রুশোর রাষ্ট্রচিন্তার মূল্যায়ন

রুশোর রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্ব রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু তবুও এই তত্ত্ব পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয়।
ত্রুটি
- যুক্তিহীন বিষয়বস্তু: রুশোর সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের বেশকিছু বুদ্ধিজীবীগণ রুশোকে যুক্তিহীন বিষয়বস্তুর স্রষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
- স্বৈরাচারী উপাদানের উপস্থিতি: রুশোর তত্ত্বে অনেকেই স্বৈরাচারী। উপাদানের অস্তিত্ব রয়েছে বলেই মনে করেন। বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell) স্বৈরাচারী শাসকের শাসনকে জোর করে প্রজাদের উপর চাপানোর জন্য রুশোকে বলেছেন Ideological Godfather of Hitler. ল্যাস্কি, হবহাউস (Leonard Hobhouse), ম্যাকাইভার (Robert Morrison Maciver) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও রুশোর চিন্তাধারায় স্বৈরাচারী উপাদান খুঁজে পেয়েছেন।
- সংশয়পূর্ণ মতবাদ: রুশোর দর্শন সংশয়পূর্ণ মতবাদ হিসেবেও গবেষক মহলে সমালোচিত। তাঁর দর্শন কোনও সুনির্দিষ্ট পথকে নির্দেশ করে না। তিনি কখনও গণতন্ত্র, কখনও সমাজতন্ত্র আবার কখনও সর্বাত্মক রাষ্ট্রচিন্তার প্রবক্তা। একদিকে রুশো গণ সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব প্রচার করেন; অন্যদিকে রাষ্ট্রের অবাধ ক্ষমতা ও আইনসভার শ্রেষ্ঠত্বের কাছে সরকারকে মাথা নোয়াতে বলেন, যা তাঁর সর্বাত্মক রাষ্ট্রচিন্তার পরিচায়ক।
গুরুত্ব
(i) গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার পথিকৃৎ
রুশো ছিলেন গণতান্ত্রিক চিন্তাধারার অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর সাধারণ ইচ্ছা-র তত্ত্ব ছিল এক যুগান্তকারী তত্ত্ব। রাষ্ট্রীয় কাজে জনসাধারণের ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে রুশোই প্রথম গণতন্ত্রের সুউচ্চ আদর্শ, জনগণের সার্বভৌমিকতা প্রভৃতি বিষয়গুলি তুলে ধরেন।
(ii) সাম্য ও স্বাধীনতা
রুশোর দর্শনে উল্লিখিত সাম্য ও স্বাধীনতার বিষয়টি ইউরোপের রাষ্ট্রচিন্তার জগতকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তিনি সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি ও সমষ্টির বিরোধকে তুলে ধরেননি; বরং তুলে ধরেছেন সামাজিক ঐক্যের সন্ধানে সাধারণ ইচ্ছার প্রতি রাষ্ট্রীয় আনুগত্যকেই।
(iii) সার্বভৌম ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সমন্বয়
রুশো তাঁর তত্ত্বে সার্বভৌমিকতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সমন্বয়সাধন করে, রাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন।
(iv) অবাধ স্বাধীনতার বিরোধী
রুশো অবাধ স্বাধীনতাকে কোনোদিন সমর্থন করেননি। বৃহত্তর সমাজের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেই মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। নৈরাজ্য নয়, রুশো শৃঙ্খলার মধ্যেই স্বাধীনতাকে দেখেছিলেন।
(v) ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণা
তাঁর রাষ্ট্রদর্শন ছিল ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণা। তাঁর বিভিন্ন বাণী, যেমন- স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার, সকল মানুষই সমান, জনগণই সার্বভৌম প্রভৃতি সমসাময়িক কালের সাধারণ মানুষকে সম্মোহিত করেছিল। গেটেল-এর মতে, বুশো ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি সমসাময়িক ফরাসি সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে রুশোর তত্ত্ব হল রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ। ফরাসি বিপ্লব ছাড়া অন্যান্য অনেক বিপ্লবেও তাঁর তত্ত্ব দেখিয়েছে শোষণ থেকে মুক্তির পথ। দার্শনিক টি এইচ গ্রিন (TH Green)-এর মতে, রুশোর তত্ত্বের প্রভাব আমেরিকার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠাকারীদের মধ্যেও পড়েছিল। স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল অতুলনীয়। বুশো বারবার বলেছেন সামগ্রিক কল্যাণই রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্মে জনগণকে যুক্ত করার ইচ্ছা রুশোকে গণতন্ত্রপন্থী দার্শনিকদের উপরে স্থান দিয়েছে।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর