ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্য গুলি লেখো ( Exclusive Answer)

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ছিল বৈদিক শিক্ষার উন্নত রূপ। এই শিক্ষার সঙ্গে জীবনের যোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। গুরুগৃহে থাকাকালীন গুরুর কাছে থেকে শিক্ষার্থীরা আত্মসংযম এবং আত্মশৃঙ্খলার দীক্ষায় দীক্ষিত হত। ইন্দ্রিয়কে দমন করে যোগসাধনার মাধ্যমে জাগতিক আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে নিজেকে নির্লিপ্ত করার বিদ্যালাভ করত তারা। ধ্যান-যোগের দ্বারা মনকে জাগতিক চিন্তাভাবনা থেকে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত করে নেওয়ার ক্ষমতার নাম চিত্তবৃত্তিনিরোধ। এই অবস্থাতে পৌঁছোতে পারলে তবেই আত্মোপলব্ধি সম্ভব। তাই পণ্ডিতরা বৃত্তিনিরোধকেই ব্রাহ্মণ্য ভারতের শিক্ষাদর্শনরূপে অভিহিত করেন।

ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্য
ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

(1) শিক্ষার লক্ষ্য: 

ব্রাহ্মণ্য যুগে শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে তিনটি বিষয়ে আলোকপাত করতে হয়।

  1. ব্রাহ্মণ্য দর্শন-ভিত্তিক শিক্ষা: ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতেই সে যুগে শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা গড়ে উঠেছিল। অজ্ঞানতাই বন্ধন, জ্ঞানই মুক্তি-এই ছিল আর্য ঋষিদের মত, তাই প্রাচীন ঋষিরা শিক্ষা বলতে বুঝিয়েছেন অন্ধকার থেকে আলোকের পথে উত্তরণ, বন্ধন থেকে মুক্তি। তাই শুধু জ্ঞান অর্জন করা নিরর্থক, অনুশীলন ও প্রয়োগের মধ্য দিয়ে জ্ঞান রূপান্তরিত হবে শক্তিতে। সুতরাং, মননের সাহায্যে নিজের ও পরমাত্মার শক্তিকে আবিষ্কার করাই প্রকৃত শিক্ষা।
  2. আত্মোপলব্ধির শিক্ষা: বৈদিক ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার চরম লক্ষ্য ছিল আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধি। জাগতিক বিষয়কে ঋষিরা জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করেননি। সুখ ও দুঃখের অতীত এক উপলব্ধির সন্ধান তাঁরা করেছেন, নিজেদের স্বরুপকে জানতে চেয়েছেন। পূর্ণতার মধ্য দিয়েই এই স্বরূপকে জানা যায়। এই পূর্ণতালাভই হল শিক্ষার লক্ষ্য। তাই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ‘শিক্ষা’র সংজ্ঞায় বলেছেন মানুষের মধ্যেকার পূর্ণতার প্রকাশই হল শিক্ষা। ধর্মভিত্তিক আর্যসমাজে ধর্মকে বলা হয়েছে মানবাত্মার শ্রেষ্ঠ বিকাশ। এই মানবাত্মার তিনটি দিক-জ্ঞানের দিক, অনুভবের দিক এবং প্রকৃতির দিক। বৈদিক ব্রাহ্মণ্য যুগের প্রেক্ষিতে তাই শিক্ষার লক্ষ্য হল তিনটি- [i] জ্ঞানের দিক থেকে সেই মানবাত্মাকে পূর্ণভাবে জানা; [ii] অনুভবের দিক থেকে সেই মানবাত্মার সঙ্গে ভক্তিপ্রীতির সম্বন্ধ স্থাপন করা এবং [iii] প্রকৃতির দিক থেকে সেই পূর্ণজ্ঞান ও ভক্তিকে মিলিয়ে দেওয়া।
  3. পরা ও অপরাবিদ্যা: ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় আত্মার মুক্তি জীবনের চরম লক্ষ্য হলেও ব্যাবহারিক জীবনের প্রয়োজনীয় শিক্ষা সম্পর্কে আর্য ঋষিরা উদাসীন ছিলেন না। তাঁরা দু-প্রকারের শিক্ষার কথা বলেছেন-পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা। ব্রহ্মবিদ্যা বা অধ্যাত্মবিদ্যাই পরাবিদ্যা আর যাবতীয় বিজ্ঞান, শিল্পকলা হল অপরাবিদ্যা। পরা ও অপরাবিদ্যা উভয়কেই অনুশীলন করতে হবে। পরাবিদ্যার লক্ষ্য হল আত্মার মুক্তি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সব শিক্ষার্থীকে গৃহের বন্ধন কাটিয়ে গার্হস্থ্য আশ্রমকে ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিতে হবে। এই গার্হস্থ্য জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় লৌকিক বিদ্যা (অপরাবিদ্যা) শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার চরম লক্ষ্য পরাবিদ্যা হলেও অপরাবিদ্যাকে সেখানে অবহেলা করা হয়নি।

(2) আনুষ্ঠানিক বিদ্যারম্ভ: 

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় তপোবনে অবস্থিত গুরুগৃহই ছিল বিদ্যার্থীর পুণ্যতীর্থ। পাঁচ বছর বয়সে চূড়াকার্য বা চৌলকর্মের (ধর্মীয় অনুষ্ঠান) মধ্য দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য শিশু যথাক্রমে আট বছর, এগারো বছর এবং বারো বছর বয়স পর্যন্ত গৃহে পিতার তত্ত্বাবধানে শিক্ষাগ্রহণ করত। এরপর উপনয়নের মধ্য দিয়ে আর্য শিশু বিদ্যাগ্রহণের উপযুক্ত হত। নবজন্ম হত তার। তাকে বলা হত দ্বিজ। দ্বিজ হলে সে গুরুর কাছে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করত। বর্ণভেদে উপনয়নের বয়স ও সময়কাল নির্দিষ্ট ছিল। ব্রাহ্মণ সন্তানদের আট, ক্ষত্রিয়দের এগারো বছর ও বৈশ্যদের বারো বছর বয়সে উপনয়ন হত। অপরাধী ও শূদ্রদের উপনয় অনুষ্ঠান হত না।

(3) ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার প্রতিষ্ঠান-গুরুকুল: 

বৈদিক ব্রাহ্মণ্য যুগের বিদ্যালয় ছিল গুরুকুল। গুরুর কাছে ছাত্ররা সমবেত হত। একজন গুরুকে কেন্দ্র করে এক-একটি গুরুকুল গড়ে উঠত। সে যুগে গ্রন্থ ছিল না। গুরুই শিষ্যপরম্পরায় জ্ঞানের ভাণ্ডার সচল রাখতেন। পরা ও অপরা বিদ্যার্জন, কিংবা চরিত্রগঠন কোনোটিই গুরুর সান্নিধ্য ছাড়া সম্ভব ছিল না। গুরুকুলমাত্রেই যে অরণ্যে অবস্থিত ছিল এমন নয়, অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন গৃহী এবং অধিকাংশ গুরুকুল ছিল জনপদ বা লোকালয়ে।

(4) ব্রহ্মচর্য: 

ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস-এই চারটি অধ্যায় নিয়ে গঠিত ছিল চতুরাশ্রম। এর মধ্যে ব্রহ্মচর্য ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কাল। উপনয়নের পর তরুণ ব্রহ্মচারী গুরুগৃহে যেত। সমগ্র শিক্ষাকাল গুরুগৃহে থাকতে হত। গুরুগৃহে বাসকালে চিন্তায়, বাক্যে ও কর্মে ব্রহ্মচারীকে সংযত জীবনযাপন করতে হত। কঠোরভাবে নিয়ম পালন করতে হত। নিয়মপালনের দুটি দিক ছিল-শারীরিক ও আধ্যাত্মিক। গুরুর আগে শিষ্যকে ঘুম থেকে উঠতে হত। গুরু ঘুমোতে যাওয়ার পর শিষ্য ঘুমোতে যেত, সকালে গুরু ঘুম থেকে ওঠার আগে শিষ্য বিছানা ছেড়ে, স্নান সেরে, আহ্নিক করে, গুরুর সেবায় রত থাকত।

গুরুর গৃহে যজ্ঞের আগুন যাতে নিভে না যায়, সেজন্য সমিধ বা যজ্ঞের কাঠ সংগ্রহ করত শিষ্য। গোধন রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও গুরুর গৃহের দৈনন্দিন কাজে শিষ্যকে অংশগ্রহণ করতে হত। শিষ্যকে সর্বদা সংযত ও ইন্দ্রিয়সুখ থেকে বিরত থাকতে হত। সবরকম স্বাচ্ছন্দ্য বর্জন করতে হত। নৃত্য, গীত, বাদ্য থেকে দূরে থাকত হত। সমস্ত শিক্ষার্থী ব্রহ্মচারীকে ভিক্ষা করতে হত। সমাজের দরিদ্রতম ঘরের সন্তানদেরকেও সে যুগে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হত না।

ব্রহ্মচর্যে শিক্ষার্থীকে উপর্যুক্তভাবে জীবনযাপন করতে হত বলে ব্রহ্মচর্যকে বৈদিক ভারতে শিক্ষার সমার্থক বলে মনে করা হত। সব শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই ব্রহ্মচর্য ছিল অবশ্য পালনীয়। নারীদের শিক্ষার অধিকার থাকায় কুমারী শিষ্যাও ব্রহ্মচর্য পালন করতে পারত।

(5) বাৎসরিক অধ্যয়নকাল: 

প্রতি বছর চার মাস থেকে সাড়ে পাঁচ মাস বা ছয় মাস ধরে শিক্ষাকার্য চলত। শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন ‘উপাকর্ম’ উৎসবের মধ্য দিয়ে পাঠ শুরু হত এবং চলত পৌষ মাস বা মাঘ মাস পর্যন্ত। তারপর দীর্ঘ বিরতি; সাধারণত মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের প্রথম দিন ‘উৎসর্জন’ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বাৎসরিক অধ্যয়ন শেষ হত।

(6) দীর্ঘসময়ব্যাপী শিক্ষা: 

বেদশিক্ষার জন্য অত্যন্ত দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হত। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায়, উপযুক্ত বয়সে গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ করার সুযোগ সৃষ্টির জন্য সমস্ত বেদ পড়া শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক ছিল না।

(7) অবৈতনিক শিক্ষা: 

প্রাচীন বৈদিক শিক্ষা ছিল অবৈতনিক। বেতন নেওয়া ছিল অনৈতিক। দরিদ্রতম শিক্ষার্থীকেও গুরু ফিরিয়ে দিতে পারতেন না। শিক্ষাশেষে অবশ্য স্নাতক গুরুদক্ষিণা দিতেন। এক্ষেত্রেও গুরুর অনুমতি নিয়ে সাধ্যমতো দক্ষিণা দিতে হত। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন না নিয়েও যাতে আচার্য সুষ্ঠুভাবে তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে পারেন, সমাজ সে ব্যবস্থা করেছিল। বিভিন্ন যাগযজ্ঞ, নানারকম অনুষ্ঠানে রাজা এবং বিত্তবানরা আচার্যদের প্রচুর অর্থ দিতেন। এমনকি অনেক সময় গ্রামও দান করা হত।

(8) বর্ণভেদে পাঠক্রম নির্ধারণ: 

ব্রাহ্মণ্য যুগে বর্ণভেদে শিক্ষার পাঠক্রম নির্দিষ্ট ছিল। বিভিন্ন বর্ণের উপযোগী বৃত্তিশিক্ষা পাঠক্রমে স্থান পেয়েছিল। প্রথম দিকে সকলেই বেদপাঠের অধিকারী ছিল। পরে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য দুই বর্ণের পাঠক্রমে বেদ গৌণ স্থান অধিকার করে। পরে এরা বেদপাঠের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

  1. ব্রাহ্মণদের পাঠক্রম: শতপথ ব্রাহ্মণে পাঠক্রমের একটি বিস্তৃত তালিকা আছে। যেখানে বেদ, বেদাঙ্গ ছাড়াও বিদ্যা, বাকবাক্যম (তর্কশাস্ত্র), ইতিহাস, পুরাণ, গাথা, সর্পবিদ্যা, বৃক্ষবিদ্যা ও অসুরবিদ্যার উল্লেখ আছে। এ ছাড়া দৈব, নিধি, ভূতবিদ্যা (পদার্থবিদ্যা ও জীববিদ্যা), নক্ষত্রবিদ্যা, দেবজান (নাচ, গান, বাজনা) প্রভৃতি বহু বিদ্যার উল্লেখ আছে। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রতিটি শিক্ষার্থীকেই সমস্ত বিদ্যা অর্জন করতে হত না। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই সাধারণভাবে বেদপাঠ ও মৌলিক আচার পালনের জন্য যজ্ঞীয় আচরণ সম্পর্কে শিক্ষা পেয়েই সন্তুষ্ট থাকত। বেদ, বেদাঙ্গ ছাড়া ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের বৃত্তি সম্পর্কেও ব্রাহ্মণ শিক্ষার্থীকে পারদর্শিতা লাভ করতে হত।
  2. ক্ষত্রিয়দের পাঠক্রম: বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য যুগের প্রথম দিকে ক্ষত্রিয় সন্তান উপনয়নের পর গুরুগৃহে বেদপাঠ করত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে ক্ষত্রিয়রা বেদবিদ্যা পরিহার করতে শুরু করে। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর মধ্যে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সম্প্রদায় বেদশিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ক্ষত্রিয়কে প্রধানত তার জাতিগত বৃত্তি ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হতে হত। তারা তরবারি, তীরধনুক, ভল্ল প্রভৃতির ব্যবহার অনুশীলন করত। অস্ত্রবিদ্যা ছাড়াও তাদের যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল শিখতে হত।
  3. বৈশ্যদের পাঠক্রম: কৃষি ও বাণিজ্য ছিল বৈশ্যদের বৃত্তি। বিভিন্ন বৃত্তি অনুসারে সমাজ বহু শাখায় বিভক্ত ছিল। এক-একটি সম্প্রদায় এক-একটি বৃত্তি শিখত। বৈশ্যকে শস্য বপন, জমির গুণাগুণ নির্ণয়, পশুপালন, বিভিন্ন প্রথায় ওজন, ক্রয়বিক্রয়ের নিয়ম, দ্রব্য সংরক্ষণের উপায়, বিভিন্ন প্রকার রত্নের ও ধাতুর মূল্য নির্ধারণ করতে শিখতে হত। উচ্চতর শিক্ষার জন্য সমস্ত বর্ণের শিক্ষার্থীরা তক্ষশিলা, নালন্দায় যেত। সেখানে চিকিৎসাবিদ্যা, মনোবিদ্যা, কৃষি-বাণিজ্য, হিসাবরক্ষা, নৃত্য, গীত, চিত্রকলা ইত্যাদি শিখত তারা।
  4.  শূদ্রদের পাঠক্রম: শূদ্রের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্য যুগে দেখা যায় না। শূদ্রের বেদপাঠের অধিকার ছিল না। দৈহিক পরিশ্রমসাধ্য কাজ নির্দিষ্ট ছিল তাদের জন্য। তিন বর্ণের সেবায় এবং কৃষি, পশুপালন প্রভৃতি কাজে তাদের নিয়োগ করা হত। বেদে শূদ্রের অধিকার না থাকলেও পুরাণে অধিকার ছিল। বংশগত পারিবারিক বৃত্তিতে হাতেকলমে ব্যাবহারিক শিক্ষার ব্যবস্থা এদেরও ছিল।

(9) মন্ত্রোচ্চারণ ও ব্যাখ্যা-নির্ভর শিক্ষাপদ্ধতি: 

প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় গুরু কখনও ব্যক্তিগতভাবে, কখনও সমষ্টিগতভাবে শিক্ষা দিতেন। সমষ্টিগতভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও গুরু প্রতিটি ছাত্রের সামর্থ্য বিচার করে শিক্ষা দিতেন। বৈদিক শিক্ষার পাঠ্যবস্তু ছিল মন্ত্র। সুতরাং স্বাভাবিক শিক্ষণপদ্ধতি ছিল আবৃত্তি। গুরু দুটি কি তিনটি শব্দ উচ্চারণ করতেন। শিক্ষার্থীরা গুরুর আবৃত্তির পর সমস্বরে আবৃত্তি করত। আবৃত্তির সাথে ব্যাখ্যার ব্যবস্থাও ছিল। প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ ও শুদ্ধির ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হত। গুরু প্রতিটি শ্লোকের ব্যাখ্যা দিতেন। তার পর প্রশ্ন ও বিচার হত। প্রতিপাদ্য বিষয় বিচার ও বিতর্কের পরই গ্রহণ করা হত। মনন ও নিদিধ্যাসনের দ্বারা শিক্ষার্থী তার জীবনসত্যকে উপলব্ধি করত। গভীরভাবে চিন্তা করাকে বলা হয় ‘মনন’। নিদিধ্যাসনের অর্থ হল একাগ্রচিত্তে ধ্যানের মাধ্যমে সত্যকে উপলব্ধি করা। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা যুক্তিনির্ভর হওয়াতে শিক্ষায় প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। গল্পের মাধ্যমেও শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি ছিল।

(10) ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক: 

প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষক তথা গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। শিষ্য গুরুকে দেবতার মতো ভক্তিশ্রদ্ধা করত এবং গুরু শিষ্যকে নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। গুরু পক্ষপাতশূন্যভাবে স্বগৃহে বিনা বেতনে অকুণ্ঠ চিত্তে শিষ্যদের জ্ঞান দান করতেন। গুরু ছিলেন ধৈর্য, সহিষুতা ও জ্ঞানের প্রতিমূর্তি।

(11) নিয়মানুবর্তিতা: 

বৈদিক শিক্ষার আদর্শ ও পদ্ধতির পরিপ্রেক্ষিতে নিয়মানুবর্তিতার কোনো সমস্যা ছিল না। শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল আত্মানুভূতি ও পরিপূর্ণতা, তাই শিক্ষার পরিবেশ ছিল শান্ত ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল একাগ্রতা। কাজেই বৈদিক যুগে শিক্ষা ও নিয়মানুবর্তিতা ছিল সমার্থক।

(12) মূল্যায়ন পদ্ধতি: 

প্রাচীন শিক্ষায় পরীক্ষাব্যবস্থা ছিল না। বিতর্কসভার মধ্য দিয়েই পান্ডিত্যের পরীক্ষা হত। বৈদিক গ্রন্থে এই বিতর্ককে বলা হয় ব্রহ্মোদয়। তপোবন, রাজ্যসভা ও যজ্ঞক্ষেত্রে বিতর্ক বা আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হত। এর মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞানের মূল্যায়ন হত।

(13) আনুষ্ঠানিক শিক্ষাসমাপ্তি: 

সমাবর্তন উৎসবের মধ্য দিয়ে গুরুগৃহে বাসের সমাপ্তি পর্ব সূচিত হত। পাঠ শেষ করে বিদ্যার্থী তার সাধ্যমতো গুরুদক্ষিণা দিয়ে গুরুর সন্তুষ্টিবিধানের পর গুরুর অনুমতি নিয়ে গৃহে ফিরে আসত। স্নাতক ছিল তিন শ্রেণির- বিদ্যা-স্নাতক, ব্রত-স্নাতক এবং বিদ্যাব্রত-স্নাতক।

যিনি বেদ অধ্যয়ন করেছেন কিন্তু সমস্ত ব্রত পালন করেননি, তাঁকে বিদ্যা-স্নাতক বলা হত। যিনি সমস্ত ব্রত পালন করেছেন, কিন্তু সমস্ত বেদ পাঠ করেনি তাঁকে বলা হত ব্রত-স্নাতক। আর যিনি সমস্ত বেদ পাঠ করেছেন এবং সমস্ত ব্রত পালন করেছেন তাঁকে বলা হত বিদ্যাব্রত-স্নাতক।

সমাবর্তন উৎসব যথেষ্ট জাঁকজমকপূর্ণ হত। স্নান করে, নতুন বস্ত্র পরিধান করে, গলায় মালা পরে, রথে বা হাতিতে চড়ে বিদ্যার্থী সমাবেশে উপস্থিত হত। পণ্ডিতদের কাছে গুরু তাঁকে স্নাতক বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন। শিক্ষাশেষে সমাবর্তন উৎসবে ভবিষ্যৎ জীবনে চলার পথে পাথেয় হিসেবে যে উপদেশ গুরু শিষ্যকে দিতেন তা সর্বকালে সর্বদেশে শ্রেষ্ঠ আচরণীয় ধর্ম বলে বিবেচিত হত।

আরও পড়ুনLink
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তরClick Here
চার্বাক সুখবাদ প্রশ্ন উত্তরClick Here
পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা প্রশ্ন উত্তরClick Here

Leave a Comment