টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারগুলি সম্পর্কে লেখো

টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারগুলি সম্পর্কে লেখো

টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারগুলি সম্পর্কে লেখো
টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারগুলি সম্পর্কে লেখো

ধর্মীয়, পররাষ্ট্র, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে টমাস ক্রমওয়েল গৃহীত পদক্ষেপগুলি ছিল সর্বাংশে গুরুত্বপূর্ণ।

কুমওয়েলের হস্তক্ষেপে চার্চে রাজার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা

উলসির স্থলে ক্রমওয়েল অষ্টম হেনরির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর রাজাকে সমর্থন করে ক্রমওয়েল বিভিন্নভাবে এই বিবাহবিচ্ছেদের চেষ্টায় উদ্যত হন। তিনি অষ্টম হেনরিকে বোঝান যে, পোপ রাজার বিবাহবিচ্ছেদের অনুমোদন দিতে পারবেন না। এই সংকটাবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব যদি রাজা নিজেকে ইংল্যান্ডের চার্চের সর্বময় কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ক্রমওয়েলের উদ্যোগে ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ধর্মযাজকগণ Christ Doth-এর অনুমোদনের ভিত্তিতে রাজা অষ্টম হেনরিকে ইংল্যান্ডের চার্চের সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার ভিত্তিতে রাজার কর্তৃত্বকে বৈধতা প্রদানের জন্য ক্রমওয়েল প্রয়োজনীয় আইন তৈরির উদ্যোগ নেন।

এরপর ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে অ্যাক্ট ইন রেসট্রেন্ট অফ অ্যাপিলস (Act in Restraint of Appeals) নামক আইন পাস করে বলা হয় ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় বিষয়ে রোমের পোপের কাছে কেউ – কোনও আবেদন করতে পারবে না। আরও বলা হয় যে, ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কিত যাবতীয় মামলার বিচার ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ (Archbishop of Canterbury)-এর আদালতেই হবে। এই আইনবলে টমাস ব্র্যানমার (Thomas Cranmer) অষ্টম হেনরির বিবাহবিচ্ছেদ (The King’s Great Matter) সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হন। তিনি অষ্টম হেনরি ও ক্যাথরিনের বিবাহবিচ্ছেদকে স্বীকৃতি দেন। ফলস্বরূপ অ্যান বোলিনের সঙ্গে হেনরির বিবাহ সম্পন্ন হতে আর কোনও বাধা রইল না। বস্তুতপক্ষে এই ঘটনার আবর্তেই রাজা অষ্টম হেনরির সঙ্গে ক্রমওয়েলের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়।

বলাই বাহুল্য পোপ এই ঘটনায় অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং রোমান চার্চ থেকে অষ্টম হেনরিকে বহিষ্কৃত বলে ঘোষণা করেন। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ জনসাধারণের মধ্যেও পোপতন্ত্রবিরোধী এক মনোভাব গড়ে উঠছিল। এসময় ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডরাজকে বোঝান যে, রোমের সঙ্গে ধর্মীয় বিষয়ে সম্পর্ক ছেদ করাই হল পোপের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার একমাত্র পথ। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মাধ্যমে টমাস ক্রমওয়েলের উদ্যোগে একের পর এক আইন পাস হতে থাকে।

টমাস ক্রমওয়েল ও রিফরমেশন পার্লামেন্ট

টমাস ক্রমওয়েলের উদ্যোগে ইংল্যান্ড থেকে রোমান চার্চকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য পার্লামেন্টকে ব্যবহার করা হয়েছিল। রাজার প্রতি অনুগত এই পার্লামেন্টই ইতিহাসে পরিচিত রিফরমেশন পার্লামেন্ট (English Reformation Parliament) নামে। ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে টমাস ক্রমওয়েলের পরামর্শে অষ্টম হেনরি পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেন (৩ নভেম্বর)। এরপর ১৫২৯-১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালপর্বে রাজার অনুমতিক্রমে, টমাস ক্রমওয়েল রিফরমেশন পার্লামেন্ট-এর মাধ্যমে রাজা অষ্টম হেনরির পক্ষে একের পর এক আইন পাস করতে থাকেন। বস্তুতপক্ষে রিফরমেশন পার্লামেন্ট প্রণীত আইনসমূহের দ্বারাই ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কার সম্পূর্ণ করা হয়। এই সকল আইনের সাহায্যেই পোপের প্রাধান্য বাতিল করে ক্রমওয়েল অষ্টম হেনরির ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে উদ্যত হন।

বিভিন্ন আইন পাস 

১৫২৯ থেকে ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছরের সময়কালে ইংল্যান্ডে রিফরমেশন পার্লামেন্টের যে অধিবেশনগুলি বসেছিল সেখানে পাস হওয়া আইনের সংখ্যা ছিল মোট ১৩৭টি। এগুলির মধ্যে ৩২টি আইন ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমওয়েলের উদ্যোগে এই পার্লামেন্টে পাস হওয়া কতগুলি বিশেষ আইন সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন- 

  • প্রোবেট অ্যান্ড মরচুয়ারি অ্যাক্ট (Probate and Mortuary Act): এই আইনের মাধ্যমে পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পর্কিত কর এবং পূর্বপ্রচলিত ধর্মীয় আদালতে উইলের প্রতিলিপি সংক্রান্ত অধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। 
  • অ্যাক্ট অফ প্লুরালিটিজ (Act of Pluralities): এর দ্বারা যাজকদের নানান সুযোগসুবিধার উপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। 
  • প্রেমুনিয়ার আইন (Praemunire): স্ট্যাটুট অফ প্রেমুনিয়ার (Statute of Praemunire) আইন ভঙ্গকারী যাজকদের ১ লক্ষ পাউন্ড জরিমানা ধার্য করা হয়। ইংল্যান্ডের চার্চের উপরে রাজার সর্বময় কর্তৃত্বের কথা সময়েই ইংল্যান্ডের যাজকদের কাছ থেকে স্বীকার করিয়ে নেওয়া হয়। 
  • অ্যাক্ট ইন রেসট্রেন্ট অফ অ্যানেটস বা অ্যাক্ট অফ অ্যানেটস (Acts in Restraint of Annates): অ্যাক্ট অফ অ্যানেটস পাস করে টমাস ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের উপর পোপতন্ত্রের প্রাধান্য খর্ব করতে সচেষ্ট হন। এর দ্বারা যাজকদের যাজক পদ গ্রহণের প্রথম বছরের আয় পোপের পরিবর্তে রাজাকে প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। 
  • অ্যাক্ট ইন রেসট্রেন্ট অফ অ্যাপিলস (Act in Restraint of Appeals): ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত অ্যাক্ট অফ অ্যাপিলস পাস করা হয়। ইতিমধ্যেই ১৫৩৩-এর জানুয়ারি মাসে ইংল্যান্ডরাজ অষ্টম হেনরি গোপনে অ্যান বোলিনকে বিয়ে করেন। টমাস ব্র্যানমার এই বিবাহকে আইনসিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। মূলত রানি ক্যাথরিন-সহ অন্য কেউ যাতে ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ তথা ধর্মীয় কোনও বিষয়ে রোমের পোপের কাছে আবেদন করতে না পারে তার জন্যই উক্ত আইনটি পাস করা হয়।
  • অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি (Act of Supremacy): ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রিফরমেশন পার্লামেন্ট আরও কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি। এই আইন দ্বারা ইংল্যান্ডের চার্চের উপর রাজার সার্বভৌমত্বকে আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া এতদিন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের চার্চের উপর পোপের যে একাধিপত্য ছিল, তা অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসির মাধ্যমে লুপ্ত করা হয়। ফলস্বরূপ চার্চ ও রাষ্ট্র উভয়ের উপরেই রাজার কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। 
  • অ্যাক্ট অফ সাকসেশন (Act of Succession): ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে অ্যাক্ট অফ সাকসেশন বা উত্তরাধিকারী আইন দ্বারা অ্যান বোলিনের সন্তানকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায়। 
  • ট্রিজন অ্যাক্ট (Treason Act): ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ট্রিজন আইন পাস করে, যার দ্বারা অত্যাচারী ও বিধর্মী হিসেবে যাতে কেউ রাজাকে চিহ্নিত করতে না পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আরও বলা হয়, রাজদ্রোহ তথা রাজশক্তির বিরুদ্ধে কেউ যদি কোনোরূপ চাপ সৃষ্টি করে তবে তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইংল্যান্ডে যাজকদের ক্ষমতা ধ্বংসের নীতি ও অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসির বিরুদ্ধে অনেকে সোচ্চার হন। এই আইনের বিরোধিতা করার জন্য স্যার টমাস মোর (Thomas More) ও জন ফিশারের (John Fisher) মতো বিখ্যাত পণ্ডিতদের প্রাণদণ্ডও দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ক্রমওয়েল গির্জার বিশপের প্রতিনিধি বা ভাইকার জেনারেল (Vicar General) পদে নিযুক্ত হন। টমাস ক্রমওয়েলের পরামর্শক্রমে ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা রিফরমেশন পার্লামেন্টে রোমের বিশপদের বিরুদ্ধে এক আইন পাস করেন। উক্ত বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ ইংল্যান্ডের ছোটো ছোটো মঠগুলিকে উচ্ছেদের জন্য প্রণীত হয় আরও একটি আইন। এই ঘটনাবলির সূত্র ধরেই ইংল্যান্ডের মঠগুলির উচ্ছেদসাধনে ক্রমওয়েলের উদ্যোগ সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন।

মঠগুলির উচ্ছেদসাধন

ইংল্যান্ডের ইতিহাসে মঠগুলির উচ্ছেদসাধন (Dissolution of Monasteries) ছিল এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বলা যেতে পারে যে, ইংল্যান্ডে রাজার কর্তৃত্বকে সর্বক্ষেত্রে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ক্রমওয়েল গৃহীত নানাবিধ উদ্যোগসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল মঠব্যবস্থার উচ্ছেদসাধন।

মঠব্যবস্থার উচ্ছেদের কারণ ও ক্রমওয়েলের উদ্যোগ

ষোড়শ শতকের গোড়ার দিক থেকে ইংল্যান্ডের মঠগুলি পূর্বেকার জনগণের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য হারাতে থাকে। মঠগুলির উচ্ছেদসাধনের পশ্চাতে একাধিক কারণ ছিল। 

  • ইংল্যান্ডের মঠগুলি ছিল প্রভৃত পরিমাণে ধনসম্পত্তির অধিকারী। 
  • মঠের জীবনও ছিল যথেষ্ট কলুষতাপূর্ণ। উপবাসের বদলে এসময়ে মঠগুলিতে রাজকীয় ভোজন, জমকালো ও আড়ম্বরপূর্ণ পোশাক এবং জীবনযাত্রায় সন্ন্যাসীরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। 
  • তার উপর আবার নবজাগরণের ফলে দেশে যে নতুন ভাবধারা ও শিক্ষার বিকাশ ঘটেছিল, মঠের সন্ন্যাসীরা তার থেকে ছিলেন অনেকটাই দূরে। 
  • সর্বোপরি পোপের নৈতিক ও আর্থিক শক্তির অন্যতম ভিত্তি ছিল ইংল্যান্ডের বহু ছোটো-বড়ো খ্রিস্টীয় মঠ। ইংল্যান্ডের মঠের সন্ন্যাসীরা পোপকেই ধর্মীয় প্রধান বলে সম্মান করতেন এবং এখান থেকে সংগৃহীত অর্থের বিপুল অংশ পাঠানো হত রোমে। এই পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ডরাজ অষ্টম হেনরি ধর্মসংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মঠগুলির উচ্ছেদসাধনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আসলে এসময় নানাবিধ কারণ, যেমন- ব্যয়বহুল যুদ্ধবিগ্রহ, আয়ারল্যান্ডের বিদ্রোহ, জনগণের করপ্রদানে অনীহা ইত্যাদির ফলে রাজার কোশাগার ক্রমেই শূন্য হয়ে পড়ছিল। তাই হেনরির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মঠসমূহের স্থাবর-অস্থাবর বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা। বলাবাহুল্য, এই পরিকল্পনার প্রকৃত রূপকার ছিলেন অষ্টম হেনরির প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টা টমাস ক্রমওয়েল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ইংল্যান্ডের মঠগুলির উচ্ছেদ ঘটলে দুদিক থেকে রাজার উপকার হবে- (a) ইংল্যান্ডে পোপের অনুগামীদের অস্তিত্ব লোপ পাবে ও (b) মঠের প্রভৃত অর্থ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ইংল্যান্ডের অর্থব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করা যাবে। অতঃপর ক্রমওয়েল রাজার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মঠগুলির বাজেয়াপ্তকরণ এবং এর দ্বারা রাজকোশাগারের আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন।

অষ্টম হেনরির ভাইকার জেনারেল হিসেবে নিযুক্তির পর ক্রমওয়েল প্রথমেই চার্চের সমস্ত সম্পত্তি মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে একটি কমিশন তৈরি করেন এবং এই কমিশন ৬ মাসের মধ্যেই তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। মঠগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা, দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় উল্লিখিত হয় কমিশনের প্রতিবেদনে। এরপর তিনি মোট ৫ জন প্রতিনিধিকে পাঠান মঠগুলি পরিদর্শনের জন্য।

মঠব্যবস্থার উচ্ছেদসাধনের উদ্দেশ্যে আইন পাস ও পিলগ্রিমেজ অফ গ্রেস বিদ্রোহ 

এমতাবস্থায় ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের মঠগুলির ধ্বংস সাধনের উদ্দেশ্যে দুটি আইন পাস করেন, যথা- প্রথম উচ্ছেদ আইন (১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দ) ও দ্বিতীয় উচ্ছেদ আইন (১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ)।

প্রথম উচ্ছেদ আইন

প্রথম উচ্ছেদ আইন (The Suppression of Religious Houses Act, 1536) দ্বারা ২০০ পাউন্ডের কম বাৎসরিক আয়সম্পন্ন মঠগুলিকে ক্রমওয়েল দুর্নীতির অভিযোগে ভেঙে দেন। বিলুপ্তি ঘটে প্রায় ৩৭৬টি মঠের। রাজা এই সকল মঠগুলির বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন।

পিলগ্রিমেজ অফ গ্রেস: ছোটো ছোটো মঠগুলির উচ্ছেদসাধনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ লিঙ্কনশায়ার, ইয়র্কশায়ার ও কালক্রমে সমগ্র উত্তর ইংল্যান্ডে এক বিদ্রোহের সূচনা হয়-যা ইতিহাসে পিলগ্রিমেজ অফ গ্রেস (Pilgrimage of Grace) নামে পরিচিত। যাজক শ্রেণির সঙ্গে এতে স্থানীয় ভূস্বামীরা যোগ দিলে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। ধর্মীয় কারণের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, করভার এবং Encloser বা ভূমি পরিবেষ্টন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপত্তিজনিত একাধিক কারণও।

প্রথমদিকে ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে লিঙ্কনশায়ারে মঠব্যবস্থার উচ্ছেদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, তার নেতৃত্ব দেন ভিকার অফ লাউথ (Vicar of Louth)। ইয়র্কশায়ারে আবার রবার্ট আসকে (Robert Aske) নামক এক আইনজ্ঞ বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। তীর্থযাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে তিনি মঠসমূহের ও তার সম্পত্তির পুনরুদ্ধার এবং ক্রমওয়েলের পদচ্যুতির দাবি তোলেন রাজা অষ্টম হেনরির কাছে। তবে কিছুকালের মধ্যেই টমাস ক্রমওয়েল কঠোর হাতে এই বিদ্রোহ দমন করে যাজকদের রাজার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণে বাধ্য করেন।

ইয়র্কশায়ারের বিদ্রোহী নেতা রবার্ট আসকে-সহ বহু নেতাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নেতৃস্থানীয় বহু সন্ন্যাসীদের ফাঁসি দেওয়া হয় এবং অনেকেই আত্মসমর্পণ করেন। ছোটো ছোটো মঠগুলির উচ্ছেদসাধনের পর ক্রমওয়েল বড়ো মঠগুলির উচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হন।

দ্বিতীয় উচ্ছেদ আইন

এরপর ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের অবশিষ্ট মঠগুলির (বৃহৎ মঠ) উচ্ছেদসাধনের জন্য প্রণীত হয় দ্বিতীয় উচ্ছেদ আইন (The Suppression of Religious Houses Act 1539)। এর দ্বারা মঠগুলির সমস্ত সম্পত্তি রাজার অধিকারে আনা হয়।

মঠব্যবস্থা উচ্ছেদের ফলাফল

মঠব্যবস্থার উচ্ছেদসাধনের ঘটনা ইংল্যান্ডে রাজার ক্ষমতা, মর্যাদা ও আর্থিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। ধর্মীয় জীবনের সর্বত্র রাজার নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ইংল্যান্ডের মঠগুলির বিশাল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে টমাস ক্রমওয়েল রাজকোশাগার সমৃদ্ধ করেন। সমকালীন পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, মঠগুলির ধনসম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের দরুন এসময় রাজকীয় রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রায় ১ লক্ষ পাউন্ড। ইংল্যান্ডের বহু ছোটো-বড়ো মঠ রাজার নিয়ন্ত্রণে আসে। বস্তুতপক্ষে ক্রমওয়েলের এই নীতির দ্বারা রাজা অষ্টম হেনরির ক্ষমতা ও অর্থের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হয়।

গ্রেট বাইবেল অনুবাদ

টমাস ক্রমওয়েল মাইলস কভারডেলকে (Myles Coverdale) ইংরেজি ভাষায় বাইবেল অনুবাদের জন্য উৎসাহিত করেন। মূলত ক্রমওয়েলের উদ্যোগেই ইংল্যান্ডের ছাপাখানায় পবিত্র বাইবেলের ইংরেজি অনুবাদ মুদ্রিত হয়। তাঁর উৎসাহে কভারডেল ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রেট বাইবেল প্রকাশ করেন, যা ইংল্যান্ডের জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ইংল্যান্ডের প্রতিটি চার্চে এই বাইবেল রাখা বাধ্যতামূলক করা হয় এবং সাধারণ মানুষকেও এই বাইবেল কেনার অনুমতি প্রদান করা হয়।

টমাস ক্রমওয়েল ও প্রশাসনিক পদক্ষেপসমূহ

১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অষ্টম হেনরির পরামর্শদাতা ও প্রধানমন্ত্রী টমাস ক্রমওয়েলের প্রচেষ্টায় ইংল্যান্ডের সরকারি ব্যবস্থায় ঘটে যায় এক আমূল রূপান্তর। আলোচ্য পর্বে ইংল্যান্ডের প্রাসাদ শাসন অর্থাৎ রাজপরিবার তথা প্রাসাদের মুষ্টিমেয় মানুষের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থার গণ্ডি অতিক্রম করে ক্রমওয়েল শাসনব্যবস্থাকে জাতীয় রূপদানে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইংল্যান্ডে চার্চের উপর তিনি সম্রাটের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে যেমন জাতীয় শাসনব্যবস্থা স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তেমনি পার্লামেন্টকে কাজে লাগিয়ে ইংল্যান্ডে মধ্যযুগীয় সংবিধানের পরিবর্তে গড়ে তোলেন আধুনিক সংবিধান।

প্রশাসনিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, ক্রমওয়েল প্রশাসনের মধ্যযুগীয় কাঠামোর অবসান ঘটিয়ে জাতীয় আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর উপর প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দাঁড় করান। উক্ত শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিল মন্ত্রীসভা। তাছাড়া তিনি জাতীয় প্রশাসন থেকে হাউসহোল্ড বিভাগের বিচ্ছেদকে সম্পূর্ণ করে প্রশাসনকে বেশ অনেকগুলি আমলাতান্ত্রিক ও কেন্দ্রীয় বিভাগ দ্বারা সংগঠিত করেন।

ক্ষমতাশালী সেক্রেটারি পদ গঠন

টমাস ক্রমওয়েল সম্রাটের ব্যক্তিগত কর্মচারী থেকে সচিবের পদটিকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী পদে পরিণত করেন। রাজার সচিবালয় গঠনের পাশাপাশি প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পদ তৈরি করে উক্ত পদে আসীন হন। এলিজাবেথের সেক্রেটারিগণ পরবর্তীকালে তাঁর পদচিহ্ন অনুসরণ করেছিলেন। প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্র যথা- অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি, রাজস্ব ও আর্থিক ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা ও ধর্মের উপর তিনি বিশেষ নজর রেখেছিলেন।

প্রিভি কাউন্সিল গঠন

১৯ জন সদস্য নিয়ে টমাস ক্রমওয়েল গঠন করেছিলেন প্রিভি কাউন্সিল (Privy Council) -যা তাঁর উল্লেখযোগ্য সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় বহন করে। সরকারি কাজকর্ম পরিচালনায় প্রিভি কাউন্সিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ

ক্রমওয়েল ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে অর্থবিভাগে নতুন নতুন পদ গঠনে উদ্যোগী হন। চার্চের করব্যবস্থার বিষয়টি তদারকির উদ্দেশ্যে গঠিত হয় নতুন কোশাধ্যক্ষের পদ। তাছাড়া রাজস্ব আদালত গঠনের মাধ্যমে তিনি রাজস্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলার নিষ্পত্তি করতে সচেষ্ট হন। আলোচ্য পর্বে আর্থিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন করে ক্রমওয়েল মোট ৬টি পৃথক বিভাগের প্রবর্তন করেন, এগুলি হল- 

  • এক্সচেকার (Exchequer): প্রথাগত রাজস্ব, শুল্ক ও পার্লামেন্ট অনুমোদিত করসমূহ, 
  • ডাচি অফ ল্যাঙ্কাস্টার (Duchy of Lancaster): ডাচির অন্তর্গত জমি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব যুক্ত করা হয় চেম্বারের সঙ্গে, 
  • জেনারেল সার্ভেয়ারস অফ ক্রাউন ল্যান্ডস (General Surveyors of Crown Lands): সপ্তম হেনরি ও উলসি যেসকল জমির উপর রাজার অধিকার পুর্নস্থাপন করেছিলেন তার রাজস্বসমূহ, দ্য কোর্ট অফ অগমেন্টেশন (The Court of Augmentation): মঠসমূহের বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তি থেকে আয়,
  • দ্য কোর্ট অফ ফার্স্ট ফ্রুটস অ্যান্ড টেনাস (The Court of First Fruits and Tenths) : চার্চ থেকে রাজস্বপ্রাপ্তি, 
  • দ্য কোর্ট অফ ওয়ার্ডস অ্যান্ড লিভেরিজ (The Court of Wards and Liveries): সামন্তপ্রভু হিসেবে রাজা যে রাজস্ব লাভ করেন। আর্থিক বিভাগের পুনর্গঠন দ্বারা ক্রমওয়েল যে সর্বপ্রকার ত্রুটি দূরীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন একথা বলা যায় না। তবে তাঁর সংস্কারের দরুন রাজার আয় প্রায় দুগুণ বৃদ্ধি পায়। এমনকি মুদ্রাস্ফীতির পর্বেও একমাত্র যুদ্ধের সময় ব্যতীত রাজাকে কখনোই আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হতে হয়নি।

পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ভূমিকা

ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্র সম্পর্ক নির্ধারণেও ক্রমওয়েল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

ইটালির সঙ্গে সম্পর্ক 

ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির বিবাহবিচ্ছেদ ও পুর্নবিবাহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোমান পোপের সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিবাদ চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। উক্ত প্রেক্ষাপটে ক্রমওয়েল রিফরমেশন পার্লামেন্টের আইনবলে ইংল্যান্ডের চার্চকে পোপের প্রভাবমুক্ত করে অষ্টম হেনরির অধীনে আনেন। ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপকে যাজক পদে নিযুক্ত করা হয়। এমনকি রোমের পোপকে বার্ষিক ধর্মীয় করপ্রদানও বন্ধ করা হয়। এভাবে বিভিন্ন কৌশলে টমাস ক্রমওয়েল ইটালির সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক

ক্যাথরিনের সঙ্গে অষ্টম হেনরির বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে স্পেনরাজ পঞ্চম চার্লস ইংল্যান্ডের শত্রুতে পরিণত হন। এমতাবস্থায় ক্রমওয়েল মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করেন স্পেনরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিরাজের সঙ্গে। ফ্রান্সের সঙ্গে বৈদেশিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য এসময় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। 

জার্মানির সঙ্গে সম্পর্ক 

ইংল্যান্ডের নিরাপত্তার তাগিদে ক্রমওয়েল জার্মানির রাজাদেরও সমর্থনলাভে সচেষ্ট হন। ফলে সাময়িকভাবে হলেও ইংল্যান্ডের সঙ্গে জার্মানির রাজন্যবর্গের মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ

ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ কনরাড রাসেল (Conrad Sebastian Robert Russell) টমাস ক্রমওয়েলের আরও দুটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপের উল্লেখ করেছেন, যথা- ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের সমস্ত জমি লেনদেন করার সময় নিবন্ধীকরণ পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করেছিলেন এবং স্থানীয় গির্জায় জন্ম-বিবাহ-মৃত্যু ইত্যাদি বিষয়গুলিরও নিবন্ধীকরণের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া পার্লামেন্টের সদস্যদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সদস্য মনোনয়নে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অগ্রাধিকার প্রভৃতির মাধ্যমে ক্রমওয়েল জাতীয় শাসনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় রূপ দান করেছিলেন।

টিউডর বিপ্লব

উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে একথা বলা যায় যে, টমাস ক্রমওয়েলের পদক্ষেপসমূহ তথা উদ্যোগ ইংল্যান্ডের সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গভীর পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। রাজা অষ্টম হেনরির প্রধান উপদেষ্টা পদে নিযুক্তির পর তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি। ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কার আন্দোলনকেও কার্যকরী করতে ক্রমওয়েলের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কার্ডিনাল উলসির মৃত্যুর পর মূলত টমাস ক্রমওয়েলের উদ্যোগেই রোমান চার্চের সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় চার্চ- যার উদ্দেশ্য ছিল দেশে জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা।

ঐতিহাসিক জিওফ্রে এলটনের মতে, টমাস ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে ১৫৩০-এর দশকে ইংল্যান্ডের সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে একটি বিপ্লব সাধিত হয়, যা ইংল্যান্ডের ইতিহাসে টিউডর বিপ্লব (Tudor Revolution in Government) নামে পরিচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইংল্যান্ডের সরকারি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তনকে এই অর্থে বৈপ্লবিক বলা যায় যে, এর দরুন ইংল্যান্ডের সংবিধান এবং সরকার বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। অবশ্য টিউডর বিপ্লব বলতে যা বোঝায় তা কোনও পুরোনো ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নতুনভাবে তৈরি হয়নি। এলটন আরও বলেছেন যে, আইনগত সাংবিধানিক নিয়মের প্রতি কঠোর আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য একদিকে এই বিপ্লবকে রক্ষণশীল বলেও মনে করা হয়। যদিও এলটনের টিউডর বিপ্লব সম্পর্কিত মত নিয়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment