আইনের অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো

আইনের অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো

আইনের অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো
আইনের অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো

আইনের সংজ্ঞা

আভিধানিক অর্থে আইন বলতে বোঝায়, নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা আরোপিত আচরণবিধি। অন্য ভাষায় বলা যায়, মানুষকে সমাজে বসবাস করতে হলে বেশ কিছু নিয়মকানুন মান্য করে চলতে হয়। ওই সকল নিয়মকানুনকে একত্রে আইন বলা হয়। তবে ব্যাপক ও সংকীর্ণ উভয় অর্থেই আইন শব্দটি প্রয়োগ করা যায়।

(1) ব্যাপক অর্থ

ব্যাপক অর্থে আইন বলতে বোঝায়, সামাজিক আইন, নৈতিক বিধিসমূহ, ধর্মীয় আইন ও প্রাকৃতিক নিয়মকানুনকে। সামাজিক জীব হিসেবে সুন্দর জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে মানুষ যেসকল নিয়মকানুন মান্য করে চলে তথা যেসকল সামাজিক রীতিনীতি ও চিরাচরিত প্রথা মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন তাকে সামাজিক আইন বলে। আইনের ব্যাপক অর্থের আলোচনায় ম্যাকাইভার (Maclver)-এর উক্তি ‘রাষ্ট্র হল আইনের স্রষ্টা ও সৃষ্টি।’ (“The State is both the child and parent of law.”)।

আবার, সমাজজীবনে ন্যায়-অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত নিয়মকানুন নৈতিক বিধি নামে পরিচিত। অর্থাৎ, সমাজজীবনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের আচার-ব্যবহারের সঙ্গে সামাজিক উদ্দেশ্যের সমন্বয়সাধনের প্রয়োজনে যে নিয়মগুলি গড়ে ওঠে, তাকেই নৈতিক বিধি বলা হয়। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন ঘটনাবলির যে কার্যকারণ সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়, সেগুলির পশ্চাতে বিবিধ নিয়ম থাকে। এই সকল নিয়মকানুনকে প্রাকৃতিক আইন বলা হয়। এ ছাড়া বিশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থার হাত থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রগুলিতে যে বিধান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলিকে ধর্মীয় বিধি বলে চিহ্নিত করা হয়।

(2) সংকীর্ণ অর্থ

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ‘আইন’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে প্রযুক্ত হয় না, বরং সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। সংকীর্ণ অর্থে আইন বলতে মানুষের রাজনৈতিক কার্যকলাপ, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় আইন (National Law)-কে বোঝায়। রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা রাষ্ট্র মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণকে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। রাষ্ট্রীয় আইন যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। এর পশ্চাতে কোনোরূপ ঐশ্বরিক অনুমোদন থাকে না এবং রাষ্ট্রীয় আইন কেবলমাত্র সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়।

  • আইন সম্পর্কে বিভিন্ন তাত্ত্বিকগণ প্রদত্ত সংজ্ঞা: আইনের সংজ্ঞা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। জন অস্টিন (John Austin)-এর মতে, “আইন হল সার্বভৌমের আদেশ” (“Law is the command of sovereign.”)। তিনি আরও বলেন, আইন হল নিম্নতনের প্রতি ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের আদেশমাত্র [“It (law) is the command of the Superior to an inferior.] হল্যান্ড (Holland)-এর মতে, “আইন হল সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রযুক্ত সাধারণ নিয়মকানুন, যার দ্বারা বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়” (“A Law is a general rule of external behaviour enforced by a sovereign political authority.”)। টমাস হিল গ্রিন (TH Green) আইনকে অধিকার ও কর্তব্যের এমন একটি ব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন, যেটিকে রাষ্ট্র কার্যকর করে (“The system of right and duties.”) I হেনরি মেইন (Henry Maine), স্যাভিনি (Savigny), মেইটল্যান্ড (Maitland), ক্লার্ক (Clerk) প্রমুখ ঐতিহাসিক মতবাদে বিশ্বাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ আবার উক্ত সংজ্ঞাগুলি গ্রহণে রাজি ছিলেন না।

হেনরি মেইন-এর মতে, সমাজে প্রচলিত সকল আইনের উৎস সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ নয়, বরং প্রতিটি দেশে দীর্ঘসময় ধরে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতিগুলি ধীরে ধীরে আইনি মর্যাদা লাভ করে, আবার স্যাভিনি-র মতে, রাষ্ট্রের প্রধান কাজ আইনের সারমর্ম উপলব্ধি করা ও তার বাস্তবায়ন করা, আইন প্রণয়ন করা নয়। তাই সব আইনকে সার্বভৌম শক্তির আদেশ বলে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত নয়। এঁদের মতে, সাধারণের সম্মতি এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব উভয় মিলে আইনের সৃষ্টি করে, একমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব নয়।

আবার, দ্যুগুই (Duguit), ব্র্যাবে (Krabbe), রসকো পাউন্ড (Roscoe Pound) প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, নানারকম সামাজিক কারণ ও প্রভাবের ফলেই আইনের সৃষ্টি হয়। এঁদের মতে, আইন সমাজের কল্যাণসাধন করে বলেই মানুষ তা মেনে চলে। অর্থাৎ এঁদের কাছে আইনের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে বা এর উৎস কী সেই অপেক্ষা, আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী তা অধিক গুরুত্ব পেয়েছে।

আইন সংক্রান্ত উপরোক্ত পরস্পরবিরোধী মতবাদগুলির সমন্বয়সাধন করে মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) আইনের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, আইন হল মানুষের স্থায়ী আচার-ব্যবহার ও চিন্তার সেই অংশ, যা রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত বিধিতে পরিণত হয়েছে এবং যার পিছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সুস্পষ্ট সমর্থন আছে (“…that portion of the established habit and thought of mankind which has gained distinct and formal recognition in the shape of uniform rules backed by the authority and power of the government.”)। বিচারপতি হোমস্ (Holmes) মনে করেন যে, সামাজিক ঐক্যের স্বার্থে মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী কতকগুলি নিয়মই হল আইন।

অপরদিকে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্কার (Barker)-এর অভিমত হল যে, আইন শুধুমাত্র রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত, ঘোষিত এবং প্রযুক্ত হলেই চলবে না, তাকে ন্যায়সম্মত ও যুক্তিসংগত হতে হবে। তাঁর মতে, আদর্শ আইনের দুটি উপাদান- বৈধতা এবং নৈতিক মূল্য। বৈধতা বলতে বোঝায়, আইনটি রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত, ঘোষিত এবং প্রযুক্ত; অন্যদিকে, নৈতিক মূল্যের অর্থ হল আইনটি ন্যায়বোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে বার্কার স্বীকার করেছেন যে, আইন শুধুমাত্র বৈধ হলেই সকলে তা মানতে বাধ্য। অধ্যাপক গেটেল (Gettel) বলেছেন যে, “যে সকল নিয়ম রাষ্ট্র সৃষ্টি, স্বীকার ও বলবৎ করে সেইগুলিই আইনে পরিণত হয়।”

(3) মার্কসীয় সংজ্ঞা

মার্কসবাদীরা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আইনকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। মার্কসবাদীদের দৃষ্টিতে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের স্বার্থে ও প্রয়োজনেই আইনের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের মতে, আর্থিক ব্যবস্থার বিন্যাস ও বণ্টনের উপর আইনের চরিত্র নির্ভরশীল।

মার্কস (Marx) ও এঙ্গেলস (Engles)- এর মতে, শাসকশ্রেণি রাষ্ট্রের মাধ্যমে কেবল তাদের নিজেদের ক্ষমতাকেই প্রতিষ্ঠা করে না, নিজেদের ইচ্ছাকেও আইনের মাধ্যমে সর্বজনীনের ইচ্ছা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। তাই মার্কসবাদী ভিশিঙ্কি (Vyshinsky)-র মতে, আইন বলতে সেই সমস্ত আচরণবিধিকে বোঝায়, যার মাধ্যমে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণির ইচ্ছা প্রকাশ লাভ করে। বিধিবদ্ধ আইন, আদেশ, অধ্যাদেশ এবং রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত বা অনুমোদিত রীতিনীতি ও প্রথাগুলিতে এই আচরণবিধিই মূর্ত হয়ে ওঠে।

অধ্যাপক ল্যাস্কি (Laski)-র মতে, রাষ্ট্রের লক্ষ্য হল সমাজে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিসম্পর্ক বজায় রাখা। রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে এই নির্দিষ্ট শ্রেণিসম্পর্ক বজায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়। রাষ্ট্রীয় আইন হল এক ধরনের মুখোশ, যার পিছনে ধনী শ্রেণি রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সুবিধা ভোগ করে। এর ফলে সমাজে শ্রেণিবৈষম্যের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, ল্যাস্কি আইনকে সমাজের ধনী শ্রেণির স্বার্থ ও সুবিধারক্ষাকারী নিয়ম বলে চিহ্নিত করেছিলেন।

আইনের প্রকৃতি

আইনের সংজ্ঞার ন্যায় আইনের প্রকৃতি নিয়েও নানা মতপার্থক্য বিদ্যমান। তবে, আইন সম্পর্কিত কিছু বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। যথা-

(1) ভাববাদী দার্শনিকদের অভিমত

ভাববাদী রাষ্ট্রদার্শনিকরা আইনকে বাস্তবানুগভাবে বিশ্লেষণ না করে নৈতিকতা ও আদর্শের মাপকাঠিতে বিশ্লেষণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। এ প্রসঙ্গে গ্রিক দার্শনিকগণদের ‘কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন-অ্যারিস্টট্ল (Aristotle)-এর মতে, আইন হল যুক্তিনির্ভর (Expression of Reason) I এ কারণে আইনই একমাত্র সমাজের সর্বময় কল্যাণসাধন করতে পারে। আবার, গ্রিসের স্টোয়িক দার্শনিকদের মতে ‘প্রাকৃতিক আইন’ (Natural law) হল সর্বোচ্চ আইন, যা রাষ্ট্রের আইনেরও ঊর্ধ্বে অবস্থিত।

এই প্রাকৃতিক আইন বিশুদ্ধ যুক্তি বা Pure Reason-এর ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। আবার, জার্মান দার্শনিক হেগেল (Hegel)-এর মতে, রাষ্ট্রের আইন নৈর্ব্যক্তিক এবং আইন হল সমাজের প্রজ্ঞা ও সর্বোচ্চ নীতির সম্মিলিত অভিব্যক্তি। আধুনিককালে অধ্যাপক জোসেফ কোলার, আইনকে বাস্তব দৃষ্টিতে বিচার- বিশ্লেষণের বদলে আদর্শের প্রকাশ হিসেবে বর্ণনা করতে আগ্রহী। তাঁর মতে, আইনের বাস্তব বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি তার আদর্শগত দিকটিকেও যথাযোগ্য গুরুত্ব দিতে হবে। আইন হল সংস্কৃতির সৃষ্টি ও সংস্কৃতির উন্নতিসাধনের উপায়।

(2) বিশ্লেষণবাদী তাত্ত্বিকদের অভিমত

হবস (Hobbes), বোদাঁ (Bodin), বেন্থাম (Bentham), অস্টিন, হল্যান্ড-এর মতো বিশ্লেষণবাদী তাত্ত্বিকদের মতে, সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ হল আইনের একমাত্র উৎস। সার্বভৌমের নির্দেশই হল আইন। শুধু তাই নয়, আইন যেহেতু সার্বভৌম শক্তির আদেশ সেই কারণে রাষ্ট্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আইনকে প্রযুক্ত করতে পারে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘন করলে ব্যক্তিকে যথোচিত শাস্তি পেতে হয়। রাষ্ট্রীয় আইনের পশ্চাতে এইরূপ বলপ্রয়োগ শক্তি (Coercive Force)-র উপস্থিতি থাকার জন্যই সমাজস্থ ব্যক্তিরা আইন মান্য করে চলে।

ফরাসি দার্শনিক বোদাঁ আইনকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নির্দেশ বলে অভিহিত করেন (‘Command of the human superior’)। ব্রিটিশ দার্শনিক হক্স সার্বভৌম শক্তির অধিকারী রাজার আদেশকে আইন বলে বর্ণনা করেছেন। বেশ্বাম-এর অভিমত ছিল, সার্বভৌম কর্তৃত্বের আদেশই হল আইন। এই আইনের প্রতি স্বাভাবিক আনুগত্য দেখানো জনগণের কর্তব্য। ব্রিটিশ আইনবিদ অস্টিন-এর মতে, আইন হল সার্বভৌম শক্তির আদেশ, যার সঙ্গে নৈতিক সূত্র অথবা প্রথার কোনো সম্পর্ক নেই।

(3) ঐতিহাসিক অভিমত

হেনরি মেইন, পোলক (Pollock), মেইটল্যান্ড, স্যাভিনি, সিজউইক (Sidgwick) প্রমুখরা হলেন ঐতিহাসিক মতবাদের প্রবক্তা। ঐতিহাসিক মতবাদের প্রবক্তারা আইননির্ভর সংজ্ঞার তীব্র বিরোধী এবং তারা রাষ্ট্রীয় আইনকে ইতিহাসের ফল বলে মনে করেন। এই তাত্ত্বিকদের মতে, কেবল সার্বভৌমের আদেশই আইন নয়। সমাজে দীর্ঘ প্রচলিত বিভিন্ন রীতিনীতি, প্রথার অস্তিত্ব থাকে, যেগুলির প্রভাব ও মান্যতা রাষ্ট্রীয় আইনের সমরূপ হয় এবং কালক্রমে আইনি মর্যাদা লাভ করে। তাঁরা আরও বলেন, মানুষ শাস্তি বা বলপ্রয়োগের ভয়ে নয়, বরং আইনের গুরুত্ব অনুভব করেই সেটি মান্য করে চলে।

স্যাভিনি-র মতে, আইন সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের কাজ নয়। আইনের প্রয়োগ করা হল রাষ্ট্রের প্রকৃত কাজ। এভাবে ঐতিহাসিক মতবাদের লেখকরা আইনকে ‘Self Created’ এবং ‘Self Executed’ হিসেবে অভিহিত করেন। প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন আইনকে লোকে মেনে চলে না। বস্তুত জনগণ কর্তৃক স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থিত না হলে, কোনো আইন বাস্তবে কার্যকরী হয় না। মানুষের বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় আইন জনগণের বৃহৎ অংশ দ্বারা গৃহীত না হলে, তাকে কখনও কার্যকরীভাবে বলবৎ করা সম্ভব হয় না।

(4) সমাজবিজ্ঞানমূলক অভিমত

ফ্রান্সের দ্যুগুই, নেদারল্যান্ডের ব্র্যাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রসকো পাউন্ড-এর মতো সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আইনের উৎপত্তি সমাজের প্রয়োজনের ফলেই হয়েছে। তাই আইন সর্বদা সার্বভৌমের আদেশ নয়। আইনের মূল লক্ষ্য হল সমাজের কল্যাণসাধন করা। সমাজবিজ্ঞানী দ্যুগুই বলেছেন, আইন হল সমাজের আচার- আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী কতকগুলি নিয়মকানুন মাত্র। সমাজের সংহতি রক্ষার প্রয়োজনে মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মই হল আইন। তিনি আইনকে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে একে রাষ্ট্রনিরপেক্ষ বলে বর্ণনা করেন।

আবার রসকো পাউন্ড-এর মতে, আইন মানবিককল্যাণ তথা সমাজকল্যাণের বাহক। ব্র্যাবে-এর মতে, আইনের উৎস হল মানুষের যাথার্থ্য সম্পর্কিত অনুভূতি (sense of right)। অধ্যাপক ল্যাস্কি-র অভিমত অনুযায়ী, আইন সমাজের কল্যাণ করে বলেই সকল ব্যক্তি আইন মান্য করে চলে। বিচারালয়ের মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ বা রাষ্ট্রীয় মানদণ্ডের পরিবর্তে তিনি ব্যক্তির বিবেকের উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন যে, ব্যক্তি যদি কোনো আইনকে ন্যায্য বলে বিবেচনা না করে, তাহলে সেই আইনের প্রতি ব্যক্তি আনুগত্য প্রদর্শনে বাধ্য নয়।

অপরপক্ষে, বার্কার বলেছেন, আইনের পশ্চাতে একদিকে যেমন সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি তথা বৈধতা (Validity) থাকা প্রয়োজন, তেমনই সামাজিক ন্যায়নীতির গুরুত্ব তথা নৈতিক মূল্য (Value) থাকাও আবশ্যক।

(5) মার্কসীয় অভিমত

মার্কসীয় মতবাদ অনুযায়ী, আইনের নিজস্ব কোনোরূপ ইতিহাস নেই। কারণ আইন রাষ্ট্রপ্রকৃতির সঙ্গে অভিন্নভাবে জড়িত। আইন রাষ্ট্রের ইচ্ছার প্রকাশ। সমাজের প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্ককে বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্র আইন তৈরি করে। সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি অধ্যায়ে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন – করে। মার্কস ও এঙ্গেলস-এর মতে, শাসকশ্রেণির ইচ্ছা ছাড়া আইন আর কিছু নয়। ভিশিঙ্কি-র মতে, আইন হল এমন সব আচরণবিধি, যা সমাজের প্রতিপত্তিশালী শ্রেণির ইচ্ছার প্রকাশ। সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তরে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণি নিজেদের স্বার্থে আইনকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে।

যেমন-দাস সমাজে শোষণমূলক দাস মালিকদের অনুকূলে, সামন্ত সমাজে সামন্ততন্ত্রের অনুকূলে, বুর্জোয়া সমাজে বুর্জোয়াদের অনুকূলে আইন প্রণীত হয়। অর্থাৎ, শাসকশ্রেণির ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে আইন প্রণীত হয়। ভিশিঙ্কি-র অভিমত হল, “Marxism-Leninism gives a clear definition of the essence of law. It teaches that relationship are rooted in the material conditions of life and that law is merely the will of the dominant class elevated into statue.” শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আইন আদর্শের প্রসার ঘটিয়ে শ্রমিক, কৃষক, প্রলেতারিয়েতের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। আইন এখানে সমগ্র জনগণের ইচ্ছার প্রকাশ।

মার্কসবাদীরা আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় আইন সমাজের উপরিকাঠামো (Super Structure)-র অংশ, যা সমাজের ভিত্তি তথা অর্থনীতির দ্বারা নির্ধারিত হয়। ফলে কোনো রাষ্ট্রীয় আইন অর্থনীতিকে উপেক্ষা করে গড়ে উঠতে পারে না। এ কারণেই ধনী বা পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে আইনের ব্যবহার করা হয়। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় তাত্ত্বিকভাবে আইন সকলের জন্য সমান হিসেবে স্বীকৃত হলেও তা আসলে পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার হাতিয়াররূপে কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপসাধন করে ভূমিসংস্কার, রাষ্ট্রীয় শিল্পের বিকাশ-সহ নানা প্রশাসনিক সংস্কার ইত্যাদির কথা বলা যায়। এই আইনগুলি প্রণীত হওয়া সত্ত্বেও ভারতবাসীর অর্থনৈতিক জীবনে অদ্যাবধি কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি।

আইনের প্রকৃতির সমালোচনা

যেহেতু আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে কোনো ঐক্যমত গড়ে ওঠেনি তাই বিভিন্ন তাত্ত্বিকগণ নানানভাবে আইনের প্রকৃতির সমালোচনা করেছেন। আইনের প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সমালোচনাগুলি হল-

  1. দার্শনিক মতবাদ নানাদিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে এই মতবাদ আইনকে আদর্শের প্রকাশ বলে বর্ণনা করে বলে এই মতবাদ কাল্পনিক মতবাদ হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বক্তব্য হল, আইনকে কখনোই নৈতিকতার মানদণ্ডে পর্যালোচনা করা উচিত নয়। আইন এবং নৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। নৈতিকতার চোখে যা অন্যায় আইনের ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে।
  2. আইন সম্পর্কিত বিশ্লেষণমূলক মতবাদের তীব্র সমালোচনা করে অধ্যাপক ল্যাস্কি, স্যার হেনরি মেইন প্রমুখ দেখিয়েছেন যে, আইনকে শুধুমাত্র সার্বভৌমের আদেশ হিসেবে ঘোষণা করে এক ভ্রান্ত তত্ত্বের অবতারণা করা হয়েছে, সার্বভৌম শক্তি ছাড়াও সমাজের অন্যান্য শক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আইন সৃষ্টির ক্ষেত্রে সমানভাবে কাজ করে। সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি, জনগণের ইচ্ছা ও সমর্থন এক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন – করে। দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র শাস্তির ভয়ে লোকে আইন মেনে চলে-এ যুক্তিও আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মানতে পারেননি। লর্ড ব্রাইস-এর মতে নির্লিপ্ততা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, শাস্তির ভয় এবং যৌক্তিকতার উপলব্ধি আইন মেনে চলার কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্র যখন ছিল না তখনও লোকেরা সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় অনুশাসন প্রভৃতি নিয়মকানুন মেনে চলত। তৃতীয়ত, বিশ্লেষণমূলক মতবাদ যেভাবে আইন ও আদেশকে অভিন্ন বলে বর্ণনা করেছে তা কিন্তু ঠিক নয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আইনের ঊর্ধ্বে এই মতবাদ গণতন্ত্রসম্মত বলে বিবেচিত হতে পারে না। চতুর্থত, এই মতবাদে আইনকে স্থিতিশীল বলা হয়েছে-এই ধারণা ভ্রান্ত। সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে আইনের প্রকৃতিও বদলে যায়।
  3. ঐতিহাসিক মতবাদের বিপক্ষে সমালোচকরা বলেন যে, আইনের পশ্চাতে সার্বভৌম শক্তির সমর্থনকে অস্বীকার করে এই মতবাদ বাস্তবোচিত কাজ করেনি। গেটেল-এর ভাষায় বলা যায়, “This method over emphasised legal history and undervalues legal philosophy.” অর্থাৎ, এই মতবাদ আইনের ইতিহাসের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে আইনের দর্শনকে উপেক্ষা করেছে। দ্বিতীয়ত, এই মতবাদে প্রথা ও রীতিনীতির উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে আইনের উৎপত্তির অন্যান্য উপাদানগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানমূলক মতবাদ অনেকখানি গ্রহণযোগ্য হলেও সকল সমাজব্যবস্থায় আইন সামগ্রিক কল্যাণসাধন করে বলে সমালোচকরা মানতে চাননি।
  4. মার্কসবাদীদের মতে, ধনবৈষম্যমূলক সমাজে আইন প্রতিপত্তিশালী শ্রেণির স্বার্থকে রক্ষা করে। এজন্য সেই সমাজে আইনকে জনকল্যাণকর বলে মেনে নেওয়া যায় না। তাছাড়া আইন কখনও রাষ্ট্রনিরপেক্ষ হতে পারে না। মার্কসীয় মতবাদে সমাজজীবনের সহযোগিতার দিকটি উপেক্ষিত হয়েছে বলে সমালোচকরা মনে করেন। শ্রেণিস্বার্থ ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব এখানে অত্যধিক গুরুত্ব পেয়েছে।

আরও পড়ুন – ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা

Leave a Comment