ইউরোপে মুদ্রণবিপ্লবের পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করো

ইউরোপে মুদ্রণবিপ্লবের পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করো

অথবা, ইউরোপে কীভাবে মুদ্রণবিপ্লব ঘটে

ইউরোপে মুদ্রণবিপ্লবের পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করো
ইউরোপে মুদ্রণবিপ্লবের পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করো

মুদ্রণবিপ্লব জ্ঞানের আলোকে বদ্ধদশা থেকে মুক্ত করে সমাজকে আলোকিত করে তোলে। ইউরোপে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার এবং এর পাশাপাশি কাগজের প্রচলন, শিক্ষার প্রসার ও নবজাগরণ-প্রসূত মানবতাবাদী চেতনা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপের মুদ্রণশিল্পে অভাবনীয় পরিবর্তন সূচিত হয়। বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বই ছাপার পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই ঘটনাই সামগ্রিকভাবে ইউরোপের মুদ্রণবিপ্লব নামে পরিচিত।

ইউরোপে মুদ্রণবিপ্লবের পটভূমি

(1) কাগজের ব্যবহার: মধ্যযুগে ইউরোপে যা বই হিসেবে পরিগণিত হত, তা ছিল মূলত হাতে লেখা পুথি। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে ইউরোপে অ্যারিস্টটলের রচনার প্রায় ২০০০টি পুথির সন্ধান মিলেছে। তবে হাতে পুথি লেখার কাজ ছিল যেমন কষ্টসাধ্য তেমনই সময়সাপেক্ষ। এই পরিস্থিতিতে চিন থেকে আরবদের হাত ধরে ইউরোপে প্রবেশ করে মুদ্রণ প্রযুক্তি। ১২৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইটালির বোলোনায় প্রতিষ্ঠিত হয় একটি কাগজের কল। এইভাবে কাগজের প্রচলন ইউরোপে বই প্রস্তুতির কাজকে অনেক বেশি সহজ করে তোলে।

(2) অল্পমূল্যে মুদ্রণ: কাগজে মুদ্রিত বইগুলি দেখতে সুন্দর ও আকর্ষণীয় হওয়ার পাশাপাশি দামেও সস্তা হয়। জানা যায়, পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময় নাগাদ কাগজের মূল্য ছিল পার্চমেন্টের ১/৬ অংশ। তাছাড়া এসময় কাগজের ব্যবহারের দরুন পুথির রচনা একটু কম ব্যয়সাপেক্ষ হয়েছিল। তাই দামি এবং অলংকৃত বইয়ের সঙ্গে সাধারণ দেখতে অথচ কম মূল্যের পুথির প্রচলনও শুরু হয়।

(3) আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার: চতুর্দশ শতকের শেষদিকে প্রাচ্যের ব্লক মুদ্রণ পদ্ধতি ইউরোপে প্রবেশ করে। তবে ত্রয়োদশ শতক থেকেই ইউরোপে বইয়ের যে চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা নকল করা পুথি কিংবা ব্লক মুদ্রণ পদ্ধতি দ্বারা পূরণ করা সম্ভব ছিল না। তাই পুনর্ব্যবহারযোগ্য ধাতুর হরফ (টাইপ) এবং আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই প্রেক্ষাপটে জোহানেস গুটেনবার্গ কর্তৃক জার্মানির মেইনজ শহরে প্রথম মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তা মুদ্রণশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।

(4) মুদ্রণশিল্পে উৎকর্ষতা বৃদ্ধি: এসময় ধাতুশিল্পে উন্নতির পাশাপাশি তেলমিশ্রিত রঙের ব্যবহারও শুরু হয়েছিল, যা ছাপাখানার পক্ষে ছিল উপযুক্ত। সেইসঙ্গে স্বর্ণকারদের খোদাই করা নতুন ধরনের সূক্ষ্ম ধাতব অক্ষর মুদ্রণবিপ্লবের পটভূমি তৈরিতে সহায়তা করে।

(5) পাঠকসমাজের উদ্ভব:

  • পেশাগত প্রয়োজনীয়তা: আলোচ্য পর্বে সরকারি কর্মচারী, রাজসভার অযাজকীয় পরামর্শদাতা, আইনজীবী, বণিক প্রত্যেকেরই নিজ নিজ জীবিকার জন্য পুথিগত শিক্ষা জরুরি হয়ে পড়ে। এসময় বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এদের প্রয়োজনে দর্শন, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, তর্কবিদ্যা, আইনশাস্ত্র, ভেষজশাস্ত্র, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকের প্রয়োজন অনুভূত হয়।
  • অন্যান্য সাহিত্যে আগ্রহ: পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ধর্মগ্রন্থ, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী ও সৃজনশীল সাহিত্যও পাঠক, মুদ্রক ও প্রকাশকদের আকৃষ্ট করে। তাছাড়া এই পর্বে স্থানীয় ভাষায় নানান সাহিত্য, নীতিকথা রচনা করা হত, তাই এই ধরনের পুস্তকের চাহিদাও পাঠকের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

(6) রেনেসাঁর প্রভাব: পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে রেনেসাঁ-প্রসূত ভাবধারার প্রসার ঘটে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা-সহ শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় জ্ঞানের স্ফুরণ ঘটে। সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার চাহিদা সৃষ্টি হয়, ভদ্রলোক ও শহুরে মানুষ বুর্জোয়া শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। স্টিভেন ওজমেন্ট (Steven Ozment) মন্তব্য করেছেন যে, আলোচ্য পর্বে সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছিল (This was a period of expanding lay education), গড়ে ওঠে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসময় গ্রামার স্কুলেরও প্রবর্তন হয়েছিল। পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছিল বই কেনার চাহিদা।

(7) বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি: পূর্বে যেহেতু যাজকদের প্রয়োজনেই গ্রন্থ লেখা হত, তাই হাতে লেখা পুথি সেই প্রয়োজন মেটাতে পারত। তবে এই পুথির দাম পড়ত অনেক বেশি। আগে উচ্চবিত্তরাই বই কেনার বিলাসিতা ভোগ করত। কিন্তু ক্রমশ পুথির চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ একটি পুথিতে ফ্লেমিশ ভাষায় একটি চিঠি পাওয়া যায়, যেখানে বিভিন্ন পুথির দুশো থেকে চারশো কপি সরবরাহ করতে বলা হয়েছিল। এ থেকে বইয়ের চাহিদা ও বাজার সম্পর্কে অনুমান করা যায়।

অন্যদিকে যন্ত্রের সাহায্যে কাগজের বই ছাপা শুরু হলে স্বল্পমূল্যে সর্বস্তরের মানুষের কাছে বই পৌঁছে যেতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে আগে জ্ঞানার্জনের উপায় কেবলমাত্র শিক্ষকের বক্তৃতা হলেও, বই সুলভ হওয়ার সুবাদে ছাত্ররাও প্রচুর বই কিনতে থাকে। সবমিলিয়ে নানান ক্ষেত্রে বা বিভিন্ন কারণে বইয়ের চাহিদা ও তার ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে, ইউরোপে মুদ্রণশিল্পে বিপ্লব ঘটে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment