ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও

রাষ্ট্রের সূচনালগ্ন থেকেই রাষ্ট্রীয় কাজ তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা- আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বা সিদ্ধান্তগ্রহণ সম্পর্কিত কাজ, শাসন সংক্রান্ত কাজ এবং বিচার সম্পর্কিত কাজ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটলও গ্রিসের নগররাষ্ট্রের কার্যাবলিকে তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই তিনটি ভাগ হল সিদ্ধান্তমূলক বা Deliberative, শাসন সংক্রান্ত বা Magisterial এবং বিচার সম্পর্কিত বা Judiciall আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেও সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করার জন্য প্রধান তিনটি বিভাগ রয়েছে- শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় বহুকাল আগে রাষ্ট্রের এই তিনটি বিভাগের ক্ষমতার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে একটি নীতি গড়ে ওঠে। একে বলা হল ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে সরকারের তিনটি বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল বক্তব্য হল, রাষ্ট্রপরিচালনার তিনটি প্রধান স্তম্ভ শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার সম্পূর্ণ পৃথক্করণ। তিনটি বিভাগ পরস্পর থেকে পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার পাশাপাশি এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করবে না।
শুধু তাই নয়, একই পদাধিকারী ব্যক্তি একাধিক বিভাগের পদে কোনোভাবে আসীন থাকতে পারবে না। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রোমান দার্শনিক সিসেরো ও পলিবিয়াস, ষোড়শ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক জাঁ বোদা, ব্রিটিশ চিন্তাবিদ জন লক্ এবং হ্যারিংটন প্রমুখ। পরবর্তীকালে অষ্টাদশ শতকের ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মস্তেস্কু (Montesquieu) ও ব্রিটিশ আইনজ্ঞ (Jurist) স্যার উইলিয়াম ব্ল্যাকস্টোন (Blackstone) তাঁদের রচনায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটান।
(1) বাস্তব প্রয়োগ
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের সর্বপ্রথম বাস্তব প্রয়োগ ঘটে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে। মার্কিন সংবিধান রচয়িতারা এই নীতির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং মার্কিন সংবিধানের ১, ২ ও ৩ নং ধারায় যথাক্রমে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগীয় যাবতীয় ক্ষমতা তিনটি বিভাগের হাতে পৃথকভাবে ন্যস্ত করেছিলেন। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের গণপরিষদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করে। এ ছাড়া ব্রাজিল, কানাডা, আর্জেন্টিনা, চেক প্রজাতন্ত্র, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশে এই নীতি অনুসৃত হতে দেখা যায়।
সংজ্ঞা
সাধারণ অর্থে সরকারের তিন ধরনের কাজ তিনটি পৃথক বিভাগ কর্তৃক স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হওয়ার নীতিকে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলা হয়। এই নীতি অনুযায়ী, সরকারের তিনটি বিভাগ স্ব-স্ব বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্বগুলি সম্পাদন করবে এবং এক বিভাগ অপর বিভাগের কার্যে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করবে না। যথা-আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করবে, শাসন বিভাগ আইনের বলবৎ বা বাস্তবায়ন করবে এবং বিচার বিভাগ আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করবে। এভাবে সরকারের প্রধান তিন বিভাগ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বলতে কেবলমাত্র সরকারের তিনটি বিভাগের স্বাতন্ত্র্যকে বোঝায় না, একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের স্বতন্ত্রীকরণকেও বোঝায়।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের অভিমত
১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে মন্তেস্কু তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Spirit of Laws’ প্রকাশিত করেন। এই গ্রন্থে তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, সরকারের মূল তিনটি কাজ যথাক্রমে আইন প্রণয়ন, আইনের বাস্তবায়ন (প্রশাসন) ও বিচারকার্য সম্পাদন-তিনটি পৃথক বিভাগের মাধ্যমে সম্পাদিত হওয়া উচিত। ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্যই তিনি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির আবশ্যকতার কথা বলেন। মতেষু-র অভিমত হল, আইন ও প্রশাসনের ক্ষমতা যদি কোনো একজন মাত্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বৈরাচারী আইন প্রণয়ন করে তাকে যথেচ্ছভাবে প্রয়োগ করতে পারে। এর ফলে, ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
কাজেই ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির স্বীকৃতি আবশ্যক। মন্তেস্কু তাঁর ‘The Spirit of Laws’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন, “When the Legislative and Executive powers are united in the same person or in the same body of magistrate, there can be no liberty”। মূলত সমকালীন (১৭৪৮ খ্রি.) ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করে মন্তেঙ্কু ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বের প্রচার করেন। তিনি তাঁর জোরালো বক্তব্য পেশ করে বলেন যে, সরকারি ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করে ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে হলে, সরকারের তিনটি প্রধান কাজের দায়িত্ব তিনটি পৃথক বিভাগের হাতে তুলে দিতে হবে।
মন্তেস্কু মনে করতেন, সরকারি স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করে ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রধান তিনটি কাজের দায়িত্ব তিনটি পৃথক বিভাগের হাতে তুলে দিতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্ল্যাকস্টোন তাঁর ‘Commentaries on the Laws of England’ গ্রন্থে প্রায় অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম ম্যাডিসন ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি উদারভাবে গ্রহণ করার পক্ষে জোরালো যুক্তি দেখিয়ে বলেন আইন, শাসন ও বিচারের সমস্ত ক্ষমতা একই বিভাগের হাতে থাকলে, তা স্বৈরাচারিতায় পর্যবসিত হয়। অন্য ভাষায়, সকল ক্ষমতার পুঞ্জীকরণকে সঠিক অর্থে স্বৈরাচারিতার সংজ্ঞা বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। (The accumulation of all powers… in the same hands may justly be pronounced as the very definition of tyranny’)।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিপক্ষে যুক্তি
অষ্টাদশ শতকে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলেও ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এই নীতির বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা শুরু হয়। সমালোচনাগুলি হল-
(1) বাস্তবায়ন দুরূহ
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ প্রয়োগ বাস্তবে আদৌ সম্ভব নয়। কারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারের প্রধান তিনটি বিভাগকে কখনোই পুরোপুরি পৃথক করা যায় না। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকারের তিনটি প্রধান বিভাগ মূলত পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই সরকার পরিচালনা করে থাকে। সংসদীয় ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি একাধিক বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। যেমন-ভারত ও ব্রিটেনের মন্ত্রীপরিষদচালিত শাসনব্যবস্থায় দেখা যায়, মন্ত্রীরা একদিকে যেমন শাসন বিভাগের কার্যাবলি সম্পাদন করছেন, অন্যদিকে তেমনি আইনসভার সদস্য হিসেবে আইন প্রণয়নের কাজেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন।
অনুরূপভাবে, ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভারতের রাষ্ট্রপতি, ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় রাজা বা রানি একদিকে যেমন শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ, অন্যদিকে তেমনি আবার আইনসভার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ডসভা ব্রিটেনে সর্বোচ্চ আপিল আদালত হিসেবে কাজ করে। ফলে সমালোচকদের মতে, কঠোর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সম্ভবও নয়, কাম্যও নয়।
(2) প্রায়োগিক সমস্যা
সরকারের তিনটি বিভাগকে এমন কিছু কার্যসম্পাদন করতে হয়, যা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুযায়ী অন্য বিভাগের কাজ। যেমন-সাধারণভাবে আইন প্রণয়ন করা কেবল আইন বিভাগের দায়িত্ব, কিন্তু আইনসভার অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন কোনো জরুরি বা আপৎকালীন অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য শাসন বিভাগকে অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স (ordinance) জারি করতে হয়, যা আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের মতোই কার্যকরী। ভারতের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করেন।
এ ছাড়াও বর্তমানে আইনসভার কাজকর্ম যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে আইনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি নির্ধারণের ভার আইনসভা শাসন বিভাগের হাতে তুলে দেয়। শাসন বিভাগের প্রণীত এ ধরনের আইনকে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন বা Delegated Legislation বলা হয়। অনুরূপভাবে, বিচারকার্য সম্পাদন করতে গিয়ে অনেকসময় চলতি আইন যথেষ্ট বলে মনে না হলে, বিচারপতিরা আইনের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যার মাধ্যমে নতুন আইন সৃষ্টি করেন। একে বিচারপতিদের দ্বারা প্রণীত আইন বলা হয়।
অন্যদিকে, শাসন বিভাগের হাতেও বিচারের কিছু কাজ থাকে। যেমন রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক দণ্ডিত অপরাধীর শাস্তি মকুব বা হ্রাস ইত্যাদি। ব্রিটেন ও ফ্রান্সে প্রশাসনিক ন্যায়বিচার (Administrative Justice)-এর অস্তিত্ব রয়েছে, এর মাধ্যমে শাসন বিভাগের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের অন্যায় আচরণের বিচার ও শান্তিদান করা হয়। কাজেই এ থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে, পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বর্তমানে আধুনিক রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব এবং এই নীতি প্রযুক্ত হলে এক বিভাগ কর্তৃক অপর বিভাগের কাজ করা সম্ভবপর হবে না। এজন্য সমালোচকদের মতে, তত্ত্বগতভাবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত করার কথা বলা হলেও তা কার্যকরীভাবে বাস্তবে প্রয়োগ করা অসম্ভব।
(3) পূর্ণ প্রয়োগ অনভিপ্রেত
জন স্টুয়ার্ট মিল, মুন্টস্ট্সি, ফাইনার, ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির পূর্ণ প্রয়োগ আদৌ কাম্য নয়। অধ্যাপক ল্যাস্কি-র মতে, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করলে, এই স্বাতন্ত্র্য বিভাগীয় দায়বদ্ধতাকে নষ্ট করবে এবং পারস্পরিক বিরোধ ডেকে আনবে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পীঠভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বয়ং ম্যাডিসন ও অন্য যুক্তরাষ্ট্রীয়পন্থীরা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে প্রশাসন অচল হয়ে পড়বে।
আসলে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাস্তবে কার্যকর হলে, তা সরকারের বিভাগগুলির মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয় অপেক্ষা পারস্পরিক বিরোধের জন্ম দেবে বলে আশঙ্কা করা হয়। এর ফলে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হবে, বিভাগগুলির দক্ষতা, উৎকর্ষতা খর্ব হবে। এ প্রসঙ্গে ফাইনার-এর মত উল্লেখ্য। তিনি বলেছেন, এই নীতিটি প্রযুক্ত হলে সরকার কখনো মূর্ছিত হয়ে পড়বে, কখনো আবার ধনুষ্টংকার রোগীর মতো অসহায়ভাবে হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করবে।
(4) জৈব মতবাদীদের বক্তব্য
বিখ্যত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্লুন্টস্ট্সি-র মতে, সরকার হল জীবদেহের মতো। দেহ থেকে মস্তিষ্ককে পৃথক করলে জীবদেহের মৃত্যু যেমন অবশ্যম্ভাবী, ঠিক তেমনি সরকারে প্রধান বিভাগগুলিকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করলে সরকারের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
(5) ব্যক্তিস্বাধীনতার বিপন্নতা
ব্যক্তিস্বাধীনতার দিক থেকেও পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সমীচীন নয়। গিলক্রিস্ট, স্যাবাইন প্রমুখ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে মেনে নেননি। কারণ, পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের প্রয়োগের ফলে আইন বিভাগ যদি স্বৈরাচারী হয় তবে তার দ্বারা প্রণীত স্বৈরাচারী আইনকে কার্যকর করতে শাসন বিভাগ যেমন বাধ্য থাকে, তেমনি সেই আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করতে বিচার বিভাগও বাধ্য। সুতরাং, পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা কখনো অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে না। বরং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচটি হল সচেতন জনগণ ও স্বাধীনতার অনুকূল পরিবেশ গঠন। এ কারণেই ব্রিটেনে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত না হলেও ব্রিটিশ জনগণ অন্যান্য উদারনৈতিক দেশের অনুরূপ অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে।
(6) সংসদীয় গণতন্ত্রে অকার্যকর
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি মনে করে যে, সরকারের তিনটি বিভাগের ক্ষমতা সমান। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণত আইন বিভাগ অন্য দুটি বিভাগ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতার দাবি রাখে। সংসদীয় গণতন্ত্রে আইনসভা হল চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তাছাড়া আইন বিভাগ যথাযথভাবে আইন প্রণয়ন না করলে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়তে পারে। এই কারণে পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কখনোই সমীচীন বা কাম্য হতে পারে না। সর্বোপরি, যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বা মন্ত্রীসভাচালিত শাসনব্যবস্থা রয়েছে যেমন, গ্রেট ব্রিটেন, ভারত, প্রভৃতি দেশ সেখানে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে পৃথক্করণ কখনোই সমীচীন বা কাম্য হতে পারে না।
সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগকে আইন বিভাগের জনপ্রিয় কক্ষ বা জনপ্রতিনিধি কক্ষের নিকট দায়বদ্ধ থাকতে হয় আবার সংগঠিত দলব্যবস্থা গড়ে ওঠার দরুণ শাসন বিভাগ আইন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে সক্ষম হয়। ফলে সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম অনুসারে, আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগকে সবসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়।
(7) অসমীচীন
অনেকে মনে করেন, সরকারি কাজকর্মের দক্ষতা ও সফলতা অর্জনের কারণেও পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সমীচীন নয়। কারণ সরকারের দক্ষতা ও সাফল্য প্রধান তিনটি বিভাগের পারস্পরিক সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু, পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ফলে তিনটি বিভাগ যদি একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে তাহলে সরকারের কাজকর্ম কখনোই সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না।
(8) অসংগতি
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটি যে দেশের সংবিধানে প্রথম গৃহীত হয়, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তত্ত্বগতভাবে তিনটি বিভাগকে পুরোপুরি পৃথক করে দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন, রাষ্ট্রপতি শাসন বিভাগের প্রধান হলেও বিচারপতিদের তিনি নিয়োগ করেন। বিচারপতিরা আবার প্রয়োজন মনে করলে রাষ্ট্রপতির নির্দেশ বাতিল করে দিতে পারেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ভিটো (veto) ক্ষমতা প্রয়োগ করে আইনসভা প্রণীত আইন বাতিল করে দিতে পারেন।
অনুরূপভাবে, মার্কিন আইনসভার উচ্চকক্ষ সিনেট সরকারি কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির নির্দেশনামা অনুমোদন না করলে তা কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হয় না, এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত আন্তর্জাতিক সন্ধি, চুক্তিগুলিও সিনেটের অনুমোদন ছাড়া কার্যকর হয় না। বস্তুত, সংসদীয় বা রাষ্ট্রপতিশাসিত যে ধরনের সরকারই হোক না কেন, বর্তমান বিশ্বে দলব্যবস্থার প্রভাবের ফলে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এ অবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ প্রয়োগ কখনোই সম্ভব নয়।
(9) মার্কসবাদী সমালোচনা
মার্কসবাদী সমালোচকরা সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বের সাফল্য সম্পর্কে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। মার্কসবাদীদের মতে, অসমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকার এক বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে চলে। সরকারের প্রত্যেক বিভাগই শাসকগোষ্ঠীর শ্রেণিস্বার্থ – সংরক্ষণের কাজ করে। কাজেই এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির – প্রয়োগ অর্থহীন। এ কারণেই গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশের সরকারি কাঠামোতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসৃত হয়নি।
(10) ন্যায়বিচারের পরিপন্থী
সমালোচকদের মতে, এই নীতির প্রয়োগে সুফল অপেক্ষা কুফলই বেশি পরিলক্ষিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচার বিভাগকে সরকারের অন্য দুই অঙ্গ আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ থেকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে কয়েকটি রাজ্যের হাইকোর্টের বিচারপতিদের জনভোটে নির্বাচিত করার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। এক্ষেত্রে বিচারপতিরা জয়লাভের আশায় রাজনৈতিক দলের শরণাপন্ন হন। ফলে তাঁদের কাছে ন্যায়বিচারের আশা করা যায় না। তাই বলা যায়, এই নীতি ন্যায়বিচার বাস্তবায়নের পরিপন্থী।
(11) জনকল্যাণ বিরোধী
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত হলে সরকারের বিভাগগুলি দায়িত্ব সম্পাদনের পরিবর্তে নিজ ক্ষমতা সংরক্ষণের ব্যাপারে অধিক সচেতন হয়ে উঠবে এবং সংকীর্ণ বিভাগীয় স্বার্থ গুরুত্ব পাবে, যা বৃহত্তর সাধারণ স্বার্থ ও জনকল্যাণকে ব্যাহত করবে বলে সমালোচকরা মনে করেন।
(12) দুর্বল সরকার
একটি দেশের শাসন ব্যবস্থাকে সফল করতে হলে সরকারের তিনটি প্রধান বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা থাকা আবশ্যক। কিন্তু, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত হলে বিভাগীয় ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। সীমিত ক্ষমতার ভিত্তিতে কোনো বিভাগ শক্তিশালী হতে পারে না, যা বিভাগীয় দুর্বলতা সৃষ্টি করে এবং দুর্বল সরকারের জন্ম দেয়।
(13) জটিল শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি
এই নীতি বাস্তবায়িত হলে বিভাগীয় ক্ষমতার পরিধি, অবশিষ্ট ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে শাসনকার্যে জটিলতা ও বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে।
(15) দায়বদ্ধতার অভাব
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সরকারী বিভাগগুলির মধ্যে দায়িত্বহীনতার জন্ম দেয় বলে সমালোচকরা মনে করেন। বিভাগগুলি তার অক্ষমতার দায়ভার অন্য বিভাগের উপর চাপিয়ে দায়ভার থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করবে, যা তাদের ক্রিয়াকলাপে ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধহীনতা সৃষ্টি করবে।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান রাজনৈতিক তত্ত্বের আলোচনায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির গুরুত্ব পূর্বের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন, বাস্তবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ প্রয়োগ কখনোই সমীচীন হতে পারে না। কিন্তু, তা সত্ত্বেও এই তত্ত্বকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা যায় না। এই নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, সরকারের সকল ক্ষমতা যদি একক হস্তে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে, তাহলে স্বৈরাচারী সরকারের সৃষ্টি হবে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা বিঘ্নিত হবে। এজন্য কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আংশিক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগের কথা বলেন। বিশেষত, বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার জন্য এবং সমাজে ন্যায় সুনিশ্চিত করার স্বার্থে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের এক্তিয়ার থেকে বিচার বিভাগের স্বতন্ত্র অবস্থান একান্ত প্রয়োজন।
Read More – The Garden Party Question Answer