কৃষি প্রযুক্তির অগ্রগতি সম্পর্কে যা জানো লেখো
অথবা, কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি ব্যাখ্যা করো
অথবা, পঞ্চদশ শতক ও তার পরবর্তীকালে ইউরোপে কৃষি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটেছিল অথবা, ইউরোপে নতুন নতুন কৃষি উপকরণ ও কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে লেখো

কৃষি প্রযুক্তির অগ্রগতি
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি প্রকাশের অন্যতম একটি ক্ষেত্র হল কৃষি। লোহার আবিষ্কার কৃষি প্রযুক্তিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। মধ্যযুগের শেষের দিকে কৃষির উন্নয়নকল্পে কৃষি প্রযুক্তির মান বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেওয়া হতে থাকে। একাদশ শতক থেকে ইউরোপে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানের জন্য নজর দেওয়া হয় কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে। চলে নব নব প্রযুক্তি সংযোজনের প্রয়াস।*1 পঞ্চদশ শতক থেকে শুরু করে তার পরবর্তী কয়েক শতকে ইউরোপের কৃষিক্ষেত্রে যেসকল প্রযুক্তি ও যান্ত্রিক কলাকৌশল ব্যবহৃত হয়, তার ভিত্তিতেই কৃষিব্যবস্থায় এক বিপ্লব সাধিত হয়।
(1) উন্নত কৃষি উপকরণ: পঞ্চদশ শতক থেকে নব নব প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষির উপকরণগুলিকে উন্নততর করে তোলে। বস্তুত জমিতে লাঙল দেওয়া, বীজ বপন, ফসল কাটা, ফসল মাড়াই ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই উন্নত প্রযুক্তি তথা কৃষি যন্ত্রপাতি জায়গা করে নিতে থাকে। যথা-
- লাঙল ও কাঠের মই-এর ব্যবহার: কৃষি প্রযুক্তির দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ছিল- ভারী লোহার ফলাযুক্ত লাঙল ও কাঠের মই-এর ব্যবহার। পঞ্চদশ শতকের আগে থেকেই ভারী ও শক্ত লোহার ফলা বা লাঙল দিয়ে জমি চাষ করা শুরু হয়েছিল। লৌহ লাঙল ব্যবহারের ফলে মাটির গভীর পর্যন্ত কর্ষণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে। এ ছাড়া চ্যাপ্টা কাঠের খণ্ডযুক্ত মই-এর ব্যবহার মাটিকে গুঁড়ো করতে ও কৃষিজমির উপরিভাগকে মসৃণ বা সমতল করতে সাহায্য করে। ফলে সুচারুভাবে বীজ বপনের কাজটি হয়ে যায় সহজ।
- বলদের পরিবর্তে ঘোড়া: পূর্বে ভারী লাঙল টানার জন্য পশুশক্তি হিসেবে ষাঁড় বা বলদের ব্যবহার করা হত। তবে এটি ছিল যথেষ্ট ব্যয়বহুল। তাই অপেক্ষাকৃত দরিদ্র কৃষকেরা যৌথভাবে ঘোড়ায় টানা মই বা হ্যারো (Harrow) ও লাঙলের ব্যবহার শুরু করেন। ঘোড়ার শক্তিকে কাজে লাগানোর ফলে দ্রুত জমি কর্ষণ চলতে থাকে। ঘোড়ার খুরে লাগানো হয় লোহা।
- জেথরো টুল-এর আবিষ্কার: ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কৃষক জেথরো টুল ঘোড়ায় টানা শস্য বোনার একটি যন্ত্র (Seed Drill) আবিষ্কার করেন। আগে মাটিতে শস্যদানা ছড়িয়ে দেওয়া হত। এখন নির্দিষ্ট দূরত্বে একটি করে দানা রোপণ করা সম্ভব হয়।
- অন্যান্য যন্ত্রপাতি: উপরোক্ত কৃষি উপকরণগুলি ছাড়াও আগাছা পরিষ্কারের জন্য নিড়ানি, বনভূমি কেটে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত করার জন্য ভারী কুঠার তৈরি দাঁড়াবিশিষ্ট কাস্তে ব্যবহারের ফলে অল্প শ্রম ও সময় ব্যয় করে শস্য কাটা হতে থাকে। পাশাপাশি উন্নতমানের
(2) জলসেচের প্রসার: দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে জলসেচ পদ্ধতি প্রচলিত হয়। এ বিষয়ে ইউরোপের পথপ্রদর্শক ছিল ইটালি। মিলানের কাছাকাছি স্থানে ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয় স্থায়ী জলাধার। এরপর জলসেচের কাজে পাম্পিং প্রযুক্তির উন্নতি ঘটতে থাকে। ক্রমে ইউরোপের নিম্নাঞ্চল ও উত্তর সাগরের তীরবর্তী দেশগুলিতে অসংখ্য নালা ও খাল খননের মাধ্যমে জলসেচের বন্দোবস্ত করা হয়। ষোড়শ শতকে রানি এলিজাবেথের সময় বহু ফ্লেমিশ (Flemish) প্রোটেস্ট্যান্টরা ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এঁদের প্রয়াসে ইংল্যান্ডে কৃষি প্রযুক্তিতে অভূতপূর্ব উন্নতিসাধন ঘটেছিল। এই সময় ইংল্যান্ডের জলাভূমিগুলিকে আবাদি জমিতে পরিণত করা হতে থাকে, সেচব্যবস্থাও হয়ে ওঠে উন্নত।
(3) কৃষিজমির সম্প্রসারণে প্রযুক্তি: ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে জঙ্গল সাফাই এবং পশুচারণভূমি ও জলাভূমির আমূল সংস্কার করে কৃষিজমি বাড়ানোর চেষ্টা চলতে থাকে। এই সময় বনজঙ্গল সাফাই করার ক্ষেত্রেও আধুনিক লোহার যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া সমুদ্রের গ্রাস থেকে উদ্ধার করার জন্য জমিকে বাঁধ বা প্রাচীর দিয়ে করা হয় সুরক্ষিত। এই ব্যবস্থা Dyke (Dike) System নামে পরিচিত।
(4) কৃষি পদ্ধতিতে পরিবর্তন: কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ইউরোপে নতুন নতুন কৃষি পদ্ধতির প্রচলন হয়েছিল।
- এনক্লোজার পদ্ধতি: ইংল্যান্ডে পঞ্চদশ শতকের শেষ পর্বে জমিকে বেড়া দিয়ে (Encloser) ঘিরে ভেড়া প্রতিপালনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। একে বেষ্টনী পদ্ধতি (Encloser System) বলা হয়। ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে স্থির হয়, একই জমিতে পালটে পালটে ভেড়া চাষ ও কৃষিকাজ করা হবে। এর ফলে কৃষির উপকার হয়েছিল।
- থ্রি-ফিল্ড পদ্ধতি / নিবিড় কৃষি: মধ্যযুগে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য টু-ফিল্ড পদ্ধতি (Two Field System) প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে পরপর কয়েক বছর শস্য উৎপাদনের পর সেই জমিকে অনাবাদী হিসেবে ফেলে রাখা হত এবং খেতের অংশবিশেষও কয়েক বছর (২/৪ বছর) অকর্ষিত রাখা হত। তবে ষোড়শ শতকের গোড়া থেকে শুরু হয় নিবিড় কৃষি পদ্ধতি। এই ব্যবস্থায় জমিকে তিনভাগে ভাগ করে চাষ করা হত, যাকে থ্রি-ফিল্ড পদ্ধতি বা Three Field System বলা হয়ে থাকে। নিবিড় কৃষিতে জমির একভাগ এক বা একাধিক বছর পতিত রেখে অন্য দুই ভাগে পালটে পালটে কৃষিকাজ চলত। অন্যদিকে এই যুগে আবর্তন পদ্ধতির (Rotation System) মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
(5) মিশ্রসারের ব্যবহার: আলোচ্য পর্বে ইউরোপে কৃষিজমিতে মিশ্রসারের ব্যবহার হতে থাকে। এর ফলে জমির উর্বরতাশক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল।
মূল্যায়ন
ইউরোপে কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির প্রভাবে কৃষিজ উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। শুরু হয়েছিল কৃষিজমিতে বাণিজ্যিক ফসল উৎপাদন। যার ফলে, বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটেছিল। আবার তুলো, শন ইত্যাদি তন্তুজাতীয় কাঁচাপণ্যের উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপে বস্ত্রশিল্পও হয়েছিল সমৃদ্ধ। অবশ্য ক্রমান্বয়ে ব্যক্তিস্বার্থ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে একদিকে যেমন ধনী কৃষকেরা জমি কিনে বৃহৎ খামারগুলির মালিকে পরিণত হয়, অন্যদিকে দরিদ্র কৃষকেরা হয়ে পড়ে ভূমিহীন। ক্রমে বৃদ্ধি পায় কৃষক শোষণ। এছাড়া কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন উৎপাদনরীতির প্রণয়ন ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন ধনতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার (Capitalist Agriculture) ভিত্তি রচনা করে।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর