আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় জোহানেস কেপলারের অবদান আলোচনা করো

আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় জোহানেস কেপলারের অবদান আলোচনা করো

আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় জোহানেস কেপলারের অবদান আলোচনা করো
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় জোহানেস কেপলারের অবদান আলোচনা করো

আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার (Johannes Kepler, ১৫৭১-১৬৩০ খ্রিস্টাব্দ)। দার্শনিক ও ঐতিহাসিক বার্ট্রান্ড রাসেল-এর মতে, অসাধারণ প্রতিভা না থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র ধৈর্যের সাহায্যেই যে অনেককিছুই করা সম্ভব, তারই এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন কেপলার।

আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় জোহানেস কেপলারের অবদান 

(1) সংক্ষিপ্ত পরিচয়: ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর জার্মানির স্টুটগার্ট অঞ্চলে জোহানেস কেপলার জন্মগ্রহণ করেন। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী এই বিজ্ঞানীর শৈশবকাল কেটেছিল সীমাহীন দারিদ্র্যতার মধ্যে। মেধাবী কেপলার ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে টুবিংগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাস্টলিন (Michael Maestlin) তাঁকে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা পাঠে উৎসাহিত করে তোলেন। পরবর্তীকালে কেপলার প্রথমে গ্রাজের এক বিদ্যালয়ে গণিত ও জ্যোতিষের শিক্ষক ও তারপর প্রাগে অবস্থিত টাইকো ব্রাহের পর্যবেক্ষণাগারে তাঁর সহকারী হিসেবে যোগ দেন।

(2) টাইকো বাহের সহকারী: টাইকো ব্রাহের সহকারী পদে কেপলারের নিয়োগ জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয় ছিল। এর ফলে ব্রাহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণের সুযোগ কেপলারের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। কেপলার গাণিতিক তত্ত্বের বিশ্লেষণ দ্বারা ব্রাহের পর্যবেক্ষণকে চরম সার্থকতা দেন। ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে টাইকো ব্রাহে আকস্মিকভাবে মারা গেলে কেপলার প্রাগের মানমন্দিরের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন।

(3) কেপলারের তত্ত্ব: পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ইউরোপে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় নতুন নতুন পর্যবেক্ষণের ভিত্তি ছিল পিথাগোরীয় গণিত ও ভাবধারার উপর নির্ভরতা। কেপলারের গবেষণায় পিথাগোরীয় গণিতের অবদান সর্বাধিক। গভীর পর্যবেক্ষণ ও গাণিতিক বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে কেপলার যে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন, তাদের অন্যতম হল- গ্রহনক্ষত্র যদি গতিশীল হয়, তাহলে কেন তারা গতিশীল? গ্রহদের গতি কি একইরকম? গ্রহগুলির পরিক্রমার সময়ও কি একই? কেপলার তাঁর বিচক্ষণতা, পর্যবেক্ষণ ও গাণিতিক বিশ্লেষণের দ্বারা নিজ তত্ত্বে এই প্রশ্নগুলির ব্যাখ্যা দেন।

  • কেপলারের ডিনসূত্র: কেপলার তাঁর তত্ত্বে গ্রহের গতিবিধি সংক্রান্ত তিনটি সূত্রের উপস্থাপন করেন। এই সূত্রগুলি হল-
  •  প্রথম সূত্র: সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পরিক্রমা করে। এটি কেপলারের First Law বা প্রথম সূত্র নামে পরিচিত।
  • দ্বিতীয় সূত্র: গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি বলেন, একই সময়ের ব্যবধানে গ্রহের যে-কোনো অবস্থানে সূর্য থেকে গ্রহ পর্যন্ত সংযুক্ত সরলরেখা একই ক্ষেত্রফল তৈরি করে। এটি হল কেপলারের Second Law বা দ্বিতীয় সূত্র।
  •  তৃতীয় সূত্র: একটি গ্রহের আবর্তনকালের বর্গ সূর্য থেকে তার গড় দূরত্বের ঘনফলের সমানুপাতিক। এটি Third Law বা তৃতীয় সূত্র নামে পরিচিত।
  • মহাকর্ষের উপলব্ধি: কেপলারের তত্ত্বে প্রত্যক্ষভাবে মহাকর্ষের ধারণা উঠে না এলেও, তিনি সূর্য ও গ্রহের মধ্যে এমনই এক শক্তির অস্তিত্ব অনুমান করেছিলেন। উইলিয়ম গিলবার্টের (William Gilbert) De Magnete অধ্যয়ন করে তাঁর ধারণা হয় যে, চুম্বক ও লোহার মধ্যে যেমন আকর্ষণকারী শক্তি বিদ্যমান, ঠিক তেমনই এক শক্তি হল Anima Motrix, যা সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত হয়। সূর্য নিজ অক্ষে আবর্তনের সময় বিচ্ছুরিত Anima Motrix- এর সহায়তায় গ্রহগুলিকেও নিজের চারপাশে পরিক্রমণে বাধ্য করে। এর পাশাপাশি তিনি এরকমও বলেছেন যে, ‘বস্তুরা পরস্পর পরস্পরকে প্রভাবিত করে থাকে ও তাদের মধ্যে একপ্রকার স্নেহের আকর্ষণ বিদ্যমান। এই আকর্ষণবলে চুম্বকের মত তারা নিজেদের সঙ্গে মিলিত হতে প্রয়াসী হয়। একটি প্রস্তরখণ্ড উপর থেকে নীচে মাটিতে পড়ে, কারণ পৃথিবী তাকে আকর্ষণ করে।’ তাঁর তত্ত্বের সাহায্যেই পরবর্তীকালে নিউটন ‘মহাকর্ষ সূত্র’ আবিষ্কার করেছিলেন।
  • কোপারনিকাসের তত্ত্বকে খন্ডল: কোপারনিকাস যেখানে গ্রহগুলির বৃত্তাকার কক্ষপথের কথা বলেছিলেন, কেপলার সেখানে উপবৃত্তাকার কক্ষপথের প্রমাণ দেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, সূর্যকে ফোকাস দূরত্বে রেখে মঙ্গল গ্রহটি একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরে চলেছে। এ ছাড়াও তিনি প্রমাণ করে দেখান যে, পৃথিবী-সহ অন্যান্য গ্রহগুলি সূর্যের চারিদিকে উপবৃত্তাকার বা ডিম্বাকার কক্ষপথ ধরে ঘুরছে।

(4) অন্যান্য কীর্তি: কেপলার সূর্য থেকে মঙ্গল গ্রহের দূরত্ব ও মঙ্গল গ্রহের সঠিক কক্ষপথ আবিষ্কার করেছিলেন। পাশাপাশি আলোকবিদ্যা নিয়ে গবেষণা ছিল তাঁর অন্যতম কীর্তি। তিনি প্রতিসরণ দূরবিনের এক উন্নত সংস্করণ তৈরি করেন, যা বর্তমানে কেপলারীয় দূরবিন (Keplarian Telescope) নামে পরিচিত।

(5) গ্রন্থ রচনা: কেপলার বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লেখা মিস্টেরিয়াম কসমোগ্রাফিকাম (Mysterium Cosmographicum) এবং অ্যাস্ট্রোনমিয়া নোভা (Astronomia Nova) গ্রন্থ থেকে তাঁর তিনটি সূত্রের কথা জানা যায়। এর পাশাপাশি কেপলার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল-এপিটোম অ্যাস্ট্রোনমিয়ে কোপারনিকান (Epitome Astronomiae Copernicanae), হারমোনিকেস মুন্ডি (Harmonices Mundi), ডে স্টেলা নোভা (De Stella Nova), অ্যাস্ট্রোনমিয়া পারস অপটিকা (Astronomiae Pars Optica) ইত্যাদি।

মূল্যায়ন

কেপলারের তত্ত্ব ছিল প্রচলিত রোমান চার্চের তত্ত্বের বিরোধী। তাই নানাভাবে ধর্মীয় গোঁড়ামির আঘাত নেমে আসে তাঁর উপর।* তা সত্ত্বেও বলা যায়, কেপলারের হাত ধরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় এক অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে। পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের তুলনায় তিনি সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বব্র্যান্ডের ধারণাকে যুক্তিসহকারে অনেক বেশি নিখুঁত করে তোলেন। কাজেই তাঁর মতবাদ যে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার এক মাইলস্টোন স্বরূপ, তা অস্বীকার করা যায় না কোনোভাবেই।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment