অধিকারের প্রকারভেদ আলোচনা করো

অধিকারের প্রকারভেদ আলোচনা করো

অধিকারের প্রকারভেদ আলোচনা করো
অধিকারের প্রকারভেদ আলোচনা করো

অধিকারের প্রকারভেদ

সাধারণভাবে অধিকারকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে একটি হল নৈতিক অধিকার (Moral Rights) এবং অপরটি হল আইনগত অধিকার (Legal Rights) ।

(1) নৈতিক অধিকার

যেসব অধিকার সামাজিক ন্যায়নীতিবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, তাদের নৈতিক অধিকার (Moral Rights) বলা হয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, নৈতিক অধিকার ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে পারে না। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শুধুমাত্র বিবেকের দংশন অনুভব করেন এবং সমাজের কাছে নিন্দিত হন মাত্র। যেমন-বৃদ্ধ অবস্থায় সন্তানের কাছে ভরণপোষণ পাওয়ার নৈতিক অধিকার পিতামাতার রয়েছে, কিন্তু কোনো সস্তানের আচরণে এই অধিকার লঙ্ঘিত হলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কিছু করার থাকে না। কাজেই নৈতিক অধিকার রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত নয়।

(2) আইনগত অধিকার

অন্যদিকে যেসব অধিকার আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত হয়, তাদের আইনগত অধিকার (Legal Rights) বলে। আইনগত অধিকার লঙ্ঘিত হলে রাষ্ট্র ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে পারে। যেমন, ভোটদান করার অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার। এই অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করলে, রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দিয়ে থাকে। আইনগত অধিকারকে প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। পৌর অধিকার (Civil Rights), রাজনৈতিক অধিকার (Political Rights), অর্থনৈতিক অধিকার (Economic Rights) এবং সামাজিক ও কৃষ্টিগত অধিকার (Social and Cultural Rights) ।

পৌর অধিকার

যেসকল সুযোগসুবিধা ব্যতীত মানুষের পক্ষে সভ্য সামাজিক জীবনযাপন করা সম্ভব নয়, তাকে পৌর অধিকার (Civil Rights) বলে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য পৌর অধিকার একান্তভাবে অপরিহার্য। নিম্নলিখিত পৌর অধিকারসমূহ সভ্য সমাজে উল্লেখযোগ্য।

(1) বাঁচার অধিকার

মানুষের বাঁচার অধিকার (Right to Life) হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌলিক অধিকার। বাঁচার অধিকারকে অনেকে মানুষের সহজাত অধিকার বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুতপক্ষে, বাঁচার অধিকার না থাকলে অন্য কোনো ধরনের অধিকার ভোগ সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাঁচার অধিকার বলতে আত্মরক্ষার অধিকার এবং আত্মরক্ষার প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের অধিকারকেও বোঝায়। পৃথিবীর প্রত্যেক সভ্য রাষ্ট্রে বাঁচার অধিকার নাগরিকদের প্রধান মৌলিক অধিকাররূপে স্বীকৃত ও সংরক্ষিত।

(2) স্বাধীনতার অধিকার

আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিক জীবনের অন্যতম প্রধান অধিকার হল স্বাধীনতার অধিকার (Right to Freedom)। ব্যক্তিসত্তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য স্বাধীনতার অধিকার অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত যেসকল অধিকারকে স্বাধীনতার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে চিন্তা ও, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার, স্বাধীনভাবে সংঘ বা সমিতি গঠন করার অধিকার, স্বাধীন পেশা বা বৃত্তির অধিকার, স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার, সভা-সমাবেশে স্বাধীনভাবে যোগদান করার অধিকার এবং বিনাবিচারে গ্রেপ্তার বা আটক না হওয়ার অধিকার। মানুষের চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। এই কারণে বাক্সাধীনতা ও মুদ্রণ যন্ত্রের স্বাধীনতাকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়।

সরকারের কাজকর্মের ত্রুটিবিচ্যুতি-সহ স্বাধীনভাবে সংবাদপত্র বা পুস্তিকায় ছাপার অক্ষরে, সভাসমিতির বক্তৃতায় অথবা টিভি, রেডিয়োর মতো আধুনিক গণমাধ্যমগুলি জনগণের স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার মাধ্যম যা, গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি। অনুরূপভাবে, রাষ্ট্র নাগরিকদের স্বাধীন গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করা থেকে বিরত থাকবে। ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিকাশের উদ্দেশ্যে ক্লাব, সংঘ বা সমিতি গঠন করার অধিকার একটি স্বীকৃত স্বাধীনতার অধিকার। আইনসংগতভাবে যে-কোনো পেশা বা বৃত্তি বেছে নেওয়ার অধিকারও নাগরিদের অন্যতম স্বাধীনতার অধিকার। রাষ্ট্রে যে-কোনো স্থানে স্বাধীনভাবে বসবাস এবং যে-কোনো বিষয় নিয়ে সভা-সমাবেশে স্বাধীনভাবে যোগদান করার অধিকারও গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতার অধিকাররূপে স্বীকৃত। এ ছাড়া বিনাবিচারে গ্রেপ্তার বা আটক না হওয়ার স্বাধীনতাও একটি মৌলিক স্বাধীনতার অধিকার।

(3) সম্পত্তির অধিকার

সম্পত্তির অধিকার (Right to Property) একটি অন্যতম পৌর অধিকার। সম্পত্তির অধিকার বলতে ব্যক্তির সম্পত্তি অর্জন, ভোগদখল এবং সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের অধিকারকে বোঝায়। সম্পত্তি দান ও সম্পত্তি হস্তান্তর এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। প্রসঙ্গত বলা যায়, ভারতে সম্পত্তির অধিকার বর্তমানে মৌলিক অধিকাররূপে স্বীকৃত নয়, এটি একটি সাংবিধানিক অধিকারমাত্র।

(4) পরিবার গঠনের অধিকার

পরিবার গঠনের অধিকার (Right to Family) মানুষের একটি প্রাচীন পৌর অধিকার। অ্যারিস্টট্ল-এর মতে, পরিবার গঠন হল সমাজজীবনের মূল ভিত্তি। এই কারণে বিবাহের মাধ্যমে নাগরিকদের সুখী ও সমৃদ্ধ পরিবার গঠনের অধিকার প্রতিটি রাষ্ট্রেই স্বীকৃত রয়েছে।

(5) ধর্মের অধিকার

ধর্মের অধিকার (Right to Religion) আধুনিক রাষ্ট্রে একটি স্বীকৃত পৌর অধিকার। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার- আচরণ ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কোনোরকম হস্তক্ষেপ করে না। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বহুকাল থেকে স্বীকৃত রয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সব ধর্মের অধিকার সমান, রাষ্ট্র কোনো ধর্মের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা করে না।

(6) শিক্ষার অধিকার

শিক্ষার অধিকার (Right to Education) অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ পৌর অধিকার। শিক্ষা মানুষকে সুস্থ চেতনায় উদ্ভাসিত করে যোগ্য নাগরিক করে গড়ে তোলে। শিক্ষার সুযোগ না পেলে ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ কখনোই সম্ভব নয়। প্রতিটি রাষ্ট্রে কার্যকরীভাবে শিক্ষার অধিকারের সংস্থান থাকা একান্ত অপরিহার্য।

(7) চুক্তির অধিকার

চুক্তির অধিকারকে (Right to Treaty) অনেকে পৌর অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সমাজে প্রতিটি নাগরিকের ব্যাবসা- বাণিজ্য এবং অন্যান্য যে-কোনো বিষয়ে যে-কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাধীনভাবে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়।

রাজনৈতিক অধিকার

রাষ্ট্রের কোনো কাজকর্মে নাগরিকদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণের সুযোগসুবিধাকে রাজনৈতিক অধিকার (Political Rights) বলা হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে রাজনৈতিক অধিকারগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হল-

(1) ভোটদান করার অধিকার

ভোটদান করার অধিকার (Right to Vote) রাজনৈতিক অধিকারসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্ত্রী-পুরুষ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার স্বীকৃত রয়েছে। স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকরা নিজেদের পছন্দমতো সরকার গঠন করে শাসনকার্যে পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটদান করার অধিকার গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি রচনা করে।

(2) ভোটে দাঁড়ানোর বা নির্বাচিত হওয়ার অধিকার

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি নাগরিকের নির্বাচনের সময় ভোটে দাঁড়ানোর বা নির্বাচিত হওয়ার অধিকার (Right to Elect) স্বীকৃত রয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় পদগুলিতে নির্বাচিত হওয়ার জন্য যোগ্যতার শর্ত বিভিন্ন ধরনের।

(3) সরকারি চাকরি পাওয়ার অধিকার

স্ত্রী-পুরুষ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রতিটি নাগরিকের সরকারি চাকুরি পাওয়ার অধিকার (Right to get Government Jobs) একটি অন্যতম রাজনৈতিক অধিকাররূপে স্বীকৃত। কোনো যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিককে জাতি, ধর্ম বা বর্ণের অজুহাতে সরকারি পদের চাকুরি থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়।

(4) আবেদন করার অধিকার

আবেদন করার অধিকার (Right to Petition) নাগরিকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার। নাগরিকরা তাদের অভাব, অভিযোগ এবং বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকারের জন্য সরকারের কাছে স্বাধীনভাবে আবেদন জানাতে পারে। সভ্য রাষ্ট্রে এটি একটি অন্যতম স্বীকৃত মৌল অধিকার।

(5) সরকারের সমালোচনা করার অধিকার

সরকার জনবিরোধী কাজ করলে তার সমালোচনা করার অধিকার (Right to Criticise Government) নাগরিকদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। গণতন্ত্রে জনমতের গুরুত্বকে মর্যাদা দেওয়া হয়। অবশ্য সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার অর্থ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা নয়।

(6) বিদেশে থাকাকালীন নিরাপত্তার অধিকার

স্বদেশের মতো বিদেশে থাকাকালীন সময়েও নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির অধিকারের সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। বিদেশে থাকাকালীন অবস্থায় নিরাপত্তার অধিকার (Right to Security in Foreign Country) একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার।

(7) রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বা বিদ্রোহের অধিকার

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বা বিদ্রোহের অধিকার (Right to Resistence against the State) একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার। জনস্বার্থ রক্ষার কাজে নিয়োজিত না হয়ে সরকার যদি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, তবে সেই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অথবা বিদ্রোহ করা নাগরিকদের একটি মৌলিক অধিকার। বার্ট্রান্ড রাসেল-এর মতে, অপদার্থ সরকার যদি নিজের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে না পারে, তাহলে অরাজকতার আশঙ্কা সত্ত্বেও জনগণের বিদ্রোহ করার অধিকার থাকা উচিত। রাষ্ট্র যদি ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে সেক্ষেত্রে গান্ধিজি সত্যাগ্রহ করার কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছিলেন। গান্ধিজি মনে করতেন যে, আইন মানুষের নৈতিক মূল্যবোধে আঘাত করে, তাকে অমান্য করা নাগরিকের একটি অধিকার এবং পবিত্র কর্তব্য।

অর্থনৈতিক অধিকার

অর্থনৈতিক অধিকার (Economic Rights) ছাড়া পৌর, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলি নিতান্তই অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই অর্থনৈতিক অধিকারকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। অর্থনৈতিক অধিকার বলতে আমরা সেই সকল অধিকারকে বুঝি, যেগুলি মানুষকে দারিদ্র্য এবং অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিয়ে দৈনন্দিন জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও নিরাপদ করে গড়ে তোলে। অধ্যাপক ল্যাস্কি-র মতে, প্রাত্যহিক অন্নসংস্থানের ক্ষেত্রে মানুষের ন্যায়সংগত মজুরি পাওয়ার নিরাপত্তা ও সুযোগকে অর্থনৈতিক অধিকার বলা যায়। বার্কার আরও সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, যে শ্রমিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরাধীন, সে কখনোই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীন হতে পারে না। বস্তুত, অর্থনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকলে ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যাই হোক, অর্থনৈতিক অধিকারসমূহের মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি উল্লেখযোগ্য।

(1) কর্মের অধিকার

অর্থনৈতিক অধিকারসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল কর্মের অধিকার (Right to Work)। কর্মের অধিকার অনুসারে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার যোগ্যতা অনুসারে কাজ পাবে। রাষ্ট্রের কর্তব্য হওয়া উচিত, যাতে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক তার যোগ্যতা অনুসারে উপযুক্ত কাজ পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা। প্রসঙ্গত বলা যায়, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গণসাধারণতন্ত্রী চিনে নাগরিকদের অধিকাররূপে কর্মের অধিকার স্বীকৃত রয়েছে।

(2) যথাযথ পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার

উপযুক্ত কাজের জন্য যথাযথ মজুরি পাওয়ার অধিকার (Right to get Proper Wages) একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অধিকার। জীবনধারণের জন্য প্রতিটি কর্মরত ব্যক্তির পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক পাওয়া একান্ত অপরিহার্য। কাজের গুণগত ও পরিমাণগত মান যাচাই করে উপযুক্ত মানদণ্ডে পারিশ্রমিক নির্ধারিত হওয়া উচিত। একই কাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে সমান পারিশ্রমিক দেওয়া দরকার। রাষ্ট্রকে এই বিষয়টি যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে তত্ত্বাবধান করা প্রয়োজন।

(3) বিশ্রামের অধিকার

কাজের অধিকারের পাশাপাশি বিশ্রামের অধিকারও (Right to Leisure) অত্যন্ত জরুরি। নিরবচ্ছিন্ন কাজের পরে অবসর যাপনের অবকাশ না থাকলে মানুষের পক্ষে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব নয়। অ্যারিস্টট্ল-এর মতে, সুন্দর জীবনের জন্য অবকাশ একান্তভাবে আবশ্যক। বস্তুত, অবকাশের সুযোগ না থাকলে কর্মরত মানুষের জীবন নিছক যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। মানুষের পক্ষে নতুন কিছু চিন্তাভাবনা করা বা উদ্ভাবন করাও সম্ভব নয়। অনেকের মতে, শুধুমাত্র অবসরপ্রদান করলেই চলবে না, অবসর সময়টুকু যাতে করে সৃষ্টিশীল কাজে ব্যয় হয় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। প্রসঙ্গত বলা যায়, শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কাজের দাবি একশো বছরের অধিককাল আগে স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্বের অসংগঠিত ক্ষেত্রে বহু শ্রমিককে এখনও নির্দিষ্ট সময়সীমার বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অবকাশের অধিকার আজও তাই শ্রমজীবী মানুষের কাছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধিকার।

(4) বার্ধক্য ও অক্ষম অবস্থায় প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার

বৃদ্ধ ও অক্ষম অবস্থায় রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার (Right to Old Age and Unable Allowance) অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অধিকার। কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় পড়ে কোনো শ্রমিক পঙ্গু বা অক্ষম হয়ে পড়লে তার ভরণপোষণের দায়ভার রাষ্ট্রের গ্রহণ করা উচিত। জনকল্যাণকামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে এই অধিকারটি বর্তমানে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অনেক আগেই এই অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

সামাজিক ও কৃষ্টিগত অধিকার

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন বিকাশের জন্য যেসব সুযোগসুবিধা একান্তভাবে অপরিহার্য, তাকে সামাজিক ও কৃষ্টিগত অধিকার (Social and Cultural Rights) বলা হয়। আধুনিক যুগে জনকল্যাণকামী বিভিন্ন রাষ্ট্রে যেসব সামাজিক ও কৃষ্টিগত অধিকার উল্লেখযোগ্য, সেগুলি হল-

(1) সামাজিক সাম্যের অধিকার

সামাজিক সাম্যের অধিকার (Right to Social Equality) একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকের সামাজিক দিক থেকে সাম্যের অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়। অস্পৃশ্যতা বা জাতিভেদের মতো মানবিক অভিশাপ সমাজ থেকে দূর করা দরকার। মানুষের মধ্যে কোনোপ্রকার ভেদাভেদ করা উচিত নয়। বস্তুতপক্ষে, সামাজিক বৈষম্য বিদ্যমান থাকলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সঠিকভাবে রূপায়িত হতে পারে না।

(2) সুস্থ পরিবেশে বাস করার অধিকার

সুস্থ ও সুন্দর সামাজিক পরিবেশে বসবাস করার অধিকার (Right to Reside in a Healthy Environment) একটি তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক অধিকার। সমাজে অসুস্থ পরিবেশ বিরাজ করলে ব্যক্তির পক্ষে সুষ্ঠু জীবনযাপন সম্ভব নয় এবং অসুস্থ পরিবেশ ব্যক্তির অসামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ার পথকে প্রশস্ত করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, সমাজে মাদক সেবনের প্রবণতা বেড়ে গেলে প্রচলিত মূল্যবোধের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের পক্ষে সুস্থ ও সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলা একটি অপরিহার্য কর্তব্য। সুস্থ সামাজিক পরিবেশে সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা নাগরিকদের জীবনের অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশে একান্ত উপযোগী।

(3) স্বাস্থ্যরক্ষার অধিকার

স্বাস্থ্যরক্ষার অধিকার (Right to Secure Health) অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অধিকার। প্রতিটি রাষ্ট্রে নাগরিকরা যাতে সুস্থ দেহের অধিকারী হতে পারে, তার প্রতিবিধান করা রাষ্ট্রের একান্ত কর্তব্য। রুগ্ন ও দুর্বল মানবসম্পদ কোনো রাষ্ট্রের উন্নয়নের পক্ষে অনুকূল নয়। তাই স্বাস্থ্যরক্ষার অধিকারকে সুনিশ্চিত করা রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য কর্তব্য।

(4) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার

শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার (Right against Exploitation) একটি অন্যতম প্রগতিশীল সামাজিক অধিকার। মানবসমাজের ইতিহাসে শোষণ এক অভিশাপ। শোষণের নানান ধরন আছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশসহ উন্নত বিশ্বে আজও শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হয়নি। শিশুরা বিভিন্ন কাজে বিভিন্নভাবে শোষিত হয়। কোথাও আবার বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নেওয়ার রীতি চালু রয়েছে। একে বেগার শ্রম বলে। রাষ্ট্রের উচিত প্রতিটি ব্যক্তিকে শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেওয়া। কারণ, শোষণমুক্ত না হলে প্রকৃত স্বাধীন নাগরিক গড়ে উঠতে পারে না।

(5) ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার

ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার (Right to Language and Culture) একটি অন্যতম সামাজিক ও কৃষ্টিগত অধিকার। প্রতিটি ব্যক্তির, নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার থাকা দরকার। রাষ্ট্রকে এজন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া দরকার।

আরও পড়ুন – গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দাও

Leave a Comment