ইক্তা ব্যবস্থার উদ্ভব ও তার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো

ভারতে দিল্লির সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠার (১২০৬ খ্রিস্টাব্দ) সঙ্গে সঙ্গে রাজকোশে অর্থসংগ্রহের জন্য সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। সেসময় শাসকেরা উপঢৌকন ও যুদ্ধকালে লুণ্ঠন করা অর্থ সংগ্রহ করে অর্থসংস্থান করতেন। পরবর্তীকালে সুলতানের শক্তি বৃদ্ধি এবং সাম্রাজ্য প্রসারিত হওয়ার কারণে আর্থিক সংস্থান এবং দূরবর্তী অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এইরূপ পরিস্থিতিতে সুলতানি যুগে ইলতুৎমিসের আমল থেকে ভারতে ইক্তা প্রথা সাংগঠনিক রূপ পেতে শুরু করে।
ইক্তা ব্যবস্থার ধারণা
আক্ষরিক অর্থে ফারসি শব্দ ইক্তা মানে এক অংশ বা ভাগ। কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল সুলতানি আমলে প্রচলিত এক ধরনের ভূমিদান ও ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত। কে এ নিজামি-র মতে, ইসলামের উত্থানের সূচনাকাল থেকে রাষ্ট্রীয় সেবার বিনিময়ে পুরস্কার হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইক্তা প্রদানের রীতি চালু ছিল। ভারতে সুলতানি শাসন শুরুর বহু আগেই নিজাম-উল-মুলক তুসি-র লেখা সিয়াসৎনামা গ্রন্থে ইক্তা ব্যবস্থার উল্লেখ পাওয়া যায়।
ভারতে ইক্তা ব্যবস্থার প্রচলন
ভারতে মহম্মদ ঘুরির ক্রীতদাস কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লিতে সুলতানি শাসনের সূচনা করেন (১২০৬ খ্রিস্টাব্দ)। এরপর সুলতান পদে আসীন হন ইলতুৎমিস। কিন্তু তখন সুলতানের কর্তৃত্ব মূলত দিল্লি ও তার সন্নিহিত অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময় বহু ভাগ্যান্বেষী তুর্কি সর্দার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্তৃত্ব কায়েম করেন এবং শাসন চালাতে থাকেন। দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস এই সকল আঞ্চলিক তুর্কি সর্দারদের আনুগত্য লাভের প্রয়োজনে এদের ইক্তা প্রদান করে দুটি উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা করেন-
- দূরবর্তী আঞ্চলিক তুর্কি সর্দারকে ‘ইক্তা’-র অধিকারী ঘোষণা করে ওই অঞ্চলের উপর দিল্লির কর্তৃত্বকে বৈধ রূপ প্রদান এবং
- ইক্তার প্রাপককে স্থানীয় অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা ও রাজস্ব আদায় করার দায়িত্ব প্রদান করে সুলতানি সাম্রাজ্যকে সামরিক ও আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ করা।
ঐতিহাসিক কে এ নিজামিও বলেছেন যে, ভারতের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর জন্য দিল্লির প্রথমদিকের সুলতানগণ বিশেষত ইলতুৎমিস ইক্তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। নববিজিত অঞ্চলগুলি থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করা, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও দূরবর্তী এলাকাগুলিকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে সংযুক্ত করা, এই সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়েছিল ইক্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই।
ইক্তা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
ইক্তা ব্যবস্থা ছিল একাধারে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থার সমাবেশ। এই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(1) ভূখণ্ড বণ্টন
সুলতান নির্দিষ্ট শর্ত ও কাজের বিনিময়ে তাঁর সেনাধ্যক্ষ বা অভিজাতদের মধ্যে একটি ভূখণ্ড বণ্টন করতেন। এই জমিকে বলা হত ইক্তা। ইক্তার প্রাপককে বলা হত মুক্তি বা ইক্কাদার। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারা ওয়ালি বা উলিয়াৎ নামেও অভিহিত হতেন।
(2) খালিসা-বহির্ভূত জমি প্রদান
সুলতানের খাস জমি বা খালিসা থেকে সুলতানের রাজস্ব বিভাগীয় কর্মচারী কর্তৃক রাজস্ব আদায় ও তা সরাসরি রাজকোশে জমা করা হত। কাজেই খালিসা-বহির্ভূত যেসমস্ত প্রান্তীয় এলাকা থাকত, সেগুলিই ইক্তাদারকে প্রদান করা হত।
(3) ভূমিকর আদায়
মুক্তি মূলত তার অধীনস্থ ইক্তা থেকেই ভূমিরাজস্ব আদায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এ ছাড়া প্রজাদের কাছ থেকে মুক্তি অন্য কোনোপ্রকার অর্থ বা কর আদায় করতে পারতেন না।
(4) প্রজাদের উপর অধিকার
প্রাপ্ত ভূখণ্ড বা প্রজাদের উপর মুক্তির অন্য কোনও অধিকার স্বীকৃত ছিল না। প্রাথমিক পর্বে ইক্ক উপর ইক্তাদারদের বংশানুক্রমিক অধিকারও স্বীকৃত ছিল না। প্রয়োজনে সুলতানের দরবারে এসে প্রজা বা কৃষক নিজেদের অভিযোগ বা সমস্যা জানাতে পারত। রাজস্বের পরিমাণও ইক্কাদার নিজে স্থির করতে পারতেন না।
(5) রাষ্ট্রের প্রাপ্য উদ্বৃত্ত আদায়
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় কৃষকের উৎপাদনের উদ্বৃত্তের একাংশ ছিল রাষ্ট্রের প্রাপ্য। ইক্কাদারদের মাধ্যমেই রাষ্ট্র তার প্রাপ্য আদায় করতে পারত। মুক্তি ইক্তা-র আদায়ীকৃত রাজস্বের একাংশ ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু উদ্বৃত্ত অংশ তিনি দিল্লির কোশাগারে জমা দিতে দায়বদ্ধ ছিলেন।
(6) সুলতানের উপর নির্ভরশীলতা
মুক্তিরা পুরোপুরি সুলতানের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তাদের সর্বদা খেয়াল রাখতে হত যে, দেশ ও প্রজাদের উপর কেবলমাত্র সুলতানের অধিকারই আইনগতভাবে স্বীকৃত এবং মুক্তিরা ছিলেন সুলতান নিযুক্ত অছি (Trustee) মাত্র। সমসাময়িক রাষ্ট্রনেতা নিজাম-উল-মূলক বলেছেন যে, ইক্কার মালিক সুলতানের ইচ্ছানুসারে ইক্তা ভোগ এবং স্ব-পদে বহাল থাকতে পারতেন। সুলতান মনে করলে তাদের পদচ্যুতও করতে পারতেন। মুক্তি ইক্তার কর আদায় ও ভোগ করলেও তা মূলত সুলতানেরই প্রাপ্য।
(7) শাস্তি ও বদলি
মুক্তি যদি ইক্তার নিয়মকানুন ভঙ্গ করতেন বা সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন, তবে সুলতান তাকে কঠোর শাস্তি প্রদান করতেন। সেইসঙ্গে অনেকসময় তার ইক্তাও বাজেয়াপ্ত করে নিতেন। বংশানুক্রমিক না হওয়ায় মাঝেমধ্যেই ইক্তাদারদের বদলি করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো হত।
(8) স্থানীয় রাজপুত নেতাদের অন্তর্ভুক্তি
ভাগ্যান্বেষী তুর্কি যোদ্ধাদের ছাড়াও স্থানীয় রাজপুত নেতা রাই, রানা, রাউত প্রমুখকে ইক্তা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল। এরা স্থানীয়ভাবে নিজ নিজ এলাকায় রাজস্ব আদায় করে সরকারি কোশাগারে জমা দিতে দায়বদ্ধ ছিলেন।
ইক্তাদারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
সুলতানি প্রশাসনে ইক্ক্ততাদাররা যেসকল দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতেন, সেগুলি হল-
(1) সামরিক দায়িত্ব
নিজাম-উল-মুলক মুক্তির কর্তব্য সম্পর্কে বলেছেন, ইক্তার রাজস্ব ভোগের বিনিময়ে মুক্তি একদল সেনাবাহিনী পোষণ করতেন এবং সুলতানের প্রয়োজনকালে বা যুদ্ধের সময় সেই বাহিনী দিয়ে সুলতানকে সাহায্য করতে দায়বদ্ধ ছিলেন। ড. ইরফান হাবিব-এর ভাষায়, মুকৃতি ছিলেন একের মধ্যে দুই। একাধারে তিনি ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী এবং সেনাবাহিনীর জোগানদার (The Muqti was thus tax collector; and army paymaster, also commander rolled into one.) I
(2) প্রশাসনিক দায়িত্ব
ইক্তাদাররা নিজ নিজ ইতাতে, রাজস্ব সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। তিনি তার অধীনস্থ ইক্তা থেকে আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ, সেনাবাহিনীর বেতন ও প্রশাসনিক ব্যয়ের হিসাব নিয়মিত দিল্লিতে পাঠাতে দায়বদ্ধ থাকতেন। এ ছাড়া স্থানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কেও কেন্দ্রকে অবগত করে ইক্তাদাররা কেন্দ্রের সঙ্গে জনসাধারণের প্রশাসনিক যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
(3) শৃঙ্খলা রক্ষা ও বিদ্রোহ দমন
নিজ এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও বজায় রাখা ছিল মুক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ ছাড়া সুলতান-বিরোধী কোনও বিদ্রোহ দমন করতেও ইক্তাদাররা ও তাদের সৈন্যবাহিনী তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
(4) অধিকৃত এলাকায় নিয়ন্ত্রণ
দিল্লির সুলতানরা যেসকল এলাকা দখল করতেন, সেখানে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেন ইক্তাদাররা।
(5) আর্থিক কার্যকলাপ
ইক্তাদাররা নিজ এলাকার কৃষি, বাণিজ্য তথা আর্থিক উন্নয়নে সচেষ্ট থাকতেন।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর