ইতিহাসচর্চায় মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দাও

ইতিহাসচর্চায় মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দাও

ইতিহাসচর্চায় মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি

মানবতাবাদ ছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁ চিন্তাধারার এক অন্যতম অঙ্গ। ইতিহাসচর্চায় এই মানবতাবাদের প্রভাব ছিল যথেষ্ট। মানবতাবাদীরা এই সময় অতীতকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট যুগ বা পর্যায়ে ভাগ করে আধুনিক ইতিহাসচর্চার প্রথা ও নীতির উদ্ভাবন করেছিলেন।

(1) অন্ধকার যুগের ধারণা: মানবতাবাদী ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন যুগ ছিল ধ্রুপদি এবং সুবর্ণময় পর্ব। কিন্তু পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের ফলে বর্জিত হয় গ্রিকো-রোমান সংস্কৃতি। এই সময় থেকেই অন্ধকার যুগের (Dark Age) সূচনা ঘটে। মানবতাবাদীদের চোখে খ্রিস্টের আবির্ভাব সত্ত্বেও এই যুগ ছিল অন্ধকারে আচ্ছন্ন এবং এই সময়কার জীবনধারা ছিল চার্চ নিয়ন্ত্রিত।

(2) নবযুগ বা আধুনিক যুগল: চতুর্দশ শতকে ধ্রুপদি সাহিত্য-সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগের অবসান ঘটায়। ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী নবযুগের সূচনা হয় যা ছিল মানবতাবাদী পণ্ডিতদের কাছে আধুনিক যুগ। মানবতাবাদীগণ মনে করতেন এই সময়কালেই একটি নতুন ঐতিহাসিক পর্বের সূত্রপাত ঘটে।

(3) চক্রাকার ইতিহাসের তন্ত্র: খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকের প্রখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ সেন্ট অগাস্টাইন (Saint Augustine) বিশ্বাস করতেন যে, ইতিহাস সরলরৈখিক পথে চলে এবং এই পথেই জগতকে কেন্দ্র করে ঈশ্বরের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অল্প অল্প করে প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু এই তত্ত্বকে অস্বীকার করে মানবতাবাদীরা অ্যারিস্টটলের চক্রাকারে ইতিহাসের চলার তত্ত্বকে পুনরুজ্জীবিত করেন। মানবতাবাদী পণ্ডিতেরা মনে করেন, স্কলাস্টিক গোঁড়ামির দাপটে প্রাচীন কালে সুবর্ণযুগের যে গৌরব হ্রাস পেয়েছিল, সেটাই আবার নবজাগরণের কালপর্বে সঞ্জীবিত হয়েছে। সময় আর ইতিহাস তার নিজের গতিতে চলে, এতে ঈশ্বরের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও সম্পর্ক নেই।

(4) ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চা: রেনেসাঁর যুগে ইতিহাসচর্চা ছিল মূলত ধর্মনিরপেক্ষ। এই পর্বের পণ্ডিতগণ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় কোনও ঐশ্বরিক মহিমার বহিঃপ্রকাশ দেখেননি। আসলে এই সময়ে যে মানবতাবাদের বিকাশ ঘটেছিল, তার একটি অন্যতম স্তর ছিল নাগরিক মানসিকতা। আলোচ্য পর্বে এই নাগরিক মানসিকতার ধারক ও বাহকদের একাংশ শাসন বিভাগের বিভিন্ন পদে এবং নব্য বণিকরূপে নিযুক্ত থাকতেন। অ্যারিস্টটলের ধ্যানধারণা দ্বারা এঁরা ছিলেন গভীরভাবে প্রভাবিত।

(5) ইতিহাসের বিষয়বস্তু: এই পর্বে মানুষের সহজাত সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপস্থাপন ও বিশ্লেষণই ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে প্রাধান্য পেত।

(6) বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও তাঁদের রচনা: ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময়কালে কয়েকজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এবং তাঁদের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল- জিওভান্নি ভিল্লানি (Giovanni Villani) এবং তাঁর সৃষ্টি ‘New Chronicles’, লিওনার্দো বুনির (Leonardo Bruni) ‘History of the Florentine People’, ফ্রান্সিসকো গুইসিয়ারডিনি (Francesco Guicciardini)-র ‘The History of Italy: From the Year 1490 to 1532’, জাঁ বোদা রচিত ‘Early Introduction to the  History’ এবং নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির ‘The Florentine Histories’.

আরও পড়ুন – আজব শহর কলকেতা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment