ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকারটি আলোচনা করো

ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকারটি আলোচনা করো

ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকারটি আলোচনা করো
ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকারটি আলোচনা করো

সাম্যের অধিকার ১৪-১৮ নং ধারা

(1) সাম্যের অর্থ ও প্রকৃতি

গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের জন্য ‘সাম্য’ একটি অন্যতম অপরিহার্য রাজনৈতিক আদর্শবিশেষ। সাধারণভাবে সাম্য বলতে সকল ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের উপযোগী প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধার স্বীকৃতিকে বোঝায়। আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্তরকম বৈষম্যের অবসান হল সাম্য। বস্তুতপক্ষে গণতন্ত্রের প্রধান দুটি স্তম্ভ হল সাম্য ও স্বাধীনতা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত হল, সাম্য এবং স্বাধীনতা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি (Harold Laski)-র মতে, সমাজে বিশেষ সুযোগসুবিধার অস্তিত্ব থাকলে জনগণের স্বাধীনতা থাকতে পারে না। ধনবৈষম্যমূলক সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য না থাকায় রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে আইনগত স্বাধীনতার কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না।

(2) আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার

ভারতীয় সংবিধানে ১৪-১৮ নং ধারায় সাম্যের অধিকার ঘোষিত ও স্বীকৃত হয়েছে। সাম্যের অধিকার সম্পর্কে সংবিধানের ১৪ নং ধারায় বলা হয়েছে ভারতের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে আইনের দৃষ্টিতে সমতার অধিকার বা আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার হতে বঞ্চিত করতে পারবে না। (‘The State shall not deny to any person equality before the law or to equal protection of the laws within the territory of India’.)। সুপ্রিমকোর্ট এই ধারাটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছে যে, সংবিধানের প্রস্তাবনায় সকলের জন্য মর্যাদা ও সুযোগসুবিধার সমতা প্রতিষ্ঠা করার আদর্শ গ্রহণ করা হয়েছে। এই মহান আদর্শকে কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে সাম্যের অধিকার অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে গৃহীত হয়েছে।

  • সাম্যের অধিকার: আপাতদৃষ্টিতে ১৪ নং ধারাটিতে দুটি অধিকারের উল্লেখ রয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সমতা (Equality before the Law) এবং আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার (Equal protection of the Laws)। এদের মধ্যে প্রথমটি ইংল্যান্ডের সাধারণ আইন থেকে এবং দ্বিতীয়টি আমেরিকার সংবিধান থেকে গৃহীত। বিচারপতি সুব্বা রাও-এর মতে, ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ উক্তিটি নেতিবাচক। অন্যদিকে ‘আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার’ উক্তিটি ইতিবাচক (‘Equality before law is a negative concept, equal protection of the law is a positive one’) I
  • আইনের দৃষ্টিতে সমতা: ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’র অর্থ হল সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান। এই ধারণা অধ্যাপক এ ভি ডাইসি-র ‘আইনের অনুশাসন’ তত্ত্বের দ্বিতীয় নীতির অনুসরণে গৃহীত হয়েছে। ডাইসির বক্তব্য হল, আইনের দৃষ্টিতে সমতার অর্থ হল ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও অবস্থা নির্বিশেষে কোনো ব্যক্তিই দেশের আইনের ঊর্ধ্বে নয়। প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত দেশের প্রত্যেক ব্যক্তি সাধারণ আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সাধারণ আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে আইভর জেনিংস (Ivor Jennings) বলেছেন যে, আইনের দৃষ্টিতে সমতা বলতে বোঝায়, “সমকক্ষদের মধ্যে আইন সমান ও সমভাবে প্রযোজ্য হবে” (‘Equality before the law means among equals the law should be equal and should be equally administered’) এবং ‘একই ধরনের কাজের জন্য’ (‘for the same kind of action’) সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক জাতি, সম্পদ, সামাজিক মর্যাদা কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্বিশেষে আদালতে অভিযোগ করতে বা অভিযুক্ত হতে পারবে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বিচারপতি সুব্বা রাও ‘আইনের দৃষ্টিতে’ সমতাকে একটি নেতিবাচক ধারণা (a negative concept) বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ হিসেবে এই যুক্তির অবতারণা করেন যে, কোনো ব্যক্তিই বিশেষ সুবিধার দাবি জানাতে পারে না এবং সব শ্রেণির নাগরিকরাই দেশের সাধারণ আইনের দ্বারা সমানভাবে সংরক্ষিত হবে। রুবিন্দর সিং বনাম ভারত ইউনিয়ন (১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ) মামলায় সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত রায় অনুযায়ী, আইনের অনুশাসন এই দাবি করে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চরম প্রয়োজনীয়তার সময়েও কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ‘কঠোর, বর্বর বা বৈষম্যমূলক আচরণ’ করা চলবে না। রাষ্ট্রের কাছে কেউ বিশেষ সুযোগসুবিধা পেতে পারে না। কতকগুলি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম রয়েছে।

আইনের দৃষ্টিতে সমতানীতির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম 

আইনের দৃষ্টিতে সমতা নীতির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হল-

  • সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় পুলিশ কর্মচারীরা ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।
  • রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালগণ পদাধিকার বলে যেসকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন এবং যেসকল কার্য ও কর্তব্য সম্পাদন করেন সেজন্য তাঁরা কোনো আদালতের কাছে কৈফিয়ত প্রদানে বাধ্য নন।
  • সংবিধানের ৩৬১ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দাখিল করা যায় না তবে তাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা দাখিল করা যায় এবং দেওয়ানি মামলা দায়ের করতে হলে বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয় এবং মামলা দায়ের করার জন্য ২ মাসের নোটিশ দিতে হয়।
  • রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালগণ তাঁদের নিজের পদে বহাল থাকাকালীন অবস্থায় তাঁদের গ্রেফতার বা কারাবাসের জন্য কোনো আদালত নির্দেশ দিতে পারে না।
  • প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যদি কোনো ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হয় সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়।

উল্লিখিত সাংবিধানিক ব্যতিক্রম ছাড়াও আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে আইনের দৃষ্টিতে সাম্য নীতির ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। সেগুলি হল-

  • বিদেশি রাষ্ট্রের শাসকদের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করা যায় না। কারণ তাঁরা কোনোভাবেই ভারতীয় আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত নন।
  • যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের ব্যক্তিবর্গরা ভারতীয় আদালতে যেমন মামলা দাখিল করতে পারে না ঠিক তেমনই অন্যান্য বন্দিদের ন্যায় সুযোগসুবিধাও দাবি করতে পারে না।
  • সংসদ এবং রাজ্য আইনসভার সদস্যরা বেশকিছু বিশেষ অধিকার ভোগ করে।
  • ৪৪ তম সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী পার্লামেন্ট প্রশাসনিক আদালত গঠন করে স্থানীয় সংস্থা বা সরকারি সংস্থার কর্মীদের চাকুরি সংক্রান্ত যাবতীয় বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যও পার্লামেন্টের ট্রাইবুনাল গঠন করার অধিকার রয়েছে। এ ছাড়া শিল্প, ভূমিসংস্কার, খাদ্য সংগ্রহ ও বণ্টন ইত্যাদি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যও পার্লামেন্টের ট্রাইবুনাল গঠন করার অধিকার রয়েছে।

আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার

‘আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার’ দ্বারা এটা বোঝায় যে, সমপর্যায়ভুক্ত – ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আইন সমভাবে প্রযুক্ত হবে। মার্কিন সংবিধানের চতুর্দশ – সংশোধন থেকে এটি গৃহীত হয়েছে। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ – রাজ্য বনাম আনোয়ার আলি (১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ) মামলায় সুপ্রিমকোর্ট এই – অভিমত প্রকাশ করে যে, ‘আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষণ বলতে এমন এক অবস্থাকে বোঝায় যেখানে একইরকম পরিস্থিতিতে আইন সবার উপর একইভাবে প্রযোজ্য হয়’ (‘The protection of equal laws, that is, laws that operate alike on all persons under like circumstances’.)।

চিরঞ্জিতলাল চৌধুরি বনাম ভারত সরকার ও অন্যান্য (১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) মামলায় সুপ্রিমকোর্ট এক রায়ে ঘোষণা করে যে, ‘সমভাবে সংরক্ষণের অর্থ হল সমান অবস্থায় সমান সংরক্ষণ’ (“Equal protection means equal protection under equal circumstances”)। এই অধিকারের অর্থ হল লোকের অবস্থা বা প্রকৃতির বিভিন্নতা বিচার করে প্রতিটি আইনকে সকল ব্যক্তির ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে

আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার-এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম

আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার-এর কয়েকটি ব্যতিক্রম লক্ষণীয় যেমন-অবস্থার বিচার বিশ্লেষণ না করে প্রতিটি আইন সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযুক্ত হয় না। যুক্তিসংগতভাবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভাজন করা যেতে পারে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে আইন পৃথকভাবে প্রযুক্ত হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেসকল ব্যক্তি আয় করেন তাদের সকলকে আয়কর প্রদান করতে হয় না। আয়ের পরিমাণের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন হারে আয়কর প্রদান করতে হয়। তবে এ প্রসঙ্গে বলা যায়, আনোয়ার আলি মামলায় সুপ্রিমকোর্টের রায় অনুসারে- শ্রেণিবিভাগটি হবে সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য শ্রেণিবিভাগের সঙ্গে আইনের উদ্দেশ্যের যুক্তিপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে। সুতরাং, আইনসভা বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যেকার শ্রেণিবিভাজন করে আইন প্রণয়ন করলেও তা কখনোই ‘আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত’ হওয়ার অধিকারকে খর্ব করে না।

বোম্বাই রাজ্য বনাম এফ এন বালসারা (১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ) মামলার রায়ে বিচারপতি ফজল আলি মন্তব্য করেছিলেন যে, এই নীতিটি রাষ্ট্রের হাত থেকে ‘যুক্তিসংগত উদ্দেশ্যে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে শ্রেণিবিভাজনের ক্ষমতা কেড়ে নেয়নি’ (‘The power of classifying persons for legitimate purpose’)। অনুরূপভাবে রামকৃয় ডালমিয়া বনাম তেন্ডুলকর (১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ) মামলার রায়ে বিচারপতি গজেন্দ্র গাদকার বলেছিলেন যে, ১৪ নং ধারা ‘শ্রেণিগত আইন প্রণয়ন’ (class legislation) নিষিদ্ধ করে দিলেও ‘যুক্তিসংগত শ্রেণিবিভাজনের জন্য আইন প্রণয়ন’ নিষিদ্ধ করেনি। শ্রেণিগত আইন প্রণয়ন বলতে বোঝায়, সমাজের বহুসংখ্যক মানুষের মধ্যে থেকে কোনো এক শ্রেণির মানুষকে ইচ্ছামতো বেছে নিয়ে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক উপায়ে কিছু বিশেষ সুযোগসুবিধা প্রদান করাকে বোঝায়।

সুতরাং বলা যায় কোনো আইন যদি সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করে তাহলে আদালত তা বাতিল করে দিতে পারে। সুতরাং একথা বলাই যায়, যে, আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত হওয়া বলতে কেবলমাত্র বৈষম্যমূলক আইনের হাত থেকে সংরক্ষণ করাকেই বোঝায় না, আইনের বৈষম্যমূলক প্রয়োগ হতে সংরক্ষণকেও বোঝায়। কোনো আইন যদি বৈষম্যমূলক হয়, তাহলে সেই আইনকে বিচার করার দায়িত্ব আদালতের উপরে ন্যস্ত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, সংবিধানের ১৪নং ধারাটির অধিকার পুরোপুরি আইনগত। কে ভি রাও মনে করেন, ১৪নং ধারাটি বিচারালয়ের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সাহায্য করেছে।

(1) সাম্যের অধিকারের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অকার্যকারিতা

ভারতীয় সংবিধানে সাম্যের অধিকারটি লিপিবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ কতটা ঘটে তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ ধনী ব্যক্তিদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে দরিদ্র জনসাধারণকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়, কিন্তু সেই মামলার ব্যয়ভার অনেকসময় দরিদ্র জনসাধারণের পক্ষে নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। ফলে নির্দোষ দরিদ্র ব্যক্তি মামলার বিচারে ধনশালী ব্যক্তির কাছে পরাজিত হয় এবং বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়।

(2) জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকার 

সংবিধানের ১৫ (১) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ এবং জন্মস্থানজনিত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। এ ছাড়া কোনো নাগরিককে আবার উপরোক্ত যে-কোনো কারণের জন্য দোকান, সাধারণের ব্যবহার্য রেস্তোরাঁ, হোটেল ও প্রমোদস্থলে প্রবেশ বিষয়ে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে তৈরি করা কূপ, জলাশয়, স্নানের ঘাট, রাস্তা ও আশ্রয়স্থল ব্যবহার করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না [১৫ (২) নং ধারা]।

জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকারের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম

এক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম লক্ষণীয় সেগুলি হল-

  1. জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্র কূপ, জলাশয়, স্নানাগার প্রভৃতি স্থানে যে-কোনো ছোঁয়াচে রোগীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য আইনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
  2. রাষ্ট্র নারী, শিশু, তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
  3. শিক্ষা ক্ষেত্রে অনগ্রসর শ্রেণির উন্নতির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
  4. ২০০৫ সালে ৯৩ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সামাজিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অনগ্রসর শ্রেণি, তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভরতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আসন সংরক্ষণ-এর জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারে [১৫ (৫) নং ধারা]।

সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সকলের সমানাধিকার 

১৬ নং ধারায় রাষ্ট্রের অধীনস্থ নিয়োগাদির ক্ষেত্রে আইনের সপক্ষে সাম্যনীতির অধিকার কীভাবে প্রযুক্ত হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে জাতি, স্ত্রী-পুরুষ, বংশধারা, বর্ণ, জন্মস্থান বা বাসস্থানের ভিত্তিতে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা চলবে না। নিয়োগ ছাড়াও বেতন, পদোন্নতি, ছুটি, পেনশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই নিয়ম কার্যকর হবে। এ প্রসঙ্গে দূর্গাদাস বসু মন্তব্য করেছেন যে, এই অধিকার কেবলমাত্র সম্প্রদায়গত বৈষম্যের বিরোধিতা করে না বরং স্ত্রীলোকদের ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রদর্শনের বিরুদ্ধেও রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।

সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সকলের সমানাধিকারের কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম

এক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম রয়েছে সেগুলি হল-

  • রাষ্ট্র তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য সরকারি চাকুরিতে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, দক্ষিণ রেলওয়ে বনাম রঙ্গচারী মামলার রায় অনুযায়ী, ৩৩৫ নং ধারা অনুসারে তপশিলি জাতি-উপজাতিদের জন্য চাকুরি সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকারি নীতি প্রশাসনিক দক্ষতার নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন এ কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে শতকরা ১৫ ভাগ সর্বভারতীয় চাকুরি তপশিলি জাতির জন্য এবং ৭১২ভাগ তপশিলি উপজাতির জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর সরকারি চাকুরিতে সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার কথা কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে।
  • পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করে যে-কোনো অঙ্গরাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অধীনে কোনো সরকারি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসগত শর্তকে অন্যতম শর্ত হিসেবে আরোপ করতে পারে [১৬ (৩) নং ধারা]।
  • রাষ্ট্র যদি মনে করে সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে তপশিলি জাতি উপজাতিদের মধ্যে থেকে যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব হয়নি সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র ওইসব চাকুরিতে উল্লিখিত জাতিভুক্ত কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য পদ সংরক্ষণ করতে পারে [১৬(৪) নং ধারা]। ২০০০ সালের ৮১ তম সংবিধান সংশোধন অনুসারে বলা যায়, এই পদগুলি যদি কোনো একটি নির্দিষ্ট বছরে পূরণ করা সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে সেই পদগুলি স্বতন্ত্র শূন্যপদ হিসেবে ধরা হবে। পরবর্তী যে-কোনো বছরগুলিতে সেই বছরের শূন্যপদ পূরণের সময় যদি পূর্বের শূন্যপদ পূরণ করা হয়, সেক্ষেত্রেও পূরণ হওয়া শূন্যপদগুলি সেই বছরের শূন্যপদ হিসেবে ধরা হবে না। এইরকমভাবে ৫০% পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থাটিকে মান্যতা দেওয়া হবে [১৬ (৪) খ নং ধারা]।
  •  ধর্ম বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত চাকুরি সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা, করা যেতে পারে [১৬(৫) নং ধারা]।
  • প্রশাসনিক দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করে তপশিলি জাতি এবং উপজাতিদের জন্য রাজ্য সরকারি বা কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরিতে সরকার অগ্রাধিকার প্রদান করতে পারে [৩৩৫ নং ধারা]।
  • উপরে বর্ণিত ব্যতিক্রমগুলি ছাড়াও মূল সংবিধানে আরও একটি ব্যতিক্রম ছিল। সেটি হল-পূর্বে ইঙ্গ-ভারতীয়দের জন্য বেশ কয়েকটি সরকারি পদ সংরক্ষিত ছিল। এই ব্যবস্থা নতুন সংবিধান কার্যকর হওয়ার পূর্বের ব্যবস্থা, যা ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বহাল রাখার ব্যবস্থা করা হয় [৩৬৫ নং ধারা]। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি থেকে এই বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়।

(1) অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধকরণ

অস্পৃশ্যতা দীর্ঘদিন ধরে সমাজজীবনে বিরাজ করেছিল। অস্পৃশ্যতা সমাজের এক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছিল। অবশেষে অস্পৃশ্যতাকে সমাজ থেকে মুছে ফেলার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সংবিধানের ১৭ নং ধারায় অস্পৃশ্যতার বিলোপসাধন এবং অস্পৃশ্যতা আচরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই ধারায় অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধকরণের দ্বারা যারা পূর্বে অস্পৃশ্য বলে গণ্য হতেন তাঁরা আইনের সমক্ষে সাম্যের অধিকারী হলেন। সুতরাং এই ধারণাটির দ্বারা পরোক্ষভাবে একটি অধিকার সৃষ্টি হয়েছে। সংসদে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে অস্পৃশ্যতাবিরোধী আইন পাস করা হয়। তারপর এই আইনটির কিছু সংশোধন হয়। এই আইনটির বর্তমান নাম হল ‘Protection of Civil Rights Act’. এই আইন অনুযায়ী কোনো ভারতীয়কে যদি অস্পৃশ্য বলে অপমান করা হয় বা তাকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় সেক্ষেত্রে তাকে আইনগত শাস্তি ভোগ করতে হয়।

এই আইনে আরও বলা হয়েছে যে অস্পৃশ্য বলে যদি কোনো ব্যক্তির উপরে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এ ছাড়া সর্বসাধারণের জন্য ব্যবহার্য রাস্তাঘাট, জল-কল, জলাধার, শ্মশান, গোরস্থান প্রভৃতি জায়গায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে অস্পৃশ্য বলে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, অস্পৃশ্যতা বিরোধী আইন সংবিধানে উল্লিখিত থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ ঘটে না। অস্পৃশ্যতা বর্তমানেও সমাজ থেকে মুছে যায় নি।

(2) উপাধি বা পদবি গ্রহণ নিষিদ্ধকরণ

সংবিধানের ১৮ নং ধারায় নাগরিকদের মধ্যে গণতন্ত্রসুলভ সাম্য প্রতিষ্ঠাকল্পে বলা হয়েছে যে, কোনো ভারতীয় নাগরিক দেশীয় বা বিদেশীয় পদবি বা উপাধি গ্রহণ করতে পারবে না, কিন্তু সামরিক বা শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক উপাধির ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। এখানে উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ প্রভৃতি উপাধি বিতরণ করেন।১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতের বিশিষ্ট নাগরিকদের সম্মানিত করার জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রী প্রভৃতি সম্মান বিতরণের ব্যবস্থা চালু করা হয়। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় এ সকল সম্মান উপাধি নয়।

কিন্তু অনেকের মতে, এ সকল সম্মান দ্বারা নাগরিকদের মধ্যে সাম্যনীতি আইনগতভাবে বিঘ্নিত না হলেও নীতিগতভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে জনতা সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে এসব উপাধি প্রদান করা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস (ই) – সরকার ক্ষমতাসীন হলে তা পুনরায় চালু করা হয়।

১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি এ এম আহমেদির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এক রায়ে ঘোষণা করেন যে, ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রী দেশের এই চারটি সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান কোনো খেতাব নয় শুধুমাত্র পুরস্কারমাত্র। তাই সরকার দেশের নাগরিকদের এই পুরস্কার দিলে তা সংবিধান-বহির্ভূত হবে না। তবে এ ধরনের পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যাতে যেমন খুশি কাজ না করে সেজন্য সুপ্রিমকোর্ট কিছু নির্দেশিকা বেঁধে দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, এই পুরস্কার দেওয়ার আগে প্রাপকদের যোগ্যতা খুঁটিয়ে দেখার জন্য কমিটির মাধ্যমে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় এবং রাজ্যস্তরে দুটি কমিটি তৈরি হবে।

জাতীয়স্তরে রাষ্ট্রপতির পরামর্শমতো প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার স্পিকার, সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ও বিরোধী দলনেতাকে নিয়ে এই কমিটি গঠিত হবে এবং রাজ্যস্তরে এই কমিটি রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী, বিধানসভার স্পিকার, হাইকোর্টের বিচারপতি ও বিরোধী দলনেতাকে নিয়ে গঠিত হবে। দুটি স্তরে মনোনীত ব্যক্তিদের নামের তালিকা তৈরি হওয়ার পর সেই তালিকা থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে জাতীয় কমিটির হাতে। জাতীয় কমিটি রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনা মতো সম্মানিত ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করবেন। কোনোক্রমেই ৪টি বিভাগ মিলিয়ে সম্মানপ্রাপকদের সংখ্যা ৫০-এর বেশি করা চলবে না। তা ছাড়া প্রাপকরা এসব পুরস্কারকে নামের আগে বা পরে ব্যবহার করতে পারবেন না। ঔপনিবেশিক শাসনকালে বংশানুক্রমিক আভিজাত্যপূর্ণ পদবী যেমন-মহারাজা, রায়বাহাদুর, রাজবাহাদুর, রায়সাহেব এবং দেওয়ান বাহাদুর-সহ সমস্ত কিছু ১৮ নং ধারায় বাতিলকরণ করা হয়েছে, কারণ এই উপাধিগুলি সাম্যের নীতির পরিপন্থী।

মূল্যায়ন

ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য সাম্যের অধিকারকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটি হল রাজনৈতিক সাম্য। সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এই সাম্যের অধিকারকে বাস্তবে রূপায়িত করতে হলে প্রয়োজন অর্থনৈতিক সাম্য এবং সেই সঙ্গে সামাজিক সাম্য। কারণ ধনবৈষম্য দূর না হলে আমাদের সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা কখনোই সম্ভব নয়। অধ্যাপক আর এন আগরওয়াল-এর মতে, সাম্যকে পূর্ণাঙ্গ চেহারা দিতে গেলে তার মধ্যে অবশ্যই অর্থনৈতিক সাম্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমান সুযোগসুবিধা না থাকলে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য বাস্তবে কার্যকরী হতে পারে না (‘Equality to be perfect must include economic equality. Without equal economic opportunities, political and social equality remains ineffective in the absence of economic equality.’)।

আরও পড়ুন – গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দাও

Leave a Comment