নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর

নৈতিক বিচারের কর্তা কে? “নৈতিক বিচার হল ঐচ্ছিক ক্রিয়ার বিচার”-আলোচনা করো।
নৈতিক বিচারের কর্তা
বিচার-বিবেচনা সম্পন্ন ব্যক্তি নৈতিক বিচারের কর্তা। বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি নিরপেক্ষ দর্শকরূপে কোনো ব্যক্তির আচরণ নৈতিক আদর্শের নিরিখে বিচার করবেন। আবার তিনি নিজেও নিজের আচরণের বিচার করবেন। এই জন্য মানুষ মন্দ কাজের জন্য অনুশোচনা করে, ভালো কাজ করে আনন্দ পায়। অবশ্য ম্যাকেঞ্জি ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন যে, যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নৈতিক বিচার করা হয়, সেই দৃষ্টিভঙ্গি নৈতিক বিচারের কর্তার। নৈতিক বিচার সাধারণ বিচার থেকে ভিন্ন। এটি মূল্যনিরূপক বিচার।
নৈতিক বিচারের বিষয়
নৈতিক বিচারের বিষয় হল ঐচ্ছিক ক্রিয়া, যা সমাজের বসবাসকারী মানুষের আচরণ। সবরকম অনৈচ্ছিক ক্রিয়া, শিশুর ক্রিয়া, উন্মত্ত ব্যক্তির ক্রিয়া, সমাজে বসবাস করে না এমন মানুষের ক্রিয়া-নৈতিক বিচারের বিষয় নয়। কেবল সমাজে বসবাসকারী আত্মসচেতন ব্যক্তির ঐচ্ছিক ক্রিয়ার, তা সৎ হোক বা অসৎ হোক, নৈতিক বিচার করা হয়।
ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার মধ্যে কোন্ প্রকার ক্রিয়া নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু?
কেবল ঐচ্ছিক বা স্বেচ্ছাকৃত ক্রিয়াই নৈতিক মূল্যায়নের বিষয়বস্তু। যে ক্রিয়া স্বেচ্ছাকৃত ও স্বনিয়ন্ত্রিত সেই ক্রিয়াকে ঐচ্ছিক ক্রিয়া বলে। ঐচ্ছিক ক্রিয়া সর্বদা বিশেষ উদ্দেশ্যমুখী হয়। এই ক্রিয়ার কর্তা সচেতনভাবে তার ক্রিয়াকে উদ্দেশ্যমুখী করতে সচেষ্ট হয়। ঐচ্ছিক ক্রিয়াকে ‘ভালো’ বা ‘মন্দ’ বলে অভিহিত করা যায়। কোনো ক্রিয়াকে যখন ‘ভালো’ বলা হয় তখন তার নৈতিক মূল্যায়ন করা হয়। আবার যখন কোনো ক্রিয়াকে ‘মন্দ’ বলা হয় তখনও তার নৈতিক মূল্যায়ন করা হয়।
আমাদের সকল ক্রিয়াকেই ‘ভালো’ বা ‘মন্দ’ বলে অভিহিত করা যায় না। যে ক্রিয়াকে ভালো বা মন্দ বলে বিচার করা যায় না সেই ক্রিয়া হল অনৈতিক ক্রিয়া। সকল অনৈচ্ছিক ক্রিয়া হল অনৈতিক ক্রিয়া। তাই অনৈচ্ছিক ক্রিয়া নৈতিক মূল্যায়নের বিষয়বস্তু হতে পারে না।
নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু-উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করো।
নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু
নৈতিক বিচারের বিষয় হল ব্যক্তির আচরণ। ব্যক্তির আচরণ বা স্বেচ্ছাকৃত কর্মের তিনটি স্তর রয়েছে। যথা- বাহ্যিক, মানসিক ও দৈহিক স্তর। বাহ্যিক ও মানসিক স্তরই কেবল নৈতিক বিচারের বিষয়, দৈহিক স্তর নৈতিক বিচারের বিষয় হতে পারে না। বাহ্যিক স্তর বলতে ফলাফলকে বোঝায় এবং মানসিক স্তর বলতে উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়কে বোঝায়। এখন প্রশ্ন হল উদ্দেশ্য না অভিপ্রায়-কোন্টি নৈতিক বিচারের বিষয়?
(1) উদ্দেশ্য নৈতিক বিচারের বিষয়: জেম্স মার্টিন্যু (James Martineau), জোসেফ বাটলার (Joseph Butler) প্রমুখ স্বজ্ঞাবাদীদের মতে, উদ্দেশ্যই (Motive) কেবল নৈতিক বিচারের বিষয় হতে পারে। তাদের মতে, কোনো কাজের নৈতিক মূল্য অর্থাৎ ভালো অথবা মন্দ নির্ভর করে ঐ কাজের উদ্দেশ্যের উপর। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ঐ কাজটি করা হয় তার উপর। যদি সৎ উদ্দেশ্যে কাজটি করা হয় তাহলে তা ‘ভালো’ কাজ এবং যদি অসৎ উদ্দেশ্যে কাজটি করা হয়, তাহলে তা ‘মন্দ’ কাজরূপে বিবেচ্য হবে। তাদের মতে, ‘সৎ উদ্দেশ্য অসৎ উপায়কে পরিশুদ্ধ করে।’ এই মত গ্রহণযোগ্য নয়, কেন-না এতে ন্যায়-অন্যায়ের সমস্ত প্রভেদ লুপ্ত হয়।
(2) উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায় উভয়ই বিচারের বিষয় : অভিপ্রায় (Intention) বলতে লক্ষ্যবস্তুর ধারণা বা উদ্দেশ্য, লক্ষ্যলাভের উপায় ও ফলাফলের চিন্তাকে বোঝানো হয়। কাজেই, কেবল উদ্দেশ্যকে নৈতিক বিচারের বিষয় বলা যাবে না, উদ্দেশ্যের সঙ্গে উপায় ও ফলাফলকেও যুক্ত করতে হবে। এই অর্থে অভিপ্রায়কেই নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু বলতে হয়। অর্থাৎ, কোনো কর্মের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়, উপায় ও ফলাফল ভালো হলে তা হবে ‘উচিত কর্ম’ এবং এগুলি মন্দ হলে তা হবে ‘অনুচিত কর্ম’। কাজেই উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু, কেবল উদ্দেশ্য নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু নয়।
অভিপ্রায়কে নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু বলা হয়েছে কেন?
অভিপ্রায় বলতে একটি কাজের উদ্দেশ্য, উপায় ও ফলাফলকে বোঝায়। উদ্দেশ্য হল অভিপ্রায়ের একটি অঙ্গ বা উপাদান। শুধুমাত্র উদ্দেশ্যকে নৈতিক বিচারের বিষয় বলা হলে দেখা যায় অনেক নীতিগর্হিত বা মন্দ কাজকেও ভালো বলতে হয়। যেমন- কোনো ব্যক্তির উদ্দেশ্য যদি হয় সংসার প্রতিপালন করা, তাহলে তার উদ্দেশ্য ভালো বলে তার কাজকে নৈতিক দিক থেকে ভালো বলতে হবে। কিন্তু ধরা যাক সে যে উপায় অবলম্বন করলো সেটি মন্দ। চুরি ডাকাতি করে যদি সংসার প্রতিপালন করে তাহলে তার কাজকে কি নৈতিক দিক থেকে ভালো বলা যাবে?
আবার কোনো ব্যক্তি যদি রেগে গিয়ে একজন ভিক্ষুকের দিকে একটি মুদ্রা নিক্ষেপ করে, তাহলে তার উদ্দেশ্যকে খারাপ বলতে হবে। কিন্তু ভিক্ষুকটি সেই মুদ্রা দিয়ে রুটি কিনে খেয়ে তার ক্ষুধার নিবৃত্তি করল। অর্থাৎ ফলাফল ভালো হলেও উদ্দেশ্য খারাপ হওয়ায় কাজটিকে নৈতিক দিক থেকে ভালো বলা যাবে না। তাই নিছক উদ্দেশ্য বা নিছক উপায় বা নিছক ফলাফল এই তিনটির কোনোটিকে এককভাবে নৈতিক বিচারের বিষয় বলা যাবে না। এই তিনটি একত্রে অর্থাৎ উদ্দেশ্য উপায় + ফলাফল = অভিপ্রায়। আর অভিপ্রায় হল নৈতিক বিচারের বিষয়।
ম্যাকেঞ্জির মতে নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু কী? এই মত কি গ্রহণযোগ্য?
ম্যাকেঞ্জির মতে ব্যক্তির অভিপ্রায় নয় ব্যক্তির সামগ্রিক চরিত্র নৈতিক বিচারের বিষয় এবং সাধারণত অভিপ্রায়কে চরিত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা যেসকল বিধি-নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হবে, তাতে ন্যায়ের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হবে।
অ্যারিস্টট্ল ন্যায়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, যারা সমান তাদের প্রতি একইরকম ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু যারা সমান নয় তাদের বিভিন্নতা অনুসারে তাদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করতে হবে। “Equals should be treated equally and unequals should be treated unequaly.” অর্থাৎ তিনি বলেন ন্যায় হল সকল মঙ্গলের সাক্ষী। তাই ন্যায়বিচারকে সর্বকালে সর্বাপেক্ষা উচ্চে অধিষ্ঠিত করা হয়।
ন্যায়বিচার (Justice) বলতে কী বোঝো?
ন্যায়বিচার (Justice) শব্দটির একাধিক বাংলা প্রতিশব্দ রয়েছে। যেমন-ন্যায়পরতা, ন্যায়, ন্যায্যতা ইত্যাদি। ‘ন্যায়বিচার’-এর আলোচনা সর্বপ্রথম করেছিলেন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (Plato) ও অ্যারিস্টটল (Aristotle)। প্লেটোর মতে, ন্যায়পরতা (Justice) কোনো স্বতন্ত্র ধর্ম নয়, মানবাত্মার তিনটি মৌলিক ধর্ম অর্থাৎ-প্রজ্ঞা (Reason), সাহসিকতা (Spirit) ও আত্মসংযম (Appetite)-এর সমন্বয় সাধনই হল ন্যায়পরতা।
(1) উপযোগবাদীরা (Utilitarianists) ন্যায়পরতা সংক্রান্ত আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ন্যায়পরতার ধারণা মুখ্য নয়, বরং গৌণ এবং এটি দ্বিতীয় স্তরের ধারণা। জেরেমি ব্যোম (Jeremy Bentham), জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) প্রমুখ এই মতের সমর্থক। তাদের মতে ব্যক্তি – স্বাধীনতায় (Individual Liberty) হস্তক্ষেপ করা অন্যায়। কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ তখনই সমর্থনযোগ্য হবে যখন তা সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক মঙ্গল বা কল্যাণ উৎপন্ন করতে পারে-এটিই তাদের মূল বক্তব্য।
(2) পরবর্তীকালে দার্শনিক জন রল্স (John Rawls) তাঁর ‘A Theory of Justice’ গ্রন্থে ন্যায়বিচার তত্ত্বের আলোচনায় এর দুটি রূপের কথা বলেছেন। যথা- সাধারণ রূপ এবং বিশেষ রূপ।
- ন্যায়পরতা বা ন্যায়বিচারের সাধারণ রূপ অনুসারে, সকল মানুষের মৌলিক অধিকার ও চাহিদাসমূহকে সমান সমান অংশে বণ্টন করতে হবে। তবে সমাজের কম সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের সুবিধা প্রদানের জন্য অসমতা নীতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
- ন্যায়বিচারের বিশেষ রূপ অনুসারে, নাগরিকদের দুটি মৌলিক অধিকার (স্বাধীনতা ও চাকরির সুযোগ-সুবিধা) বণ্টনের ক্ষেত্রে তিনি সমতা নীতি অনুসরণ করতে বলেছেন। কিন্তু অন্যান্য মৌলিক অধিকারসমূহ (ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদা, সম্পত্তি ও আয়, আত্মমর্যাদা) বণ্টনের ক্ষেত্রে বিভেদ নীতি অনুসরণ করতে বলেছেন। কাজেই রল্স ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে সমতা ও বিভেদ নীতি অনুসরণের কথা বলেছেন।
‘ন্যায়পরতা’ কয় প্রকার ও কী কী?
ন্যায়পরতার প্রকার
ন্যায়পরতাকে সাধারণত আমরা এভাবে শ্রেণীবিভক্ত করতে পারি-
(1) বণ্টনমূলক ন্যায়পরডা: বণ্টনমূলক ন্যায়ের ধারণা অনুসারে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধাকে সমাজের সদস্যদের মধ্যে ন্যায্যভাবে এবং সৎভাবে বণ্টন করা হয়। সমান কাজের জন্য যেখানে সমান মজুরি দেওয়া হয় না বা বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি সব সুবিধা ভোগ করায় অন্যরা বঞ্চিত হয়, সেখানে বণ্টনমূলক ন্যায়পরতার অভাব থাকে।
(2) প্রতিশোধমূলক অথবা সমষ্টিগত ন্যায়পরতা: অপরাধীকে যখন শাস্তি দেওয়া হয়, তখন অপরাধের সমমূল্যে যেন শাস্তি দেওয়া হয়। এইরূপ শাস্তির তত্ত্বকে বলা হয় প্রতিশোধমূলক শাস্তিতত্ত্ব। প্রতিরোধাত্মক শাস্তিতত্ত্বে অনেক সময় লঘুপাপে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়। এইরূপ শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক। আবার সংশোধনমূলক শাস্তিতত্ত্বে অপরাধীর আচরণ ও চরিত্রের সংশোধনই বড়ো কথা। সেখানে শাস্তির ধারণা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু প্রতিশোধাত্মক তত্ত্বে অপরাধীকে তার অপরাধের সমপরিমাণে শাস্তি দেওয়া হয় বলে তা ন্যায়সম্মত। এই তত্ত্বে বলা হয় “দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ”।
(3) ক্ষতিপূরণমূলক ন্যায়পরতা: যদি কোনো ব্যক্তিকে আঘাত করা হয় বা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করা হয়, তাহলে আঘাতকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আঘাতকারীকে আহত ব্যক্তির আঘাতের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তবেই সেখানে ন্যায্যতা রক্ষিত হবে।
ন্যায়পরতার চারটি মৌলিক ধর্ম কী কী?
সক্রেটিস ন্যায়পরতাকে একটি একক ধর্ম বলেছেন। প্লেটোর মতে ন্যায়পরতা একটি সমগ্র হলেও তা কয়েকটি মৌলিক ধর্মের সমন্বয়ে গঠিত- (1) জ্ঞান বা প্রজ্ঞা (Wisdom) (2) সাহসিকতা বা সংকল্পের দৃঢ়তা (Courage or Fortitude)(3) মিতাচার বা আত্মসংযম (Temperance or Selfcontrol) (4) ন্যায়পরতা (Justice)।
প্লেটোর মতে আত্মার উচ্চতম অংশের কাজ হল অপর দুটি অংশকে সঠিকভাবে চালনা করা। কোনো ব্যক্তিকে তখনই জ্ঞানবান বা প্রজ্ঞাবান বলা যাবে যদি সে বিশুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়ে আমার অবিশুদ্ধ অংশকে সঠিক পথের নির্দেশ দিতে পারে। প্রজ্ঞা, সাহসিকতা ও আত্মসংযম যথাযথভাবে পালিত হলে তবে ব্যক্তিত্বের সুষম বিকাশ হয়। সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এমন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি কখনও রাষ্ট্রীয় তহবিল তছরূপ করে না, অপরের সম্পদ চুরি করে না, বন্ধুর কাছে অবিশ্বাসী হয় না, দেশদ্রোহী হয় না বা অনুরূপ দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না।
ন্যায়বিচার সম্বন্ধে প্লেটোর তত্ত্ব ব্যাখ্যা করো।
প্লেটো ছিলেন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের ছাত্র। তিনি সংলাপের আকারে তাঁর বিভিন্ন দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেন। ‘The Republic’ গ্রন্থে তিনি তাঁর ন্যায়বিচারের তত্ত্ব কথোপকথনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন- যেখানে মুখ্য চরিত্র হলেন সক্রেটিস। প্লেটো এই গ্রন্থে একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। এইরূপ রাষ্ট্রে কেবল ন্যায়বিচার সম্ভব হয়। প্লেটোর ন্যায়বিচারের মুখ্য তত্ত্বগুলি নিম্নরূপ-
- প্রত্যেকের যা প্রাপ্য তাই যেন সে পায়।
- সমাজ ব্যক্তিকে যে স্থান এবং মর্যাদা দিয়েছে, সেই স্থানে অবস্থান করে এবং মর্যাদা অনুযায়ী তার কর্ম সম্পাদন করার পর ব্যক্তি ন্যায় পাওয়ার দাবি করতে পারে।
- প্রত্যেকে তার নিজের কাজ করে যাবে। যার অর্থ হল একজন নাগরিক অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।
- ন্যায় হল একপ্রকার সম্পর্ক। প্লেটো বর্ণিত সমাজে কয়েকটি শ্রেণি থাকবে। গতানুগতিকভাবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হলেও তারা সকলেই একই রাষ্ট্রের অর্থাৎ একই সমগ্রের অংশ। তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রের সেবা করবে এবং তার ফলে সমাজ অগ্রগতির স্বাদ গ্রহণ করবে।
- ন্যায়পরায়ণতা কোনো বিশেষ একটি শ্রেণির একান্ত নিজস্ব কোনো শ্রেণিধর্ম নয়। মিতাচার, ধৈর্য, প্রজ্ঞা এবং সাহসিকতা-এই গুণগুলির মধ্যে অন্তরীণ হয়ে থাকবে ন্যায়বিচার।
অ্যারিস্টটলকে অনুসরণ করে তাঁর ন্যায়পরায়ণতার শ্রেণিবিভাগ দেখাও। নির্দিষ্ট ন্যায়পরায়ণতার দুটি প্রকারভেদ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।
অ্যারিস্টট্লের মতে ন্যায়পরায়ণতার প্রকারভেদ
অ্যারিস্টটলের ন্যায় পরায়ণতাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- সম্পূর্ণ ন্যায়পরায়ণতা এবং নির্দিষ্ট ন্যায়পরায়ণতা।
সম্পূর্ণ ন্যায়পরায়ণতায় সমাজের প্রতিটি মানুষের একটি আচরণবিধি নিয়ে আলোচনা করা হয়। আর নির্দিষ্ট ন্যায়পরায়ণতা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদ, সম্মান, শ্রম ইত্যাদি সমবন্টনের কথা নিয়ে আলোচনা করে।
(1) নির্দিষ্ট ন্যায়পরায়ণতার প্রকারভেদ: নির্দিষ্ট ন্যায়পরায়ণতাকে অ্যারিস্টট্ল দুটি ভাগে ভাগ করেছেন- বণ্টনভিত্তিক ন্যায়বিচার এবং সংশোধনমূলক ন্যায়বিচার।
- বণ্টনভিত্তিক ন্যায়বিচার: বণ্টনভিত্তিক ন্যায়বিচার বলতে ব্যক্তির যোগ্যতা ও মান অনুসারে সরকারি কার্যালয়ের সমানুপাতিক বণ্টনকে বোঝানো হয়। এ ধরনের ন্যায়বিচারে প্রতিটি মানুষের মধ্যে তার প্রাপ্য সম্পদ আনুপাতিক হারে বণ্টিত হয়। অ্যারিস্টট্ল মনে করতেন যারা সদ্গুণের অধিকারী (Virtuous People) অর্থাৎ প্রজ্ঞা, শৌর্য ও দক্ষতার অধিকারী তাদের ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে সম্মান ও কার্যালয় প্রদান করা যাবে না।
- সংশোধনমূলক ন্যায়বিচার (Corrective Justice): এই প্রকার ন্যায়বিচার প্রধানত নীতিবাচক চরিত্রবিশিষ্ট এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই ন্যায়বিচারের লক্ষ্য হল সামাজিক অবিচারের ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি যা হারিয়েছে তা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রত্যেকের অধিকারের উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা।
অমর্ত্য সেনের ন্যায্যতা সংক্রান্ত তত্ত্ব আলোচনা করো।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর ন্যায্যতা সংকান্ত তত্ত্বে রলসের অনুসারী ছিলেন না। তিনি মনে করেছিলেন যথাযথ প্রতিষ্ঠান এবং ন্যায়ের নীতি নির্ধারণে অধিক মনোযোগী না হয়ে সমাজে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছে, মানুষ বাস্তবে কী জীবন কাটাচ্ছে এগুলি বিচার করা প্রয়োজন। যদিও এইসব বাস্তব অবস্থা প্রতিষ্ঠান এবং সূত্রাবলির উপর নির্ভরশীল। এই প্রতিষ্ঠান ও সূত্রাবলির অতিরিক্ত ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মানুষের বাস্তব আচরণের উপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর মতে প্রতিষ্ঠান এবং আর্দশ সামাজিক বন্দোবস্তগুলিকে চিহ্নিত করলে চলবে না। বাস্তব পরিণামগুলির দিকে নজর রাখতে হবে।
অমর্ত্য সেন যেন তাই প্রতিষ্ঠান ও নিয়মের অতিরিক্ত মানুষের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও তার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির প্রতি ন্যায় নির্ধারণের ক্ষেত্রে মনোযোগী ছিলেন। তিনি সম্রাট অশোক ও কৌটিল্যের ন্যায্যতা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
অমর্ত্য সেনের মতে ন্যায্যতার ধারণাটিকে যেভাবে দেখা দরকার তা হল-
- সমাজে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছে তার উপর দৃষ্টি আরোপ করা। শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসাগুলির মূল্যায়নে ঐকান্তিক মনোনিবেশ করা ঠিক নয়।
- ন্যায্যতার প্রশ্নে বিভিন্ন বিকল্পের তুলনামূলক বিচার করতে হবে। সম্পূর্ণ বা নিপুণভাবে ন্যায্য একটি ব্যবস্থার সন্ধান করলেই চলবে না। ন্যায্যতার তত্ত্বকে তিনি বাস্তব ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
আর্নেস্ট বার্কারের মতে, ন্যায়ের বিভিন্ন উৎসগুলি কী কী? ব্যাখ্যা করো।
আর্নেস্ট বার্কারের মতে ন্যায়ের উৎস
আর্নেস্ট বার্কারের মতে, ন্যায়বিচারের চারটি উৎস। যথা- ধর্ম, প্রকৃতি, অর্থনীতি এবং নৈতিকতা।
(1) ধর্ম: বার্কারের মতে, ধর্ম সমাজে এতটাই ক্রিয়াশীল যে, এটি প্রায়শই ন্যায়বিচারের উৎসরূপে কাজ করে। ধর্ম নৈতিক নীতি নির্ধারণ করে, যা রাষ্ট্রের প্রণীত আইনগুলিতে মূর্ত হয় এবং জাতীয় আইন হিসেবে সকলকে মেনে চলতে হয়।
(2) প্রকৃতি: প্রকৃতি হল নীতি, নৈতিকতা, যুক্তি, ঈশ্বর ও ধর্ম ইত্যাদির সংমিশ্রণ। প্রকৃতিকে ন্যায়বিচারের উৎসরূপে বিবেচনা করলে তা ‘উচিত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়।
(3) অর্থনীতি: বার্কারের মতে, আইনের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক যদি ইতিবাচক হয় তাহলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন বা সংস্কার ন্যায়বিচার অর্জনের একটি সম্ভাব্য কারণ হয়। ফলে ন্যায়বিচারের ধারণার সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক সত্য বলে আশা করা যায়।
(4) নৈতিকতা: বার্কারের মতে, সম্প্রদায়ের নৈতিক মান যদি সাধারণ নৈতিক বিবেক দ্বারা প্রয়োগ হয় তাহলে এটি ন্যায়বিচারের উৎস হতে পারে। সাধারণ নৈতিক বিবেক হল মূল্যবোধের সংশ্লেষণ। আর এই মূল্যবোধ আইনের ব্যক্তিসম্বন্ধীয় উৎস। এইভাবে সাধারণ নৈতিক বিবেক দ্বারা রাজনীতির নৈতিক মূল্যবোধগুলি বাস্তবায়িত হয়। এটিই হল আইনের মূল কারণ।
Read More – The Garden Party Question Answer