সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক আলোচনা করো

সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক আলোচনা করো

সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক আলোচনা করো
সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক আলোচনা করো

সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক

(1) সম্পর্ক

রাজনৈতিক তত্ত্বের আলোচনায় সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাম্য না থাকলে ন্যায় প্রতিষ্ঠা কখনোই সম্ভব নয়। যে সমাজে অসাম্য থেকে গেছে, সেখানে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। অন্যদিকে, যে সমাজে ন্যায়বিচারের কোনো সুযোগ নেই সেখানে কখনো সাম্য বিরাজ করতে পারে না। সুতরাং, সাম্য ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার, সাম্য প্রতিষ্ঠার একটি প্রধান শর্ত হল ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচারের দৃষ্টিভঙ্গিতে সব মানুষ সমান। ন্যায়ের ধারণা প্রত্যেক ব্যক্তিকে মানুষ হিসেবে মর্যাদামণ্ডিত করে।

(2) সাম্যনীতি ও ন্যায়

সাম্যের নীতি সবসময় যে ন্যায়কে নিশ্চিত করে তা কিন্তু নয়। এই কারণে ন্যায়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় সাম্যনীতি চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয় না। সাধারণ অর্থে সাম্য বলতে বোঝায় সকল রকম বৈষম্যের অনুপস্থিতি (Absence of all kind of discrimination) বা সমাজ থেকে বৈষম্যের অবলুপ্তি (Abolition of discrimination) রাজনৈতিক বা আইনগত ক্ষেত্রে এই নীতির প্রয়োগ কোনোরূপ বাধার সৃষ্টি করে না। কারণ, রাজনৈতিক সাম্য হল দেশের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সকলের অংশগ্রহণের অধিকার। অন্যদিকে, আইনগত সাম্য হল আইনের চোখে সমতা ও আইনের দ্বারা সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার।

কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যদি এই নীতি বাস্তবায়িত হয় তাহলে সমাজে কখনোই ধনী-গরিবের মধ্যেকার পার্থক্য ঘুচবে না। ফলে, যে দেশে মুষ্টিমেয় ধনী মানুষদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষ বাস করে সেখানে সাম্যনীতির ভিত্তিতে সবার জন্য সমান সুযোগ দেওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ল্যাস্কি মনে করেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অসাম্য বজায় রেখে প্রকৃত ন্যায় প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। এই কারণে এসব দেশে পিছিয়ে পড়া দুর্বল গরিব মানুষদের জন্য কিছু বিশেষ সুযোগসুবিধা বা অধিকারের সংরক্ষণ করা হয়। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় সংবিধানে সংরক্ষিত তপশিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির বিশেষ সাংবিধানিক ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়। এক্ষেত্রে বৈষম্যের নীতিকেই ন্যায়ের সহায়ক বলে গণ্য করা হয়।

এর মাধ্যমে পুঁজিপতি মালিকশ্রেণির শোষণ থেকে শ্রমিককে মুক্ত রাখা যায়, নিম্নবর্ণের ব্যক্তিকে উচ্চবর্ণের বঞ্চনা থেকে সুরক্ষা প্রদান করা যায়। তাই বলা যায়, আইনের দ্বারা দুর্বলের অনুকূলে অসাম্যমূলক ব্যবহার করা হলেও তা ন্যায়নীতির পরিপন্থী বা বিরোধী বলে বিবেচিত হয় না। বরং, আইন প্রণয়ন করে সমাজের অনগ্রসর, বঞ্চিত অংশের অনুকূলে বৈষম্যমূলক নীতি প্রণয়ন করে ন্যায়কে বাস্তবায়িত করা হয়।

(3) সমাজ পরিবর্তনের নিরিখে সাম্য ও ন্যায়

সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাম্যের নীতি সম্পর্কযুক্ত। ফলত, সমাজভেদে সাম্যের ধারণার পরিবর্তন হয়। একইভাবে সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে ন্যায়ের ধারণাও সম্পর্কিত ফলে সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনে ন্যায়ের ধারণাও পরিবর্তিত হয়। যেমন, প্রাচীন গ্রিসে একসময় ক্রীতদাস প্রথাকে ন্যায়সংগত ভাবা হত। সে যুগের মূল্যবোধ অনুসারে, অভিজাত পরিবারে ক্রীতদাস প্রথার অস্তিত্বকে মর্যাদার বিষয় বলে গণ্য করা হত। একে অন্যায় বলে ভাবা হত না। ক্রীতদাসরা সমস্ত রকম নাগরিক অধিকার ও সুযোগসুবিধা ভোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এতে যে সাম্যনীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে, তাও মনে করা হত না। পরে সমাজ ও যুগের পরিবর্তনের ফলে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে ক্রীতদাস প্রথা সাম্য ও ন্যায়নীতি লঙ্ঘনকারী অমানবিক আচরণ হিসেবে গণ্য হয়।

(4) ব্যক্তিজীবনের যোগ্যতার নিরিখে সাম্য ও ন্যায়

ব্যক্তিজীবনেও সাম্য ও ন্যায়ের তাৎপর্য সমান নয়। অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি তাঁর ‘A Grammar of Politics’ গ্রন্থে বলেছেন, সাম্য বলতে সব বিষয়ে সমতাকে বোঝায় না। ব্যক্তিজীবনে যোগ্যতা, গুণাবলি ও সামর্থ্যের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। তাছাড়া প্রকৃতিগতভাবে সব মানুষ সমান যোগ্যতার অধিকারী হয় না। তাই এক্ষেত্রে যদি জোর করে সাম্যনীতির প্রয়োগ ঘটানো হয়, তাহলে তা ন্যায়নীতিকে লঙ্ঘন করতে পারে। যেমন, একজন রাজমিস্ত্রি কখনোই সমাজের কাছে একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের সমান মর্যাদা দাবি করতে পারে না। ল্যাস্কি-র মতে, রাষ্ট্র যদি উভয়কে সমান মর্যাদা ও সমান স্বীকৃতি দেয়, তাহলে একদিকে যেমন প্রতিভার বিকাশ ঘটবে না, অন্যদিকে তেমনি সমাজে অগ্রগতিও হবে না। কাজেই যোগ্যতা দক্ষতা ও ক্ষমতার দিক থেকে মানুষে মানুষে পার্থক্যের কথা মনে না রাখলে ন্যায়নীতিকে সুনিশ্চিত করা যাবে না।

(5) পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক সমাজে সাম্য ও ন্যায়

পুঁজিবাদী সমাজে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে সমাজে যে অসাম্য সৃষ্টি হয়, তাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হয়। এর ফলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেড়ে যায়। পুঁজিবাদী সমাজে এ ধরনের আর্থিক অসাম্যকে অন্যায় বলে ভাবা হয় না। অন্যদিকে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্পদশালী ও সম্পত্তিহীনদের আর্থিক বৈষম্য ন্যায়কে বিঘ্নিত করে বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ, আর্থিক বৈষম্য ন্যায়ের আদর্শের পরিপন্থী হিসেবে বিবেচিত হয়।

(6) সাম্য ও ন্যায়ের সমন্বয়সাধনে রলস-এর ভূমিকা

সমাজে আর্থিক বৈষম্য দূর করতে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন নয়া সাম্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রলস। যিনি ন্যায়কে ন্যায্যতা দ্বারা বিচার করেছিলেন (Justice as fairness)। তাঁর ন্যায়তত্ত্বে তিনি স্বাধীনতা ও সুযোগ আয় ও সম্পদ এবং আত্মমর্যাদার মতো সামাজিক মূল্যবোধগুলিকে সমবন্টনের কথা বলেন। যদিও তাঁর তত্ত্ব আলোচনা করলে দুটি নীতির সন্ধান মেলে (যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে)। এই দুই নীতির মধ্যে প্রথমটি সকলের সমান স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত হলে, পরেরটি প্রতক্ষ্যভাবে ন্যায়নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। দ্বিতীয় নীতিটির দুটি অংশরয়েছে, যার প্রথম অংশটি পার্থক্যের নীতি (Difference Principle)। এই অংশ অনুযায়ী আর্থ-সামাজিক অসাম্যকে এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে, যাতে সর্বাপেক্ষা কম সুবিধা প্রাপ্তরা অধিক সুবিধা লাভ করে। এটি ‘ম্যাক্সিমিন নীতি’ হিসেবে পরিচিত।

এবং দ্বিতীয় অংশটি অনুযায়ী, আর্থ-সামাজিক অসাম্যগুলিকে এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে যাতে সমান সামর্থ্য ও দক্ষতাসম্পন্ন সব ব্যক্তিই যে- কোনো পদ ও মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ লাভ করতে পারো এই অংশটি সাম্যের সঙ্গে এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নীতিগত বৈষম্যকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এভাবে কিছু বিশেষ সময় বৈষম্যকেই ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ বলে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতে পশ্চাত্পদ জাতি উপজাতি নারী ও শিশুদের জন্য কিছু বিশেষ সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক ব্যক্তি, সময় ও অবস্থার প্রেক্ষিতে বদলে যায়। আর্নেস্ট বার্কার ‘ন্যায়’-কে একটি সমন্বয়কারী শব্দ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। কারণ, ন্যায়ের ধারণা স্বাধীনতা সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন করে ঐক্যবদ্ধ রূপ প্রদান করে। ন্যায় হল সেই লক্ষ্য, যার সঙ্গে সাম্যকে সাজুয্যবিধান করে চলতে হয়। যদিও ল্যাস্কি, বার্কার প্রমুখ মনে করেন ব্যক্তির মধ্যে যোগ্যতা, দক্ষতাজনিত পার্থক্য থাকার হেতু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সমাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই সাম্যের নীতি সমাজের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণ করার প্রেক্ষিতে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। তবে, যাই হোক না কেন ন্যায় ও সাম্য নীতি পরস্পরবিরোধী কোনো ধারণা নয়। বরং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাই সাম্য নীতির মূল লক্ষ্য। তাই সাম্য ও ন্যায় পরস্পরের বিরোধী নয়, পরস্পরের পরিপূরক ধারণা।

Read More – The Garden Party Question Answer

Leave a Comment