আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর | Class 11 Second Semester

আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর | Class 11 Second Semester

আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর
আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর

১। “উঠে পড়। উঠে পড়। চাল আজ আর পাতি হবে নানে দেহিসখেন।” কে, কাকে বলেছে? কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি? বক্তা কেন কথাগুলো বলেছে? 1+2+2

বাংলা নাট্যসাহিত্যের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে সবজিবিক্রেতা দরিদ্র পরিবারের প্রতিনিধি জনৈক পুরুষ নেত্যকে উদ্দেশ করে কথাগুলো বলেছে।

সূচিপত্র

■ খাদ্যের সারিতে দাঁড়াতে হবে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার জন্য। গ্রামের সবজিবিক্রেতা পুরুষটি তাই অতিমাত্রায় সচেতন, চাল না পেলে অনাহারে থাকতে হবে তাদের। পুরুষটি দেখেছে জুড়োনের মা আগের দিন একেবারে খালি হাতে ফিরে এসেছে। চাল না পাওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কিত নেত্যর বাবা। ভোরের আলো ফুটেছে, সেই অস্পষ্ট আলোয় নেতার বাবা তার স্ত্রী ও পুত্রকে বারবার উঠে পড়ার কথা জানায়। চাল সংগ্রহের লাইনে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর প্রসঙ্গেই বস্তার এই উক্তি।

■ দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বরে চরম অসহায়তার দিকটি ফুটে উঠেছে। জঠরের জ্বালা বড়ো ভয়াবহ, দুর্ভিক্ষের পরিবেশ সেই ভয়াবহতাকে এনে দিয়েছে বাংলার লক্ষ লক্ষ পরিবারের সামনে। সবজিবিক্রেতা পুরুষ মানুষটি তার স্ত্রী, পুত্রকে বারবার তাগাদা দেয়, তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ে চালের লাইনে দাঁড়াতে। তাঁর মনে আশঙ্কার কালো মেঘ ঘনীভূত হয়, চাল না পেলে গোটা পরিবারের জঠরেই জ্বলবে ভয়াবহ আগুন। কারণ সে প্রত্যক্ষ করেছে আগের দিনই জুড়োনোর মা একেবারে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরেছে। আকালের দিনে দুটো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার আকুল বাসনায় বস্তার এই উক্তি। ব্যক্তি ও পরিবারের ক্ষুধা নিবারণের আর্তি এখানে ফুটে উঠেছে।

২।. “ঐগুলো বিক্রি করে শেষ পরে তো নাইনি গে চাল কিনবি।”-প্রসঙ্গ উল্লেখ করো। উক্তিটিতে কোন্ পরিস্থিতি ফুটে উঠেছে? 2+3

গণনাট্য আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে সবজিবিক্রেতা দরিদ্র শ্রেণির প্রতিনিধি জনৈক পুরুষ তাঁর স্ত্রী তথা নেত্যর মাকে কথাগুলো বলেছে। চাল সংগ্রহের আকুলতা পুরুষ চরিত্রটির কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠেছে। জাতীয় জীবনের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়কালে সবজিবিক্রেতা পরিবার একমুঠো চালের জন্য হাহাকার করে। কলমি শাক, দাঁতন কাঠি, কলা ইত্যাদি সব বাজারে বিক্রি করে তবেই চালের লাইনে দাঁড়াতে হবে। চরম দারিদ্র্য, অনটনের মধ্যে চাল পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে গিয়েই বস্তা উক্ত কথাগুলো বলেছিল।

■ জনৈক পুরুষের নেত্য আর নেতার মার প্রতি সংলাপে ফুটে উঠেছে চালের আকালের ছবি। পাড়াগ্রামের আর্তক্ষুধার্ত বুভুক্ষু মানুষের জীবনের বাস্তব সমস্যা এখানে নাট্যকার জীবন্ত করে তুলেছেন। বেঁচে থাকার জন্য চালের প্রয়োজন, দেরি করলে চাল অমিল হয়ে যাবে-এই আশঙ্কায় ভীত হয়েছে সবজিবিক্রেতা পুরুষ চরিত্রটি। সবজি বিক্রি করে যত সকাল সকাল যাওয়া যাবে ততই চাল পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে। অর্থাৎ চালের অভাব প্রকট, মানুষের ক্ষুধা আরও প্রকট। যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষের আকালে জনজীবনে খাদ্যের হাহাকার বড়ো জীবন্ত হয়েছে এখানে। মরেও মরেনি, এমন সব মানুষের নির্মম অভিজ্ঞতাই এখানে প্রতিভাসিত।

৩। “আচ্ছা তাল হইছে রোজ সকালে। একটু ঘুমোনোর জো নেই।”-বক্তা কে? বস্তা কাকে কখন কথাগুলো বলেছে? বক্তার এই উক্তির কারণ কী? 1+2+2

আধুনিক নাট্যসাহিত্যের বিশিষ্ট নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে আলোচ্য উক্তিটির বক্তা পাড়াগ্রামের সবজিবিক্রেতা পরিবারের সদস্য নেতা।

■ দুর্ভিক্ষের সময়কালে অভাব-অনটন আছে, চালের জন্য লাইনের চিন্তাও প্রবল। পাড়াগ্রামের সবজিবিক্রেতা পরিবারের সদস্যা নেতার মা তার ছেলেকে সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়ার কথা জানায়। প্রত্যুষ হয়েছে, মোরগ ডেকে উঠেছে দূরে, কুকুরের ডাকও শোনা যায়। চাল সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা অতি গভীর, কারণ চাল না পেলে নিরন্ন থাকতে হয় মেহনতি মানুষগুলোকে। তাই নেতার মা ছেলেকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার কথা বলে। তখনই নেত্য আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ে আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

■ দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে বিপর্যস্ত। সবজিবিক্রেতা পরিবারের সদস্যদের ভরসা সবজি বিক্রি করে চাল সংগ্রহ করা। নেতার বাবা অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুভব করেছে তাড়াতাড়ি চালের লাইনে না গেলে জুড়োনের মায়ের মতো খালি হাতে ফিরতে হবে। কিন্তু নেতা তা অনুভব করেনি। সে আলস্য ভেঙে বিরক্তি প্রকাশ করে। সকালবেলায় তার মায়ের ঘুম থেকে উঠে পড়ার ডাক একেবারেই তার পছন্দ হয়নি। তাই চরম বিরক্তিতে সে আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

.৪। তারপর কলেকষ্টে এই চৈতেলির ফসলগুলো মাচায় তুলতি পারলি হয়, কিছুদিনের মতো নিশ্চিন্দি, কী বলিস-এখানে কোন্ পরিবারের ছবি ফুটে উঠেছে? বক্তার কথার মধ্য দিয়ে যে পরিস্থিতি ফুটে উঠেছে তার বর্ণনা দাও। 2+3

পঞ্চাশের পটভূমিকায় রচিত প্রথিতযশা নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে এখানে গ্রামের কৃষক পরিবারের ছবি ফুটে উঠেছে। কৃষাণ ও কৃষাণির উপস্থিতিতে অজ গাঁয়ের ভিজে মাটির গন্ধলাগা কৃষক পরিবার নাট্যদৃশ্যে উপস্থিত।

■ দুর্ভিক্ষের আকালের কঠিন পরিস্থিতি এখানে নাট্যকার ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে অভাব আছে, অনটন আছে, চালের জন্য চিন্তা আছে, বাঁচার আকুল আকাঙ্ক্ষা আছে। চৈত্র মাসের ফসল মাচায় তুলতে পারলে আর্থিক সুরাহা হবে-এই আশায় গ্রামের কৃষক বুক বাঁধে, তার স্ত্রীকে সেই আশ্বাসবাণী শোনায়। কৃষকের কথায় গ্রাম্য সরল ভালোবাসা, সুমধুর প্রেমের অমল ছবি উদ্ভাসিত। চৈত্র মাসের ফসল মাচায় তুলতে পারলে খাদ্যের সংকট থাকবে না, দুবেলা নিশ্চিন্তে খেতে পাওয়া যাবে, এই আশা-প্রত্যাশা ব্যঞ্চিত হয়েছে কৃষকের কথায়। একদিকে যেমন দুর্ভিক্ষজর্জর জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে অন্যদিকে মাঠের ফসলের প্রতি আকাঙ্ক্ষা ও ভরসার ছবিও এখানে প্রতিবিম্বিত। আবার অন্যদিকে দাম্পত্য প্রেম এখানে উদ্বেলিত।

৫। “কেষ্টর মা-র সঙ্গে আগেভাগে গে নাইনির একেবারে সে পেরথমে দাঁড়াবি।”-বক্তা কে? বক্তা কাকে কথাগুলো বলেছিল? বক্তা কখন, কেন কথাগুলো বলেছিল? 1+1+3

নট, নাট্যকার, পরিচালক বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে আলোচ্য উক্তিটির বক্তা গ্রামের কৃষক পরিবারের একজন কৃষকসদস্য।

■ কৃষক তার স্ত্রীকে আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

■ আলোচ্য নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে কৃষক পরিবারের ছবি ফুটে উঠেছে। সর্বত্রই দুর্ভিক্ষের ছবি, হাহাকারের ছবি। চৈত্র মাসের ফসল তখনও মাচায় তুলতে পারেনি বলে কৃষক বিশেষ চিন্তিত। সে তার স্ত্রীকে জানিয়েছিল, মাঠ থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে। তারপরই কৃষক তার স্ত্রীকে আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

■ আকালের সময়ে চালের জন্য সর্বত্রই হাহাকার ধ্বনিত হয়। কৃষক জানে তাড়াতাড়ি চালের লাইনে দাঁড়াতে না পারলে হয়তো খালি হাতেই ফিরতে হবে তার স্ত্রীকে। তখন ভাতের অভাবে পরিবারকে কঠিনতম কষ্ট সহ্য করতে হবে। মাঠ থেকে ফিরে এসে প্রবল ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে কৃষক। তাই সে চায় তার স্ত্রী তাড়াতাড়ি গিয়ে একেবারে লাইনের প্রথমে যেন দাঁড়িয়ে পড়ে। কেন্টর মায়ের সঙ্গে সকাল সকাল গিয়ে লাইনের প্রথমে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয় সে। অভাব, দারিদ্র্য অনটন জর্জরিত সময়কালে সামগ্রিক দুরবস্থার কারণেই কৃষকের এই মন্তব্য। ক্ষুধা নিবৃত্তির বড়ো দায় মেটানোর গভীর প্রয়াস এখানে বিম্বিত হয়েছে।

৬। ‘আরে কারখানায় যাব না তো যাব কোন্ চুলোয়।”-কোন্ প্রসঙ্গে বক্তার এই উত্তি? বক্তার উত্তির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো। 2+3

প্রথিতযশা নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে আলোচ্য উক্তিটির বক্তা কারখানার শ্রমিক সতীশ। সতীশ ও জুড়োন দুজনেই কারখানার শ্রমিক। ভোরের আলো ফোটার পর দূর থেকে কলের ভোঁ শোনা যাচ্ছে। সতীশ তার সহকর্মী জুড়োনকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে সে কারখানায় যাচ্ছে কিনা। জুড়োন ইতিবাচক উত্তর দিয়েছিল এবং সতীশ কাজে যাচ্ছে কিনা জানতে চেয়েছিল। জুড়োনের জিজ্ঞাসার উত্তরেই সতীশ আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

■ সতীশ ও জুড়োন কারখানার দুই শ্রমিকের কথোপকথনে ফুটে উঠেছে শ্রমিক জীবনের অর্থসংকটের ছবি। সমস্যা এখানেও সেই চালের। দুর্ভিক্ষজর্জর সমাজে চালের জন্য হাহাকার সর্বত্রই প্রতিধ্বনিত হয়। হাতে পয়সা নেই, পয়সা কোনোমতে সংগ্রহ হলেও চালের জন্য দীর্ঘ লাইন দেওয়া, তাতেও শেষ পর্যন্ত চাল মিলবে কিনা তারও ঘোর অনিশ্চয়তা। সতীশকে কারখানায় কাজে যেতেই হবে, কেন-না কারখানায় না গেলে তার মতো অতি সাধারণ শ্রমিকের জীবনে নেমে আসবে ভয়ানক অভাব। সতীশ সংসারী মানুষ, স্ত্রী-কন্যা নিয়ে তার সংসার। তাদের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার দায়িত্ব তার। অভাব-অনটনে পর্যদুস্ত সে, তাই কারখানায় তাকে যেতেই হবে। কারখানায় কাজে যাওয়ার বাধ্যবাধ্যকতার বিষয়টি বোঝাতেই তার এই উক্তি। অভাব, দারিদ্র্য যাদের জীবনের নিত্যসহচর তাদের উপায় থাকে না অলসতার, কর্মবিমুখতার। এই বিষয়টিই এখানে অভিব্যপ্তিত।

৭। “এখন সকালবেলাই তো আবার পেটে আগুন লেগে গেছে।”-বক্তা কে? বক্তা কাকে কথাগুলো বলেছে? বক্তার কথার প্রেক্ষাপটটি আলোচনা করো। 1+1+3

বাংলা নাট্যসাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে আলোচ্য উক্তিটির বক্তা কারখানার শ্রমিক সতীশ।

■ বক্তা তার সহকর্মী জুড়োনকে আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

"আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে,
জমে ভ্রষ্টনীড় নগরে ও গ্রামে
দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিল,
প্রত্যেক নিরন্ন প্রাণে বয়ে আনে অনিবার্য মিল।"

দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ সময়কালে শ্রমিকের অসহায়তা ফুটে উঠেছে আলোচ্য উত্তিতে। চালের অভাবে তথা খাদ্যের অভাবে শ্রমিকশ্রেণির জীবনে ঘন কালো অন্ধকার, তীব্র ক্ষুধাই তাদের জীবনের অন্তিম সম্বল। খাদ্যের অভাবে সকালবেলা থেকেই তাদের জঠরে ক্ষুধার গনগনে আগুন জ্বলছে। এ ক্ষুধার তাড়না তাদের নিত্য সহচর। চালের লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে চাল মেলার নিশ্চয়তা নেই, তাই বুভুক্ষায় মরে সমাজের অধিকাংশ মানুষ। পেটে ভয়ানক খিদে নিয়ে শ্রমিক পারে না কারখানার কাজে যোগ দিতে। ক্ষুধার সর্বগ্রাসী জ্বালায় অস্থির শ্রমিক শ্রেণির জীবনের অসহায় ছবি এখানে প্রতিবিম্বিত। ক্ষুধার আগুন জ্বলে যাদের জঠরে তাদের সকালবেলাটাই ক্ষতবিক্ষত, দুর্ভিক্ষের স্রোতে ভাসমান সকল ক্ষুধার্ত প্রাণ। দুর্ভিক্ষপীড়িত সময়কাল দিশেহারা করেছে শ্রমিকসমাজকে, তাই নিরন্ন বীভৎস প্রাণের কোশে কোশে জীবনযন্ত্রণার নিবিড় কালো ছায়া। খাদ্যের অভাবে মানবসত্তার হাহাকারই এখানে প্রতিফলিত।

৮। “এখন সকালবেলাই তোমার পিন্ডি জোগাই কোথেকে বলতো।”-উক্তিটির প্রসঙ্গ লেখো। আলোচ্য উক্তিটির বক্তব্যবিষয় আলোচনা করো। 2+3

গণনাট্য আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে আলোচ্য কথাটি ক্ষিরি তার স্বামী সতীশকে বলেছে। দুর্ভিক্ষের সময়ে চালের অভাবে কারখানার শ্রমিক সতীশের বাড়িতে ক্ষুধার হাহাকার শোনা যায়। খিদে পেটে নিয়ে কাজে যেতে তার শরীর সায় দেয় না। স্ত্রী ক্ষিরিও অসহায় হয়ে পড়ে, ক্রোধান্বিত হয়। সে তার স্বামীকে জানায়, আগের দিনই নিজে হাতে করে দেড়-পো চাল ধার এনেছিল, আর তার মধ্যে নিজে অর্থাৎ সতীশই এক পো চাল খেয়ে ফেলেছে। অভাবের সংসারে অসহিষু হয়ে ওঠা সতীশের স্ত্রী এরপরই আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

■ পঞ্চাশের মন্বন্তরের উত্তাল পটভূমিতে দিকে দিকে হা-অন্ন রব। শ্রমিক পরিবারের কর্তা ক্ষুধার্ত অবস্থায়। কারখানায় কাজে যেতে চায় না। তার স্ত্রী ক্ষিরিও অভাবের আগুনে দক্ষ হতে হতে অসহিয়ু, ক্রোধান্ধ হয়ে পড়ে। চরম অভাবের, ক্ষুধার ধর্মই এই-স্বাভাবিক জীবনযাপন বিপন্ন বিষাক্ত হয়। ক্ষুধার্ত প্রাণের কোশে কোশে ভয়াবহ যন্ত্রণা। তারই অভিব্যপ্তি ক্ষিরির কথায় ফুটে উঠেছে। ক্ষুধার জ্বালায় দুঃস্বপ্নের দুর্ভাবনার কালো ছায়া পড়ে সংসারের পরিবেশে। সকালবেলাতেই স্বামীকে ভাত দিতে না পারার কারণেই তার কণ্ঠে বিজাতীয় পরুষ কথা উচ্চারিত হয়। পিত্তি জোগানোর কথাটি বিশেষ প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ক্ষুৎপিপাসায় অসহায় শ্রমিকের স্ত্রীর অসহিষ্ণু বাক্যে প্রকৃত অর্থেই দুর্ভিক্ষজর্জর সময়ের ছবি ফুটে উঠেছে। টলোমলো দুর্দিনে, থরোথরো আশঙ্কায় দিন কাটে মেহনতি মানুষের। তাদেরই প্রতিনিধি ক্ষিরি ও সতীশ। ক্ষিরির কথায়, প্রকৃত অর্থেই দুর্ভিক্ষের সংকট প্রতিধ্বনি তুলেছে আতঙ্কিত অন্দরমহলে।

৯। “মুখ সামলে কথা বলিস ক্ষিরি, এই বলে দিলাম। নইলে…..”-বক্তা কখন কথাগুলো বলেছিল? তারপর কী ঘটেছিল তা লেখো। 2+3

বাংলা নাটকের গণসংগ্রামের ঋত্বিক বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে আলোচ্য উক্তিটির বক্তা কারখানার শ্রমিক সতীশ। ক্ষিরির স্বামী কারখানার শ্রমিক সতীশ সকালবেলায় দুটো ভাত খেয়ে কারখানায় কাজে যেতে চায়। কিন্তু তাদের ঘরে চাল ছিল না, আগের দিন সতীশ ধার করে সামান্য কিছু চাল এনেছিল যার বেশির ভাগটাই সতীশ নিজে খেয়েছিল। অসহায় স্ত্রী অসহিষ্ণুভাবে জানিয়েছিল সকালবেলায় সতীশের ‘পিন্ডি’ জোগাড় করে দিতে পারবে না। একথা শুনে সতীশ প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়। ক্ষিরিও প্রবল হতাশায় ও গ্লানিতে তার পরনের কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই জানিয়েছিল। সতীশ তাকে একেবারেই সুখে রাখতে পারেনি বলে অভিযোগ জানিয়েছিল, এমনকি প্রতিবেশী কেলোর বাবার সামর্থ্যকে সতীশের ব্যর্থতার সঙ্গে তুলনীয় করেছিল। ঠিক তখনই সতীশ অন্ধ আক্রোশে কথাগুলো বলেছিল।

■ প্রবল আক্রোশে ক্রোধান্ধ হয়ে আলোচ্য কথাগুলো বলার পরই সতীশ তার স্ত্রী ক্ষিরিকে লাথি মেরেছিল। ক্ষিরি আর্তনাদ করে উঠেছিল-“ওরে বাপরে গেলাম গো, মেরে ফেললে গো…।” মায়ের আর্তনাদে তার মেয়ে ফুলকিও কেঁদে উঠেছিল। স্ত্রীর আর্তনাদ বা মেয়ের কান্নায় সতীশের হৃদয় কাঁপেনি। বরং আরও বিকট রাগে উত্তেজিত হয়ে ‘হারামজাদি’ সম্বোধন করে ক্ষিরির মুখের সাজা আরও ভালোভাবে দেওয়ার শাসানি দেয়। মা আর মেয়ের সমবেত চিৎকার শোনা যায়। অবশেষে ‘যা মরগে যা’ বলে ছিটের হাফহাতা জামা পরে কাঁধের উপর গামছা ফেলে দ্রুত পদবিক্ষেপে সেখান থেকে প্রস্থান করেছিল। অর্থপ্রতিকূলতার সমস্যার দিনলিপি মন্বন্তরের আকাল সময়ের ছবি এঁকে দেয়।

১০। “আবার যেগুলো চড়া দামে বাজারে ছাড়ছেন।”-বস্তা কে? বক্তা কাকে কথাগুলো বলেছে? বক্তার কথার পরিপ্রেক্ষিতটি আলোচনা করো। 1+1+3

নট, নাট্যকার, পরিচালক বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে আলোচ্য উক্তিটির বক্তা মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিনিধি হরেকৃষ্ণ।

■ বক্তা তার স্ত্রী মনোরমাকে উদ্দেশ করে কথাগুলো বলেছে।

■ হরেকৃষ্ণ ও মনোরমার মধ্যবিত্ত সংসার। দুর্ভিক্ষের সময়কালে চালের প্রকট সমস্যা তাদের পরিবারকেও উদ্‌দ্ব্যস্ত করে তুলেছে। চালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক উপকরণ চা, চিনি, তেল-ডালের সমস্যা। অফিসে যাওয়ার চাপে হরেকৃষ্ণ চালের লাইনে দাঁড়াতে পারে না। তাদের অফিস থেকে চাল ডাল দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানেও চূড়ান্ত অসততা ও দুর্নীতির কালো ছায়া। সেখানেও কালোবাজারির ছবি স্পষ্ট। বাবুদের নামে সস্তা দরে চাল ডাল এনে কর্তারা সেগুলো চড়া দামে বাজারে ছাড়ছে। অফিসের ম্যানেজার আর মোসাহেবরা প্রচুর পরিমাণে মুনাফা লুটছে চাল ডালের কালোবাজারি মারফত। পঞ্চাশের মন্বন্তরে কালোবাজারির অন্ধকার কীভাবে মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে সেই প্রেক্ষাপটেই বস্তার এই উক্তি। সমাজশত্রুরা গ্রামে নগরে ক্ষুধার্ত মানুষের হন্তারক হয়ে উঠেছে।

১১। “যে রক্ষক সেই হল গিয়ে ভক্ষক।”-কোন রচনার উক্তি? বক্তা কোন্ প্রসঙ্গে কথাগুলো বলেছে? উক্তিটির অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু আলোচনা করো। 1+2+2

গণনাট্য আন্দোলনের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব নট, নাট্যকার, পরিচালক বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটক থেকে আলোচ্য উক্তিটি গৃহীত হয়েছে।

■ আলোচ্য নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে মধ্যবিত্ত সংসারের ছবি ফুটে উঠেছে। হরেকৃষ্ণ বাবু ও তাঁর স্ত্রী মনোরমার সংসারেও চালের অভাব প্রকট। তাছাড়া নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় চা, চিনি নেই। চুলো থাকলেও কয়লার অভাব। হরেকৃয় বাবুর অফিস থেকে চাল ডাল পাওয়ার কথা থাকলেও তা পাওয়া যায়নি। কারণ অফিসের ম্যানেজার আর মোসাহেবরা সস্তা দামে চাল ডাল নিয়ে এসে চড়া দামে কালোবাজারি করছে। অফিসের কর্তাব্যক্তিরাই তো অন্যান্য কর্মীদের রক্ষাকর্তা কিন্তু তারাই চরমতম অন্যায় কাজে লিপ্ত থেকে শোষণযন্ত্রকে সচল রেখেছে। তারাই প্রচুর মুনাফা লুটছে কর্মীদের প্রাপ্য চাল ডাল চড়া দামে বিক্রি করে। কর্তাব্যক্তিদের এই কালোবাজারি প্রসঙ্গেই বস্তার এই উক্তি।

■ যুগে যুগে কালে কালে রক্ষকদের ভক্ষক হয়ে ওঠার কাহিনি সমাজসভ্যতাকে কলঙ্কিত করেছে। দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলায় রক্ষকরাই ভক্ষকের ভূমিকা নিয়েছে। চালের অভাব সর্বত্র, মানুষ মরছে ক্ষুধার তাড়নায় আর একশ্রেণির সুবিধাভোগী মানুষ কালোবাজারিতে মুনাফা লুটছে বেপরোয়াভাবে। হরেকৃষ্ণবাবুর অফিসের কর্তাব্যক্তি তথা ম্যানেজার মোসাহেবরা কর্মীদের জন্য সস্তায় চাল ডাল এনে তা চড়া দামে কালোবাজারি করছে। কর্তাব্যক্তিরাই অন্যান্য কর্মীদের রক্ষাকর্তা অথচ তারাই গুপ্তঘাতী শত্রুর মতো ভক্ষকের ভূমিকা নিয়েছে। তাদের নিষ্ঠুর হাত ছিনিয়ে নিয়েছে ক্ষুধাতুর মানুষের গ্রাস। ক্ষুধার্তের আছে কেবল বুকফাটা আর্তনাদ আর কর্তাব্যক্তিদের হিসাবের খাতা স্ফীততর হয়। কর্তাব্যক্তিরাই তাই লোভের শার্দুল-মন নিয়ে ক্ষুধার্ত কর্মীদের পৌঁছে দেয় হাহাকারের অন্তিমে।

১২। “না থাকে তো নেবেন না চাল। ও সব আইনের কথা বলবেন আদালতে গিয়ে।” বস্তা কে? বক্তা কাকে, কখন কথাগুলো বলেছিল? এখানে বক্তার চরিত্রের কোন্ দিকটি ফুটে উঠেছে? 1+2+2

প্রবাদপ্রতিম নাট্যব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে আলোচ্য উক্তিটির বস্তা সিভিক গার্ড।

■ আলোচ্য নাটকের পঞ্চম দৃশ্যে দেখা যায়, বহু ক্ষুধার্ত মানুষ চালের জন্য লাইনে অপেক্ষমান। হট্টগোল চলছে লাইনে, কলমুখর পরিবেশ। দোকানের দরজা খোলার পর দেখা যায়, একজন সিভিক গার্ড লাইনের সামনে দিয়ে ঘুরে যায়। দোকানের সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করে ‘খুচরা নেই’। সিভিক গার্ড লাইনের সকলকেই হুমকির সুরে খুচরো না দিতে পারার অক্ষমতা জানায়। লাইনে দাঁড়ানো প্রথম পুরুষটিকে সিভিক গার্ড টাকা ভাঙিয়ে নিয়ে আসার কথা বলে খুব দাপটের সঙ্গে ঘোষণা করে-“ও টাকা ফাকার চেণ্ড দেওয়া চলবে না।” প্রথমপুরুষ জানতে চেয়েছিল, সকলের কাছেই খুচরো থাকবে এমন কথা কোন্ আইনে লেখা আছে। তখনই অতি উদ্ধত ভঙ্গিতে সিভিক গার্ড আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

■ সামান্যতম সরকারি ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে মানুষ কেমন উদ্ধত দুর্বিনীত হয়ে পড়ে তারই নগ্ন বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় সিভিক গার্ডের সংলাপে। ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিলে চালের জন্য বুকভরা আর্তনাদ অথচ সিভিক গার্ডের আচরণে বিন্দুমাত্র সহানুভূতির পরিচয় নেই। সমানুভূতির কোনো প্রশ্নই নেই। সিভিক গার্ডটি যেন রাজনৈতিক অত্যাচারী চরিত্র হয়ে উঠেছে। তার সব সংলাপেই চূড়ান্ত অভব্যতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। বিবেকহীন অন্যায়-আচরণের প্রতিভূ হয়ে উঠেছে চরিত্রটিতে। মন্বন্তরের থাবা যখন সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপদের মুখে দাঁড় করিয়েছে তখন সিভিক গার্ড ঔদ্ধত্য, পাপ আর অনাচারের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

১৩। “সেই পাঁচ ছ ক্রোশ দূর থেকে এসেছে বেচারি দুটো চলের জন্যে, উনি দিলেন তাকে বের করে।”-উক্তিটির প্রসঙ্গ লেখো। এখানে যে পরিস্থিতি ফুটে উঠেছে তার বর্ণনা দাও। 2+3

প্রথিতযশা নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে চালের লাইনে দাঁড়ানো বুভুক্ষু মানুষের প্রতিনিধি ৩য় পুরুষ আলোচ্য কথাটি বলেছিল। চরম দুর্বিনীত সিভিক গার্ড চালের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা দুঃস্থ চেহারার ৪র্থ পুরুষটির গালে চপেটাঘাত করেছিল। সিভিক গার্ডের অভিযোগ ছিল ৪র্থ পুরুষটি বারবার চালের লাইনে ঢুকে অনেক বেশি পরিমাণে চাল সংগ্রহ করছে। বাস্তবিক ঘটনাটি সেরকম নয়। সমবেত অনেকের মধ্যেই প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়। একজন মুসলমান বাস্তি ও ৩য় পুরুষ জোরালো প্রতিবাদ জানায়। ৩য় পুরুষের কথার প্রতিবাদে সিভিক গার্ড হুমকি দিয়ে বলেছিল, “এয়োপ। মুখ সামলে কথা বলো বলছি।” বুভুক্ষু ৪র্থ পুরুষ অতি বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছিল দুটো চলের জন্য সকাল থেকে সে দাঁড়িয়ে আছে। এরপরই ৩য় পুরুষ আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

■ আলোচ্য আশে যথার্থভাবেই নাট্যকারের অন্তরের প্রতিবাদের শিখা জ্বলে উঠেছিল অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে। মন্বন্তরের বিপন্নতায় মানুষ দিশেহারা, পেটে তাদের জ্বলছে খিদের আগুন, চালের সারিতে তাই তারা অপেক্ষমান সকাল থেকে। দূরদুরান্ত থেকে আসা ক্ষুধার্ত মানুষ চরম ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করে দুমুঠো চালের জন্য। যেখানে সরকারি সামান্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত সিভিক গার্ড চরমতম বেহিসেবি আচরণের বহিঃপ্রকাশ দেখায়। ক্ষুধার্ত মানুষকে সে চপেটাঘাত করে। এই আঘাত কেবল কোনো ব্যক্তিকে আঘাত নয়, এই আঘাত প্রকৃত অর্থে বুভুক্ষু জনসাধারণের জঠরে প্রবলতম আঘাত। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ সময়ে ঘরে ঘরে হা-অন্ন চিৎকার, শিশু বৃন্দদের মুখে অন্ন জোটে না, সব পরিবারেই হাহাকার-

"...তবুও ভাঁড়ার শূন্যই থাকে, 
থাকে বাড়ন্ত ঘরে চাল 
বাচ্চা ছেলেরা উপবাস করে
এমনি করেই কাটে কাল।"

মন্বন্তর কবলিত সময়কালে কালোবাজারি, সরকারি ক্ষমতাপ্রাপ্ত পাহারাদারদের অভব্যতা, এবং সাধারণ মানুষের সংকট এখানে ফুটে উঠেছে।

১৪। “তিনটি প্রাণী দুদিন অনাহারে আছি বাবা, দয়া কর।”-বক্তা কে এবং কখন কথাগুলো বলেছিল? বক্তার উত্তির মধ্য দিয়ে কোন্ সত্য ফুটে উঠেছে? 2+3

বাংলা নাটকের ইতিহাসের সমাজবিপ্লবী, প্রতিবাদী নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে আলোচ্য উক্তিটির বস্তা চালের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা ৪র্থ পুরুষ। উদ্ধত, চরম অবিনয়ী সিভিক গার্ড ৪র্থ পুরুষকে বারবার চালের লাইনে ঢুকে চাল নেওয়ার ব্যাপারে অভিযুক্ত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ৪র্থ পুরুষ চরিত্রটি সেই অন্যায় কাজ করেনি। ৩য় পুরুষ সিভিক গার্ডকে অনুযোগ জানিয়েছিল যে, ৪র্থ পুরুষ পাঁচ-ছয় ক্রোশ দূর থেকে চালের জন্য এসেছে, তাকে বের করে দেওয়া সমীচীন হয়নি। ৩য় পুরুষকে সিভিক গার্ড উদ্ধত কণ্ঠে বেসুরো ভঙ্গিতে জানিয়েছিল। দরদ থাকলে ৩য় ব্যপ্তি যেন ৪র্থ পুরুষকে নিজের চালটুকু দিয়ে দেয়। তখনই অতি অনুনয়ের সুরে ৪র্থ পুরুষ আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

■ বক্তার উত্তির মধ্য দিয়ে মন্বন্তর কবলিত হাহাকারগ্রস্ত নিরন্ন মানুষের করুণ আর্তনাদ ফুটে উঠেছে। চালের নিদারুণ অভাবে তাদের পরিবারের তিনটি প্রাণী দুদিন পুরোপুরি অনাহারে আছে। তাদের এই অসহায় অবস্থার উৎস হল দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর। আকালের কালে নিরন্ন মানুষের মিছিল সর্বত্র, পরিত্রাণের পথ নেই, বিবেকহীন মুনাফালোভীরা আবার কালোবাজারিতে প্রচুর অর্থ রোজগার করে চলেছে। কারও নিষ্ঠুর হাতে চড়া দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে সস্তার চাল-ডাল, আবার কোথাও না খেতে পেয়ে মরছে অসহায় মানুষ। চাহিদার জটিল আবর্তে সাধারণ মানুষের জীবনে কোথা থেকে এসেছে জড় অন্ধকার। ঘরে ঘরে নিরন্ন হাহাকারগ্রস্ত মানুষ, দুর্ভিক্ষ তাদের দিয়েছে ক্ষুধার যাতনা, তাদের জঠরে আগুন, যে আগুন পুড়িয়ে দিচ্ছে জীবনকে। প্রাণের কোলাহল নেই, কেবলই রিক্ত মানুষের আর্তচিৎকার। নগরে প্রান্তরে ক্ষুধার অন্তিম পিপাসা, সামনে যেন মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে রক্তলোলুপ চাহনিতে।

১৫। “আগুন। আগুন জ্বলছে আমাদের পেটে।”-উক্তিটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করো। আলোচ্য উত্তিতে সমকালীন যে পরিস্থিতি ফুটে উঠেছে তার পরিচয় দাও। 2+3

নট, নাট্যকার, পরিচালক বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে আলোচ্য উক্তিটির বস্তা চালের সারিতে দাঁড়ানো জনৈক যুবক। বুভুক্ষু মানুষ চালের সারিতে অপেক্ষমান। সামান্য সরকারি ক্ষমতাপ্রাপ্ত দুর্বিনীত সিভিক গার্ড ৩য় পুরুষ, চতুর্থ পুরুষ সকলের সলোই চূড়ান্ত অসভ্য ব্যবহার করে। তিনদিন না খেতে পাওয়া ৪র্থ পুরুষের সঙ্গে সিভিক গার্ডের চূড়ান্ত তর্কাতর্কি হয়, সিভিক গার্ড ৪র্থ পুরুষকে ঘুসি মারতে উদ্যত হয়। জনৈক যুবক হন্তদন্ত হয়ে আসে। হঠাৎ গোলমালটা থেমে যায়। তখনই যুবকটি আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

■ আলোচ্য উত্তিতে সমকালীন সংকটময় চূড়ান্ত দূরবস্থার চিত্র উদ্ভাসিত হয়েছে। নিরন্ন মানুষের পেটে জ্বলছে খিদের আগুন, কোনো ব্যক্তি বিশেষের নয়, এ আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়েছে জন-অরণ্যে। দুঃস্বপ্নের ভয়াবহ দিনে পুড়ে যাচ্ছে মানুষের অস্তিত্ব। সবজিবিক্রেতা, মধ্যবিত্ত পরিবার, শ্রমিক পরিবার, অন্য প্রদেশের মানুষ সকলেই খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়। তাদের জীবনের সারসত্য হয়ে উঠেছে একমুঠো চাল। জীবনে বাঁচার জন্য, প্রাণে টিকে থাকার জন্য অসহায় মানুষগুলো ক্ষুধিত পেটে ঝুঁকে ঝুঁকে চালের সারিতে জীবনের ইশারার সন্ধান করছে। চাল ছাড়া বাঁচবে না তারা, তাই ভালের জন্যই উদগ্র বাসনা তাদের। ঝড়ে ভেঙে যাওয়া জীবনের পটভূমিতে বিদাস্ত মন্বন্তর কবলিত মানুষ। তাই আর কোনো জাগতিক বহ্নিশিখা নয়, জঠরে কেবলই ক্ষুধার আগুন তাদের। সমাগত দিনও তাই বড়ো দুঃস্বপ্নের তাদের কাছে।

“আকাশে সর্বনাশের রং ধরেছে। কালো ডানা মেলে উড়ে আসছে দুঃস্বপ্নের ভবিষ্যৎ।”

১৬। “বাব্বা। লুঙ্গি, টিকি, পৈতে সব একাকার হয়ে গেছে।”-বক্তা কোন প্রসঙ্গে কথাগুলো বলেছে? উক্তিটির অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করো। 2+3

বাংলা নাট্যসাহিত্যের খ্যাতনামা নট, নাট্যকার, পরিচালক বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকের পঞ্চম দৃশ্যে দেখা যায়, আকালের দিনে চালের সারিতে অপেক্ষমান বহু ক্ষুধার্ত মানুষ। চলমান সারি সামলাচ্ছে সিভিক গার্ড তার ভঙ্গিমায়। হাহাকারগ্রস্ত মানুষ চাল নিয়ে যে যার মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। লুঙ্গিপরা জনৈক মুসলমান যুবক চাল নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দোকানিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, সেদিন চাল ঠিকঠাক আছে কিনা, কেউ বাদ যাবে না তো? মুসলমান যুবকের এই মানবিক প্রশ্নের উত্তরেই চালদোকানি গর্জে উঠে আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

■ জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই সমানভাবে উদ্‌দ্ব্যস্ত করেছে মন্বন্তর। ক্ষুধার অনুভূতিতে জাতপাত, ধর্ম, বর্ণে পার্থক্য থাকে না। নিরম্নন্ন মানুষ সকলেই এমন যন্ত্রণার শরিক হয়। রেশন দোকানের সামনে চালের জন্য প্রতীক্ষারত মানুষগুলো সবাই দুর্ভিক্ষের হাহাকারের শিকার। ক্ষুধা সকলকেই চরম সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেখানে সমাজ সম্পর্কের নানা ব্যবধান থাকে না, সব ক্ষুধার্ত মানুষের একটাই চাহিদা তা হল চাল। জঠরের আগুন সবার জন্যই একই যন্ত্রণার তীব্রতা বহন করে। তাই সকলেই একই ব্যথা-বেদনা-গ্লানির সরণির পথিক হয়। লুঙ্গি, টিকি, পৈতে, চুপির কোনো ব্যবধান থাকে না, সব মিলেমিশে সমানুভূতির সমতলে অবস্থান করে। ক্ষুধার জ্বালা সকলকে একাসনে নিয়ে আসে, ক্ষুধার তাড়না সব ধর্ম, জাতি, বর্ণকে একতার সূত্রে গ্রথিত করে। এই চরম সত্যই এখানে উদ্ভাসিত। কবির কথায়-

"একদা দুর্ভিক্ষ এল
ক্ষুধার সীমাহীন তাড়নায়
পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি সবাই দাঁড়ালে একই লাইনে
ইতর-ভদ্র, হিন্দু আর মুসলমান
একই বাতাসে নিলে নিঃশ্বাস।"

১৭। “এখন বাঁচতে হবে। বাঁচতে হলে মিলেমিশে থাকতে হবে ব্যাস্।”-কে, কাকে কথাগুলো বলেছিল? উক্তিটির যথার্থতা নিজের ভাষায় আলোচনা করো। 2+3

গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে দুর্ভিক্ষের সময়কালে চালের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা ৩য় পুরুষ চতুর্থ পুরুষকে আলোচ্য কথাগুলো বলেছিল।

■ আলোচ্য নাটকের পঞ্চম দৃশ্যে দেখা যায় দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত, শ্রমিক, ভিন রাজ্যের মানুষ সকলেই আকালের সময়ে চালের সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ক্ষুধার্ত মানুষ অপেক্ষারত একমুঠো চালের জন্য। ক্ষুধার তাড়না সকলকে সমানুভূতির সমতলে দাঁড় করিয়েছে। সকলের চেতনায় বেঁচে থাকার করুণ আর্তি। তাই লুঙ্গি, টিকি, পৈতে, টুপি সবাই একাকার হয়ে গিয়েছে। উপবাসী মানুষের জঠরে প্রবল ক্ষুধার জ্বালা। তাই দুর্ভিক্ষের হোতে সকলে একক সংঘবন্ধ প্রাণ। জীবনে বাঁচার সংকল্পস্রোতে সকলেই একজোট, একপ্রানের স্তবগান রচনা করে। দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিলে তাই প্রত্যেকটি নিরন্ন প্রাণে এক অদ্ভুত অনিবার্য মিল দেখা যায়। মন্বন্তরের টলোমলো দুঃসময়ে তাই পদানত জাতি-ধর্ম-বর্ণের মেকি অহংকার। সেকারণেই দুর্ভিক্ষজর্জর জনতার হৃদয়ে মিলেমিশে বেঁচে থাকার অবিকল্প প্রয়াস লক্ষ করা যায়। ৩য় পুরুষের বক্তব্যে বাঁচতে হলে মিলেমিশে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টাই প্রতিফলিত। ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু কালাপাহাড়, সেই মৃত্যুরূপী কালাপাহাড়কে পরাহত করার জন্যই সকলের চৈতন্যে একতার প্রতিজ্ঞা তরঙ্গিত হোক। এই বস্তুবাই উচ্চারিত এখানে। মন্বন্তর নিঃশব্দ ঘাতক, সেই দুর্দিনে মিলেমিশে সকলকেই বাঁচতে হবে, তবেই সংকটের অবসান ঘটবে।

১৮। আগুন’ নাটক অবলম্বনে সিভিক গার্ড চরিত্রটির পরিচয় দাও।

বাংলা নাট্যসাহিত্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে সিভিক গার্ড চরিত্রটি আমরা দেখতে পাই নাটকের পঞ্চম তথা শেষ দৃশ্যে। চরিত্রটির বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হল।

রেশন দোকানের সামনে দীর্ঘ লাইন, ক্ষুধার্ত মানুষ অপেক্ষমান একমুঠো চালের জন্য। দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, ভিন্ন প্রদেশের মানুষ সবাই অপেক্ষা করছে দীর্ঘক্ষণ। সিভিক গার্ড লাইনের সামনে দিয়ে ঘুরে যায়, তারপর উদ্ধত ভঙ্গিতে বলে “এই সব টিকিট আছে তো? নইলে কিন্তু চাল মিলবে না।”-এই আচরণ ও বাক্যপ্রয়োগে তার দুর্বিনীত রূপটি খুব সহজেই ধরা পড়েছে।

সরকারি রেশন দোকানের দরজার পাল্লায় লটকানো বিজ্ঞাপন-‘খুচরা নাই।’ সিভিক গার্ড লাইনে দাঁড়ানো ১ম পুরুষকে উদ্ধত কণ্ঠে জানিয়েছিল যে, খুচরা না থাকলে চাল না নিতে। মন্বন্তরের সময়ে সরকারি সামান্য ক্ষমতাপুষ্ট সিভিক গার্ডের উত্তিতে চরমতম অমানবিকতার ছবিই পাওয়া যায়।

সিভিক গার্ড একজন ক্ষুধার্ত দুঃসহ মানুষকে চপেটাঘাত করেছিল। অনাহারে দিন কাটানো মানুষকে প্রহার করা মধ্যযুগীয় বর্বরতার বহিঃপ্রকাশ। যতটুকু ক্ষমতা তার চাইতে অনেক বেশি দেখানোর প্রয়াসই সিভিক গার্ডকে প্ররোচিত করেছিল চপেটাঘাত করতে। নিষ্ঠুরতম মনোভাবের অভিব্যক্তি এটি।

সিভিক গার্ডের সংলাপে কেবলই অভব্য কথার ছয়লাপ। নিরন্ন মানুষের প্রতি তার উক্তি-“থাক, তোকে আর দালালি করতে হবে না। যা ভাগ ভাগ।” এই ধরনের কথাবার্তায় বিবেকহীন, অমার্জিত চরিত্রবৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়। এককথায় বলা যায়, ‘আগুন’ নাটকের সিভিকু গার্ড প্রকৃতপক্ষে দুর্বিনীত, উদ্ধত, বেপরোয়া বিবেকহীন, অমানবিক আচরণেরই প্রতীক।

১৯। ‘অগুন’ নাটক প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, দুর্গতির নাটক-আলোচনা করো।

নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকটি যথার্থভাবেই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও দুর্গতির নাটক। নাট্যকারের অধিকাংশ নাটকের পটভূমি ছিল বাংলার ও বাঙালির চরম দুর্দশা, দুঃখ ও লাঞ্ছনা-বঞ্চনার কাহিনি। মন্বন্তর কবলিত সময়ে প্রাণের অপচয়ের নিষ্করুণ বৃত্তান্ত জাতির জীবনে দূরপনেয় কলঙ্কের কাহিনি নির্মাণ করেছে-আর সেই কলঙ্কজনক দুঃখময় জীবনের কাহিনি বর্ণনার ঋত্বিক হলেন বিজন ভট্টাচার্য। নাট্যকার জন-অরণ্যে প্রবেশ করে সাধারণ মানুষের দুঃখ, গ্লানিকে বাস্তবভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। নাটক প্রকৃতপক্ষে বাস্তবজীবনের অভিনেয় শিল্পরূপ- “Drama is the representation of life in terms of theatre”, বিজন ভট্টাচার্যের নাটকেই এ সত্য বারেবারে দেখা দিয়েছে। ‘আগুন’ নাটক রচনাকালে নাট্যকারের অন্তরে প্রতিবাদের শিখা জ্বলে উঠেছিল। তার সঙ্গে ছিল মানবপ্রেম। মন্বন্তর কবলিত সময়ে মানুষের হাহাকার আগুন নাটকের মূল বক্তব্য।

নাট্যকার বহি-দীপ্ত কণ্ঠস্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ক্ষুধার্ত-পীড়িত জনগণের জন্য আর তারই সঙ্গে সঙ্গে জনগণতান্ত্রিক চেতনার সঞ্চার করেছেন মিলেমিশে ঐক্যবন্ধভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণার মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে। নাটকের প্রথম চারটি দৃশ্যে সবজিবিক্রেতা পরিবার, কৃষকের পরিবার, শ্রমিক পরিবার, মধ্যবিত্ত পরিবারে চালের অভাবের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। শেষ তথা পন্যম দৃশ্যে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, ভিনপ্রদেশী সবাই চালের সারিতে দাঁড়িয়ে থেকেছে ক্ষুধা নিবারণের তাড়নায়। ক্ষুধার জ্বালা সকলকে একাসনে বসিয়েছে। সবারই জঠরে ক্ষুধার আগুন। এই ছবি সমকালীন সময়ের ভয়াবহ দুর্গতিরই ছবি। মানুষ খাদ্যের সারিতে অপেক্ষমান আর সরকারি সামান্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত সিভিক গার্ডের অমানবীয় অভব্যতা সমকালীন সময়ের জীবন্ত দলিল। লুঙ্গিা, টিকি, পৈতে, টুপি অর্থাৎ জাতিধর্মবর্ণের ভেদাভেদ নেই ক্ষুধার আগুনের সামনে। ‘বাঁচতে হলে মিলেমিশে বাঁচতে হবে’-এই গভীর বোধ একতার সোপান নির্মাণ করেছে। নাট্যকার জনজীবনের গভীরে প্রবেশ করে ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকারের চিত্র অঙ্কন করেছেন দৃপ্ত কণ্ঠে। সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন এবং অবশেষে মানুষের ঐক্যবন্ধতার আবহ নির্মাণ করেছেন। এভাবেই ‘আগুন’ হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও দুর্গতির নাটক।

আরও পড়ুন – শিক্ষাশ্রয়ী মনোবিজ্ঞানের অর্থ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment