লকের রাষ্ট্রচিন্তার মূল্যায়ন

ত্রুটি
জন লকের রাষ্ট্রচিন্তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।
(i) নতুনত্ব বা মৌলিকত্বের অভাব
লক তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র, দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা, গণ-সার্বভৌমিকতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। অনেকে মনে করেন, লক এগুলির মধ্যে কোনও বিষয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মৌলিকত্ব দাবি করতে পারেন না।
(iii) স্ববিরোধিতা
স্বাভাবিক অধিকারের কথা বলার পাশাপাশি লক সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়ায়, তাঁর বক্তব্য স্ববিরোধিতা দোষে দুষ্ট। অন্যদিকে লক একইসঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং সমাজের সকল ব্যক্তির কল্যাণসাধনের উপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু নিজের সুখ কামনা করে কখনোই সমাজের মঙ্গলসাধন ঘটানো সম্ভব নয়।
(iv) অস্পষ্ট বক্তব্য
লক তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে বারংবার জনগণের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কীভাবে জনগণের ইচ্ছা প্রাধান্য পাবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রাখেননি। ‘জনগণ’ শব্দের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যাও তাঁর তত্ত্বে কোথাও পাওয়া যায়নি।
(v) সামাজিক বৈষম্য
লক সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে মূলত বৈষম্যমূলক সমাজকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। এর ফলে তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাম্যের তত্ত্ব গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
(vi) পুঁজিবাদী সমাজের স্বার্থরক্ষা
লক যেভাবে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার প্রহরী হিসেবে রাষ্ট্রকে তুলে ধরেছেন, তাতে পরোক্ষে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানই সমর্থিত হয়েছে। অনেকের মতে, তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা ছিল পুঁজিবাদী সমাজের স্বার্থে রচিত তত্ত্ব। প্রখ্যাত রাষ্ট্রতাত্ত্বিক সি বি ম্যাকফারসন (CB Macpherson) এক্ষেত্রে লককে বুর্জোয়া চিন্তানায়ক বলে সমালোচনা করেছেন।
(v) এলিটিস্ট রাজনীতির সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয়
শ্রমিক, ভৃত্য, দাস, বেকার বা কর্মহীন প্রমুখ মানুষদের লক রাজনৈতিক সমাজের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। এইভাবে লক গণতন্ত্রের আড়ালে এলিটিস্ট (Elitist) রাজনীতির সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন বলে অনেকে সমালোচনা করে থাকেন।
(vi) স্বাভাবিক অধিকার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা
সমালোচকদের মতে, লকের স্বাভাবিক অধিকারের ধারণাটি সঠিক নয়। কারণ, যে-কোনো অধিকারের ভিত্তি হল রাষ্ট্রীয় আইন। প্রকৃতির রাজ্যে যেহেতু কোনও রাষ্ট্র ছিল না, তাই কোনও আইনও ছিল না। তাই এক্ষেত্রে অধিকারের অস্তিত্ব থাকা সম্ভবপর নয়।
(vii) সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত বিতর্ক
লক তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় জনগণকে রাজনৈতিক সার্বভৌম ক্ষমতা প্রদান করলেও, তাদের আইনগত সার্বভৌমিকতার উপর প্রতিষ্ঠা করেননি।
গুরুত্ব
লকের রাষ্ট্রচিন্তায় কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও এই তত্ত্বের গুরুত্বকেও অস্বীকার করা যায় না।
(i) লকের অভিনবস্তু
জন লকের রাষ্ট্রভাবনায় যথেষ্ট অভিনবত্ব ছিল। অধ্যাপক ম্যাক্সি (Maxey) বলেছেন যে, রাষ্ট্রচিন্তার জগতে জন লকের বিশিষ্ট আসন অধিকার করার কারণ হল, পূর্বের প্রচলিত বিক্ষিপ্ত ও অসংলগ্ন তত্ত্বগুলিকে তিনি অসাধারণ মুনশিয়ানার সঙ্গে একসূত্রে গেঁথেছিলেন। তাছাড়া তিনিই প্রথম মানুষের রাজনৈতিক অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ ইত্যাদি বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছিলেন।
(ii) প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রর ভিত্তি
লকের রাষ্ট্রচিন্তায় আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আভাস পাওয়া যায়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। লকের তত্ত্ব অনুসারে- সরকার খামখেয়ালিভাবে আইন রচনা করতে পারে না। মালিকের সম্মতি ছাড়া সরকার কোনও সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতেও পারে না। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি গণতান্ত্রিক সরকারের নিশ্চয়তা প্রদান করে। লকের মতে- ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য নয়, রাষ্ট্রই ব্যক্তির মঙ্গলের জন্য দায়বদ্ধ, যা পালন করতে ব্যর্থ হলে জনগণ সরকার পরিবর্তন করতে পারে। এতে অবশ্য জনগণের অধিকার সুরক্ষিত হয়েছে, যা হল গণতন্ত্রের সারকথা।
(iii) মধ্য ও আধুনিক যুগের সংমিশ্রণ
লকের রাষ্ট্রচিন্তায় মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের চিন্তার সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে অনেকে তাঁকে মধ্যযুগের অন্যতম শেষ প্রবক্তা এবং আধুনিক যুগের অন্যতম পথপ্রদর্শক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মধ্যযুগীয় ধারা অনুসরণ করে সম্পত্তির অধিকারকে ‘পবিত্র অধিকার’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অপরদিকে আধুনিক মানসিকতার পরিচয় দিয়ে তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতা, উদারনীতিবাদ প্রভৃতি তত্ত্বেরও প্রচার করেছেন।
(iv) দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা
লক বলেছেন যে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে তার যাবতীয় কার্যাবলির জন্য জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হবে। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ যদি জনগণের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তারা প্রতিষ্ঠিত শাসকের বিরোধিতা করে নতুন শাসককে অধিষ্ঠিত করতে পারে।
(v) আইনের শাসন
লকের চিন্তাধারায় উঠে আসে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে আইনের শাসনের অধীনে আনার বিষয়টি, যা পরবর্তীকালে আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রে আইনের শাসনের সূচনা ঘটিয়েছিল।
(vi) রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য
লক তাঁর তত্ত্বে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে নির্দিষ্ট পার্থক্য করেছেন এবং গণসম্মতির উপর সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা ল্যাস্কির (Harold Laski) মতে, ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে স্থায়ী আসন দখল করে রেখেছে।
(vii) সমসাময়িক জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন
The Rise of European Liberalism গ্রন্থে ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন যে, লকের তত্ত্বে সমসাময়িক মানুষের প্রত্যাশা, যেমন- শান্তি, স্বাধীনতা, কর্তৃত্ব, উদারতা ইত্যাদি প্রতিফলিত হয়েছে। এ ছাড়া ল্যাস্কি এমনও বলেছেন যে, সমকালের দাবি অনুযায়ী লক ধর্ম, চার্চ বা রোমান শাসনের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে পরিহার করে রাজনীতি নিয়ে চর্চা করেছেন।
(viii) স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্ব
স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব হল জন লকের উল্লেখযোগ্য এক তত্ত্ব। তাঁর মতে, ব্যক্তিজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল তার জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা। কীভাবে এই অধিকার সরকার কর্তৃক সুনিশ্চিত করা হয়, তার উপর ভিত্তি করেই তিনি রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের বিষয়টি বিচার করেছেন।
সবশেষে বলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে জন লকের অবদান ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। গেটেলের (Gettell) মতে, লকের রাষ্ট্রদর্শন ছিল যথার্থই নিয়ন্ত্রিত ও বাস্তববাদী (Moderate and Practical) I পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, এমনকি মস্তেস্কু, রুশোর তত্ত্বেও লকের মতবাদের প্রভাব স্পষ্ট। সুতরাং, আধুনিক উদারনৈতিক ও জনসমর্থনপুষ্ট রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা গঠিত হওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় জন লকের অবদান চিরস্মরণীয়।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর