইউরোপের কৃষিকাঠামোতে সংঘটিত এই পরিবর্তনসমূহ এতটাই নতুন, ব্যাপক ও মৌলিক ছিল যে, তার ভিত্তিতে কেউ কেউ একে কৃষি বিপ্লব (Agricultural Revolution) বলে অভিহিত করেছেন।
কৃষি বিপ্লবের পটভূমি বা কারণসমূহ
কৃষি বিপ্লবের পশ্চাৎপটে বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কৃষি বিপ্লবের কারণগুলি হল
(1) জনসংখ্যা বৃদ্ধি: ষোড়শ শতকের ইউরোপে সেভাবে কোনও যুদ্ধবিগ্রহ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় না থাকায়, জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খাদ্যশস্যের চাহিদা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনই উদ্বৃত্ত চাহিদা মেটাতে নতুন নতুন জমিকে চাষযোগ্য করা হতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে কৃষি বিপ্লব ঘটে।
(2) কৃষি প্রযুক্তির উন্নতি: ইউরোপে কৃষিপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কৃষিজ উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টি হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণেই কৃষিক্ষেত্রগুলিতে চলে নব নব প্রযুক্তি ও যান্ত্রিক কলাকৌশল ব্যবহারের প্রয়াস। এই সময় থেকেই কৃষি যন্ত্রপাতির প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটে। ভারী লোহার ফলাযুক্ত লাঙল, কাঠের মই, ঘোড়ায় টানা শস্যবপনের যন্ত্র, উন্নত দাঁড়াবিশিষ্ট কাস্তে ইত্যাদি যন্ত্রের ব্যবহারে কৃষিকাজ ও উৎপাদন হয়ে ওঠে সহজতর।
(3) কৃষিজমির সম্প্রসারণ: ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কৃষিজমির প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিজমি উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া সমুদ্রের উপকূলবর্তী দেশগুলি উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমুদ্রের উপকূলে বাঁধ দিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার শুরু করে।
(4) নিবিড় চাষ ও আবর্তন পদ্ধতি: ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপীয় কৃষিজমিতে নিবিড় চাষ শুরু হয়। এই সময় জমিতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। জমিতে বারবার একই ফসল চাষ না করে পর্যায়ক্রমিক (Rotation) প্রথায় বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্নশস্যের চাষ শুরু হয়। নিবিড় প্রথায় চাষের ফলে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।
(5) মূল্য বিপ্লব: ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের মূল্য বিপ্লব (Price Revolution) কৃষিকাজে অগ্রগতির আর একটি বড়ো কারণ। আলোচ্য পর্বে খাদ্যশস্যের মূল্য প্রায় ৫.৫ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় বাল্টিক অঞ্চল ও ইংল্যান্ডের কৃষিকাজের চরম উন্নতি ঘটে। কৃষিতে বাণিজ্যিকীকরণ এবং পুঁজিনির্ভর কৃষি উৎপাদনের সূচনা হয়।
(6) কৃষির বাজারিকরণ: ষোড়শ শতকে কৃষি ও বাণিজ্যের মেলবন্ধন ঘটলে কৃষির বাজারিকরণ (Marketization of Agriculture) ঘটে। নতুন সমুদ্রপথ আবিষ্কারের ফলে এই সময় থেকে কৃষিজাত পণ্য বিদেশে রফতানি করা হলে কৃষি একটি লাভজনক বৃত্তিতে পরিণত হয়।
(7) পুঁজিনির্ভর কৃষিব্যবস্থা: ধীরে ধীরে ইউরোপীয় কৃষিকাঠামো গ্রামীণ অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যগুলি পরিহার করে পুঁজিনির্ভর কৃষিব্যবস্থায় পরিণত হয়। এই ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল মুনাফা অর্জন, যা পূরণ করতে গিয়ে বাজারের চাহিদার সঙ্গে ভারসাম্য রেখে পণ্য উৎপাদন শুরু হয়। কৃষিতে পুঁজি ও মজুর নিয়োগ হতে থাকে। ভূস্বামী ও বুর্জোয়া শ্রেণিও যুক্ত হয়ে পড়েন কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে।
(8) অন্যান্য কারণ: উপরোক্ত কারণগুলি ছাড়াও সমকালীন সময়ে জলসেচ ব্যবস্থার উন্নতি, বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন, শ্রমশক্তির চরিত্রগত পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে কৃষি বিপ্লব ঘটে।
ইউরোপে কৃষি বিপ্লবের ফলাফল
ইউরোপে কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক রূপান্তরের ফলাফলগুলি হল-
(1) আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি: কৃষি বিপ্লবে আবাদী জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং কৃষিজাত দ্রব্য নিয়ে ব্যাবসাবাণিজ্যও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এই সময় বহু অনাবাদী জমিকে পরিষ্কার করে আবাদী জমিতে পরিণত করা হয়। এমনকি জলা, পতিত ও পাহাড়ী অঞ্চলের জমি উদ্ধার করে চাষযোগ্য করার প্রয়াস চলতে থাকে।
(2) নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব: কৃষি বিপ্লবের প্রভাবে মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণিবিন্যাসের রদবদল ঘটে। নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। এই সময়ে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলে ইওমেন (Yeomen), ফ্রান্সে কোক দ্য ভিলাজ (Coqs de Village), জার্মানিতে ফলবয়ার বা ভলবয়ার (Volbauer)-রা উচ্চবর্গের মানুষ (Elite) হয়ে ওঠেন।
(3) জমির গুরুত্ব বৃদ্ধি: কৃষিতে বিপ্লবের দরুন জমির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। অবস্থাপন্ন ভূস্বামীরা জমি অধিগ্রহণে ভীষণভাবে তৎপর হয়ে ওঠেন। অতিরিক্ত লাভের আশায় শহুরে বুর্জোয়া শ্রেণিও জমিতে অর্থ বিনিয়োগ করতে থাকেন।
(4) কৃষকদের দুর্দশা: তবে এই সকল পরিবর্তন সাধারণত দরিদ্র কৃষকদের কাছে সুখকর হয়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, বর্ধিত করের বোঝা তাদের অবস্থা করে তোলে দুর্বিষহ। এই সময় ভূমিদাসেরাও জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন।
(5) নগরের জীবনযাত্রার মানের অবনমন: কৃষি বিপ্লবের ফলে বহু কৃষক ও ভূমিদাস জমি হারিয়ে শহরে চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে তারা শিল্পকারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। ফলে শহর বা নগরগুলিতে জনসংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনই শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এর সঙ্গে শহুরে জীবনযাত্রার মানেরও অবনমন ঘটে।
মূল্যায়ন
পরিশেষে বলা যায় যে, ষোড়শ শতকে কৃষি বিপ্লবের ফলে ইউরোপে কৃষির আধুনিকীকরণ এবং নগরকেন্দ্রিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটে। অন্যদিকে কৃষিজাত উৎপাদনসমূহ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কৃষি থেকে উদ্ভূত শ্রমশক্তি যুক্ত হয় শহরের কলকারখানাগুলিতে। এসবের প্রভাবেই প্রশস্ত হয়ে ওঠে শিল্পবিপ্লবের উত্থানের পথ।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর