ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো
ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ

ভারতের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এবং ঘোষিত মৌলিক অধিকারগুলির কয়েকটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেগুলি হল-

(1) বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও তত্ত্বের প্রভাব

ভারতীয় সংবিধানে সমগ্র তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারগুলি লিপিবদ্ধ রয়েছে। সংবিধান রচয়িতারা এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান ও রাজনৈতিক তত্ত্বের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধিকারের সনদ, মানবাধিকার সংক্রান্ত ফ্রান্সের ঘোষণা, আয়ার্ল্যান্ডের সংবিধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডাইসির আইনের অনুশাসন তত্ত্ব এবং গান্ধিজির চিন্তাধারা ইত্যাদির কথা এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

(2) দুই শ্রেণির অধিকার

ভারতের সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারগুলি সাধারণভাবে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে রয়েছে মৌলিক অধিকারগুলি, অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে রয়েছে রাষ্ট্রপরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিসমূহ। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারগুলি এবং চতুর্থ অধ্যায়ে নির্দেশমূলক নীতিসমূহ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আদালতের হাতে মৌলিক অধিকারগুলি বলবৎ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তবে নির্দেশমূলক নীতিসমূহ আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়।

(3) আইনগত ও রাজনৈতিক প্রকৃতি বিশিষ্ট

ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারগুলির প্রকৃতি প্রধানত আইনগত ও রাজনৈতিক। কোনো ধরনের অর্থনৈতিক অধিকারকে মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কাজের অধিকার (Right to Work), শ্রমমানভিত্তিক মজুরি পাওয়ার অধিকার (Right to a Standard Minimum Wage) ইত্যাদি অর্থনৈতিক অধিকারকে ভারতের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। বস্তুত, ভারতীয় সংবিধানে অর্থনৈতিক অধিকার উপেক্ষিত হয়েছে তবে বাস্তবে অর্থনৈতিক অধিকার ছাড়া অন্যান্য অধিকারের কোনো মূল্য নেই।

(4) মৌলিক অধিকারগুলি সবার জন্য নয়

ভারতে মৌলিক অধিকারগুলির প্রকৃতি সর্বজনীন নয়। অর্থাৎ ভারতে বসবাসকারী সকল ব্যক্তি সকল মৌলিক অধিকার সমানভাবে ভোগ করতে পারে না। কতকগুলি মৌলিক অধিকার শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিকরা ভোগ করতে পারে, যেমন বাকস্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্রভাবে সমবেত হওয়ার অধিকার, ভারতের যে-কোনো জায়গায় বসবাস ও যাতায়াতের অধিকার, সংস্কৃতি এবং শিক্ষাবিষয়ক অধিকার প্রভৃতি। অন্যদিকে এমন কতকগুলি অধিকার আছে যেগুলি নাগরিক, অ-নাগরিক নির্বিশেষে ভারতের সমস্ত অধিবাসী সমানভাবে ভোগ করতে পারে। যেমন-সাম্যের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ইত্যাদি।

(5) অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত নয়

ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত ও ঘোষিত মৌলিক অধিকারগুলি অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত নয়। অবশ্য কোনো রাষ্ট্র অবাধ বা সীমাহীন কোনো অধিকার নাগরিকদের দেয় না, কেননা অধিকার অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত হলে তা স্বৈরাচারে পরিণত হয়। এ কে গোপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য (১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) মামলায় বিচারপতি মুখার্জি তাঁর রায়ে ঘোষণা করেন, চরম অথবা অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা বলে কিছু হতে পারে না। কেন-না, নিয়ন্ত্রণ থেকে পুরোপুরিভাবে মুক্ত থাকার অর্থ হল নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলাকে ডেকে আনা। এই কারণে ভারতীয় নাগরিকদের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকারের সঙ্গে কিছু কিছু যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে।

কোনো কোনো বিষয়ে সংবিধান নিজে থেকে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট আইন পাস করে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বাস্বাধীনতা, মুদ্রণযন্ত্রের স্বাধীনতা, সভাসমিতি করার মতো মৌলিক অধিকারগুলির কথা বলা যায়। এগুলি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনস্বার্থ, সদাচার প্রভৃতি শর্তের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অবশ্য এ সমস্ত বিধিনিষেধগুলির বৈধতা এবং যৌক্তিকতা আদালত পর্যালোচনা করে দেখতে পারে।

কোনো বিধিনিষেধ অযৌক্তিক এবং অসাংবিধানিক হলে, আদালত তাকে অবৈধ ও বাতিল বলে ঘোষণা করতে পারে। এ প্রসঙ্গে রাম সিং বনাম দিল্লি রাজ্য (১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ) মামলায় বিচারপতি বসু জানান, প্রতিটি ক্ষেত্রে অধিকারগুলি মৌলিক বলে বিবেচিত হবে বিধিনিষেধগুলি নয় (“…….in every case it is the rights which are fundamental, not the limitations”.) এ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক দেখা দেয়, কেননা ভারতের পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের দ্বারা মৌলিক অধিকারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় অনেকসময় স্বীকৃত অধিকার সীমাবদ্ধ অধিকারে পরিণত হয়। উদাহরণ হিসেবে, স্বাধীনতার অধিকারের নিয়ন্ত্রণরূপে নিবর্তনমূলক আটক আইনের কথা বলা যায়।

নিবর্তনমূলক আটক আইন নিঃসন্দেহে ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী। পৃথিবীর অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে স্বাভাবিক অবস্থায় এ ধরনের আইন দেখা যায় না। বিচারপতি পতঞ্জলি শাস্ত্রী একে ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর প্রচণ্ড আক্রমণ বলে অভিহিত করেন।

(6) কার্যকরের বিবিধ পদ্ধতি

ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলি একইভাবে কার্যকর নয়। কতকগুলি মৌলিক অধিকার সরাসরি বলবৎ হয়, আবার কতকগুলি বলবৎ করার জন্য বিশেষ আইনগত ব্যবস্থা নিতে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৭ নং ধারার অস্পৃশ্যতা বর্জন বা ১৮ নং ধারার উপাধি-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ মৌলিক অধিকার বলে বিবেচিত নয়।

(7) ইতিবাচক ও নেতিবাচক মৌলিক অধিকার

মৌলিক অধিকারগুলির প্রকৃতি পর্যালোচনা করে এগুলিকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেসব অধিকারগুলির মাধ্যমে নাগরিকদের জন্য সরাসরি প্রত্যক্ষ সুযোগসুবিধা প্রদান করা হয়েছে, সেগুলি ইতিবাচক অধিকার। যেমন-মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রভৃতি। গণতান্ত্রিক সমাজের সভ্যরা এই অধিকারগুলি ভোগ করে থাকে। অন্যদিকে যেসব অধিকারগুলির উপর রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়, সেগুলি নেতিবাচক অধিকার। যেমন-আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার, জীবন বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান সুযোগসুবিধার অধিকার ইত্যাদি। রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের এই অধিকারগুলি প্রদানকালে রাষ্ট্র কী কী করতে পারবে না, সে বিষয়ে উল্লেখ করা আছে।

(8) জরুরি অবস্থায় অবলবৎযোগ্য

স্বাভাবিক অবস্থায় মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে নাগরিকরা আদালতের শরণাপন্ন হয়ে তার প্রতিকার করতে পারে কিন্তু জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকারগুলিকে বলবৎ করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যায় না। দেশে যখন জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়, তখন রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৩৫৯ নং ধারা অনুযায়ী আদেশ জারি করে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করার অধিকারকে বাতিল করে দিতে পারেন। তবে সংবিধানের ৪৪ তম সংশোধনের (১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ) মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, জরুরি অবস্থার কালেও রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ২১ নং ধারায় উল্লিখিত জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকে স্থগিত রাখতে পারবেন না।

(9) অধিকারগুলির নমনীয়তা

ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলি নমনীয় প্রকৃতির। বিভিন্ন সময়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে মৌলিক অধিকারগুলি পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ২৪তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পার্লামেন্টকে মৌলিক অধিকার সংশোধন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং সংবিধান সংশোধন বিলে রাষ্ট্রপতির সম্মতিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৪৪তম সংবিধান সংশোধনের সাহায্যে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকারের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে একটি বিধিবদ্ধ অধিকারে পরিণত করা হয়েছে।

(10) বিচার বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষণ

সংবিধান অনুযায়ী মৌলিক অধিকারগুলি আদালত কর্তৃক সংরক্ষিত। স্বাভাবিক অবস্থায় সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের ৩২ নং ধারা অনুসারে এবং হাইকোর্ট ২২৬ নং ধারা অনুসারে লেখ জারি করে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার ব্যবস্থা নিতে পারে। অবশ্য এক্ষেত্রে আদালতের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত, কেননা অধিকারগুলির সঙ্গে যেসব বিধিনিষেধ জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তাতেই আদালতের ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের মতো ‘যথাবিহিত আইনের পদ্ধতি’ (Due Process of Law) অনুযায়ী, কোনো আইনের বৈধতা বিচার করতে পারে না। এজন্য মৌলিক অধিকারের সংরক্ষণের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করার ব্যাপারে বিচার বিভাগ বাধার সম্মুখীন হয়।

কেন্দ্র বা রাজ্য আইনসভার কোনো আইন সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ের মৌলিক অধিকারসমূহের বিরোধী হলে, সেই আইনকে বাতিল করে দিয়ে মৌলিক অধিকারগুলির পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব আদালতের হাতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেকসময় পার্লামেন্ট সংবিধান সংশোধন করে মৌলিক অধিকার রক্ষায় আদালতের ভূমিকাকে খর্ব করার চেষ্টা করেছে। গোলকনাথ মামলায় সুপ্রিমকোর্টের রায়কে বাতিল করার উদ্দেশ্যে ২৪তম সংবিধান সংশোধন করার বিষয়টি এক্ষেত্রে একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

(11) মৌলিক কর্তব্য

ভারতের মূল সংবিধানে মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি কোনো মৌলিক কর্তব্যের উল্লেখ ছিল না। গণপরিষদে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। পরবর্তীকালে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৪২ তম সংবিধান সংশোধনের সাহায্যে সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে ‘Part IV-A’ নামে একটি নতুন অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়। এই অধ্যায়ে নাগরিকদের ১০টি মৌলিক ও কর্তব্য পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি ২০০২ সালের ৮৬তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ৫১-ক নং ধারায় নতুন একটি কর্তব্য সংযোজিত হওয়ায় বর্তমানে মৌলিক কর্তব্যের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, সংবিধানকে মান্য করা, দেশকে রক্ষা করা, ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও সংহতি রক্ষা প্রভৃতি।

(12) অসাম্প্রদায়িক প্রকৃতি

ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলি প্রকৃতিগতভাবে সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের ভিত্তিতে এই সমস্ত মৌলিক অধিকার স্বীকৃত ও ঘোষিত হয়েছে। এখানে কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মীয় সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর স্বার্থে বৈষম্যমূলক কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মৌলিক অধিকারের এই অসাম্প্রদায়িক প্রকৃতি ভারতীয় সংবিধানেরও একটি অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে সংবিধানের ১৪-১৬ নং ধারায় বর্ণিত সাম্যের অধিকার, ২৫-২৮ নং ধারায় বর্ণিত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ইত্যাদির কথা বলা যায়, এগুলি অনুসারে আইনের দৃষ্টিতে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সমান বলে বিবেচিত। এ প্রসঙ্গে ৩২৬ নং ধারার কথাও বলা যায়।

(13) ভোটাধিকার মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত নয়

ভারতীয় সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ৩২৬ নং ধারা অনুসারে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকৃত। তবে ভোটাধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকারটিকে সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্থান দেওয়া হয়নি।

(14) অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ

ভারতের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের অধ্যায়ে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে তপশিলি সম্প্রদায়ের মানুষ এবং অনগ্রসর শ্রেণিসমূহের মানুষ (OBC) সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থার অধিকার ভোগ করে থাকেন। সরকারি চাকুরিতে তপশিলি জাতি ও উপজাতির সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু থাকার মেয়াদ ৬২ তম সংবিধান সংশোধন অনুযায়ী ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। লোকসভা ও বিধানসভায় তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া সংবিধানের ১৯ নং ধারায় ভারতের সর্বত্র চলাফেরার ও যে-কোনো জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকারের উপর তপশিলি উপজাতিদের স্বার্থে রাষ্ট্রের যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা বলা হয়েছে।

(15) সাধারণ অবস্থায় মৌলিক অধিকারের সংকোচন

শুধুমাত্র জরুরি অবস্থার সময় নয়, সাধারণ অবস্থাতেও নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলির উপর কিছু বিধিনিষেধের ব্যবস্থা সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২২ নং ধারায় উল্লিখিত ‘নিবর্তনমূলক আটক আইন’-এর কথা বলা যায়। এই আইনের সাহায্যে অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িত বা ভবিষ্যতে অপরাধ করতে পারে এই সন্দেহে সরকার যে-কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে আটক করে রাখতে পারে। এজন্য সরকারকে কারণ দর্শাতে হয় না। এ কে গোপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য মামলায় সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি মহাজন মন্তব্য করেছিলেন, ‘নিবর্তনমূলক আটক আইন’ গণতান্ত্রিক সংবিধানের বিরোধী। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে এ ধরনের আইন চালু রেখেছেন। বর্তমানে (২০১৩ সাল) ‘অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন’ (UAPA) নামে একটি নিবর্তনমূলক আটক আইন চালু রয়েছে।

(16) ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের সমন্বয়

ভারতে মৌলিক অধিকারগুলির সঙ্গে যেসব যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে তার ফলে ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে সামাজিক স্বার্থের সমন্বয় ঘটেছে বলে মনে করা হয়। মৌলিক অধিকার ব্যক্তিস্বার্থকে রক্ষা করে কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে সমগ্র সমাজের স্বার্থের সংঘাত যাতে না ঘটে সেজন্য মৌলিক অধিকারগুলির উপর যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে।

(17) স্বাভাবিক অধিকারের অস্বীকৃতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবম সংশোধনে ‘স্বাভাবিক অধিকারের নীতি’ গ্রহণ করে বলা হয়েছে, যেসব অধিকার সংবিধানে উল্লিখিত হয়নি সেগুলি থেকেও নাগরিকদের বঞ্চিত করা যাবে না। ভারতে স্বাভাবিক অধিকারের এই তত্ত্ব স্বীকৃত হয়নি। এখানে সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারগুলি ছাড়া নাগরিকরা অন্য কোনো মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রের কাছে দাবি করতে পারে না।

(18) সংবিধানে অধিকারগুলিকে বাস্তবায়নের উল্লেখহীনতা

ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকারের ঘোষণা থাকলেও কীভাবে অধিকারগুলিকে বাস্তবায়িত করা হবে সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। অধিকারগুলি যতটা তাত্ত্বিক ততটা বাস্তব নয়। বলা হয় যে শুধুমাত্র ঘোষণাই যথেষ্ট নয়, সেই ঘোষণাকে কার্যকর করার জন্য সংবিধানে উপযুক্ত ব্যবস্থার সংস্থান থাকা দরকার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে মৌলিক অধিকারগুলি উল্লেখ করার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলিকে কীভাবে বাস্তবে রূপায়িত করতে হবে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে বাস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি অধিকারগুলিকে যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য কাগজ, ছাপাখানা প্রভৃতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগণের উপর কোনোরূপ বিধিনিষেধ আরোপ করা হত না। ভারতীয় সংবিধানে এরকম কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

(19) অন্যান্য বৈশিষ্ট্য

ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলি অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির সঙ্গে গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। অধিকার লঙ্ঘিত হলে ব্যক্তির মতো গোষ্ঠীও আদালতের কাছে আবেদন করতে পারে। এ প্রসঙ্গে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক অধিকার প্রভৃতির কথা বলা যায়। এ ছাড়া মৌলিক অধিকারের নিয়ন্ত্রণগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর মধ্যে কতকগুলি শুধুমাত্র শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে আবার কতকগুলির ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ সাধারণভাবে সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনেকে মনে করেন, ভারতে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি অত্যন্ত উদার এবং ব্যাপক। এ প্রসঙ্গে ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতার অধিকারটির কথা উল্লেখ করা হয়। এই স্বাধীনতা অন্য কোনো দেশের সংবিধানে স্বীকৃত হয়নি।

আরও পড়ুন – গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দাও

Leave a Comment