টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারের ফলাফলসমূহ
ধর্মীয়, প্রশাসনিক, পররাষ্ট্র -সকল ক্ষেত্রেই টমাস ক্রমওয়েলের সংস্কারমূলক পদক্ষেপের একাধিক ফলাফল পরিলক্ষিত হয়, যথা-
পোপবিরোধিতা
টমাস ক্রমওয়েলের উদ্যোগে ইংল্যান্ডে পোপবিরোধী পরিবেশ তৈরি হয়। ইংল্যান্ডের টিউডর অভিজাত সম্প্রদায় ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরিণত হয় রোমের পোপবিরোধী দলের সমর্থকে। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে পোপবিরোধী আইন পাস করায় পোপের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। পাশাপাশি ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ভাবধারা বিকশিত হয়।
ধর্মকর প্রদান থেকে অব্যাহতি
ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত ছোটো-ছোটো মঠগুলির ধ্বংসপ্রাপ্তির ফলে উক্ত অঞ্চলের সাধারণ দরিদ্র জনগণ ধর্মকর প্রদানের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে।
বেকারত্ব বৃদ্ধি
ইংল্যান্ডের বহু মঠ ধ্বংস করে ফেলায় মঠের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কর্মচ্যুত হন। যাজকরাও বেকার হয়ে যান। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রবল অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হন।
নতুন জমিদার শ্রেণির উৎপত্তি
ইংল্যান্ডের মঠগুলির বিপুল পরিমাণ জমি ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই সম্পত্তি রাজা তাঁর অনুগত অভিজাতদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। ফলে ইংল্যান্ডে এক নতুন জমিদার শ্রেণি গড়ে ওঠে।
বেষ্টনী প্রথা
ইংল্যান্ডের এই নতুন জমিদার শ্রেণির মধ্যে অনেকেই সেচের জমিগুলিকে বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। এইভাবে সংরক্ষণ করার পর তার সংলগ্ন অঞ্চলে পশুপালন শুরু হয় এবং পশমশিল্পেও উন্নতি ঘটতে থাকে। একে বেষ্টনী প্রথা বা Enclosure System বলা হয়।
রাজা ও পার্লামেন্টের ক্ষমতাবৃদ্ধি
ক্রমওয়েল রাজা অষ্টম হেনরিকে চার্চ-সহ, ইংল্যান্ডের যাবতীয় ক্ষমতা প্রদান করে তাঁকে সন্তুষ্ট করেন। এর পাশাপাশি তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গ্রেফতারি থেকে মুক্ত রাখা, সদস্য নির্বাচন, বিতর্কে হস্তক্ষেপ করা প্রভৃতি অধিকার প্রদান করার ফলে পার্লামেন্টের ক্ষমতা ব্যাপকমাত্রায় বৃদ্ধি পায়।
নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পটভূমি রচনা
ক্রমওয়েল ভবিষ্যতের জন্য যেভাবে সীমাবদ্ধ রাজতন্ত্র ও পার্লামেন্টের ক্ষমতার সম্প্রসারণের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন, তা স্টুয়ার্ট আমলে আরও সম্প্রসারিত হয়েছিল। পরবর্তীতে স্টুয়ার্ট বংশের রাজাদের ক্ষমতার হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটে এবং পার্লামেন্টের ক্ষমতা সুদৃঢ় হয়। অতঃপর ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে সূচিত গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র।
পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক ইংল্যান্ডের শাসনকাঠামোর বিকাশে টমাস ক্রমওয়েল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইংল্যান্ডে শক্তিশালী ও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ অনেকটাই এগিয়ে দেন তিনি। তাছাড়া রাজা অষ্টম হেনরিকে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি পার্লামেন্টকে বিভিন্ন অধিকার দান করে ভারসাম্য রক্ষা করেন। যদিও রাজশক্তিকে শক্তিশালী করতে গিয়ে ক্রমওয়েল অনেকক্ষেত্রেই নিজের জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে অসংখ্য ব্যর্থতা সত্ত্বেও স্বীকার করতেই হয় যে, তাঁর নীতি ও কার্যাবলির ফলেই ইংল্যান্ডে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
টমাস ক্রমওয়েলের পরিণতি
টমাস ক্রমওয়েল রাজতন্ত্রের সুদৃঢ়করণ, মধ্যযুগীয় পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় রাষ্ট্র গঠন এবং সর্বোপরি পার্লামেন্টের ক্ষমতার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে যে কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছিলেন, তা তাঁর কর্মজীবনের শেষদিকে এক শোচনীয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ক্রমওয়েলের কার্যাবলি বেশকিছু ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের জনগণের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। তাঁর গৃহীত বৈদেশিক নীতির বিরুদ্ধেও কালক্রমে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটতে থাকে। রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যেসকল সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করেছিলেন, তা বহুক্ষেত্রেই ছিল কঠোর ও নির্মম – ফলস্বরূপ তিনি নিজের জনপ্রিয়তা হারান।
মঠব্যবস্থার উচ্ছেদসাধনের বিরুদ্ধে উত্তর ইংল্যান্ডে সংঘটিত পিলগ্রিমেজ অফ গ্রেস নামক বিদ্রোহ ক্রমওয়েলের কর্তৃত্বের ভিত্তি অনেকাংশেই দুর্বল করে দিয়েছিল। ক্রমওয়েলের সঙ্গে নানাবিধ কারণে অভিজাত দলের নেতা নরফোক-এর ডিউক, লন্ডন ও উইনচেস্টারের বিশপগণের বিরোধ ঘটায় তাঁরা ক্রমওয়েলের গতিরোধ করতে সচেষ্ট হন। এমতাবস্থায় তাঁর পতন হয়ে ওঠে অনিবার্য। ইংল্যান্ডকে, স্পেন ও ফ্রান্সের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে ক্রমওয়েল জার্মানির রাজন্যবর্গের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
এই উদ্দেশ্য পূরণ করতে জার্মানির অ্যান অফ ক্লিভস (Anne of Cleves)-এর সঙ্গে তিনি ইংল্যান্ডরাজ অষ্টম হেনরির বিবাহের ব্যবস্থা করেন। তবে এই বিবাহ শেষপর্যন্ত স্থায়ী হয়নি। এর জন্য তিনি যথেষ্ট অপমানিত বোধ করেন এবং ক্রমওয়েলের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। অবশেষে যিনি রাজা অষ্টম হেনরিকে পরিণত করেছিলেন একজন ক্ষমতাবান ও সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী প্রশাসকে, সেই অষ্টম হেনরিই রাজদ্রোহের অভিযোগে ক্রমওয়েলকে অভিযুক্ত করেন। ক্রমওয়েল দোষী সাব্যস্ত হন এবং অ্যাক্ট অফ অ্যাটেন্ডার (Act of Attainder)-এর মাধ্যমে ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই তাঁকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এভাবে অবসান ঘটে একটি বর্ণময় কর্মজীবনের।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর