জাতীয় জনসমাজের উপাদান গুলি আলোচনা করো

জাতীয় জনসমাজের উপাদানসমূহ
যে-সমস্ত উপাদানগুলির (Elements) সাহায্যে কোনো জনসমাজ জাতীয় জনসমাজে পরিণত হয়, তাকে জাতীয় জনসমাজের উপাদান বলে। জাতি গঠনের পক্ষে এই উপাদানগুলি একান্তভাবে অপরিহার্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতীয় জনসমাজের উপাদানগুলিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলি হল- বাহ্যিক উপাদান (External Elements) এবং ভাবগত উপাদান (Spiritual Elements)। বাহ্যিক উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে ভৌগোলিক একতা, বংশগত ঐক্য, ভাষাগত ঐক্য, ধর্মগত ঐক্য, রাষ্ট্রীয় ঐক্য এবং অর্থনৈতিক সমস্বার্থ। অন্যদিকে, ভাবগত উপাদানের মধ্যে রয়েছে শিল্প, সাহিত্য, ঐতিহ্য, সুখ-দুঃখ, চিন্তা, অনুভূতি ও আদর্শের মতো সাংস্কৃতিক ও মানসিক ঐক্যের বিষয়গুলি।
বাহ্যিক উপাদানসমূহ
(1) ভৌগোলিক একতা
ভৌগোলিক একতা (Geographical Unity) জাতীয় জনসমাজের একটি অন্যতম অপরিহার্য উপাদান। কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় কোনো জনসমষ্টি দীর্ঘকাল একত্রে বসবাস করলে তাদের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা এক গভীর একাত্মবোধের জন্ম দেয়। এভাবে একে অপরকে আপনজন বলে ভাবে, নিজেদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পরস্পরের মধ্যে ভাগ করে নেয়। এই ভৌগোলিক একতা নিজেদের ভূখণ্ডকে পবিত্র মাতৃভূমি হিসেবে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ তাদের মাতৃভূমির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয় এবং বৈদেশিক আক্রমণ দেখা দিলে মরণপণ সংগ্রামে শামিল হতে দ্বিধা করে না।
অবশ্য ভৌগোলিক একতাকে জাতীয় জনসমাজ গঠনের একমাত্র অপরিহার্য উপাদানরূপে গণ্য করা যায় না। কারণ ভৌগোলিক একতা ছাড়াও জাতীয় জনসমাজ গঠিত হওয়ার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে রয়েছে। কেবলমাত্র, দীর্ঘকাল যাবৎ একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে একত্রে বসবাস করলেই যে জনসমাজের মধ্যে স্বদেশপ্রেম বা গভীর একাত্মবোধ জাগ্রত হবে তেমন ভাবার কোনো কারণ নেই। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদের কথা বলা যায়। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় দীর্ঘকাল বসবাস না করলেও ইহুদিদের মধ্যে একাত্মবোধের কোনো অভাব হয়নি।
আবার অন্যদিকে, বহুকাল ধরে একত্রে বসবাস করা সত্ত্বেও ভারতে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ইত্যাদি নানান সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ঐক্যবোধ জাগ্রত না হওয়ায় স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও ভারতে সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতিকে বিনষ্ট করে তুলছে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, “… নেশনের অন্তঃকরণটুকু ভূখণ্ডে গড়ে ওঠে না।”
(2) বংশগত ঐক্য
বংশগত ঐক্যকেও (Racial Unity) অনেকে জাতীয় জনসমাজের অপরিহার্য উপাদানরূপে অভিহিত করেছেন। কোনো জনসমাজের অন্তর্গত মানুষেরা নিজেদের একই বংশের লোক বা অভিন্ন বংশোদ্ভূত হিসেবে মনে করলে, তাদের মধ্যে গভীর একাত্মতার সৃষ্টি হয়। এই বংশগত ঐক্য এক সুদৃঢ় জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়। রক্তের বন্ধন তাদের মধ্যে স্বজনপ্রীতির আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করে, এক গভীর একাত্মবোধ সৃষ্টি করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডল্ফ হিটলার-এর নেতৃত্বে জার্মান জাতির ঐক্যের কথা উল্লেখ করা যায়। হিটলার-এর বক্তব্য ছিল, পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র জার্মানদের শরীরে বিশুদ্ধ আর্য রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। বংশগত ঐক্যবোধকে হাতিয়ার করে ইংরেজরা আবার নরডিক কুলের উৎকর্ষ প্রচারের মাধ্যমে একদিকে যেমন সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব গড়ে তুলেছিল, অন্যদিকে তেমনই নিজেদের মধ্যে ঐক্যবোধও গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
আধুনিক লেখকরা বংশগত ঐক্যের উপাদানকে জাতীয় জনসমাজের অপরিহার্য উপাদানরূপে স্বীকৃতি দিতে রাজি নন। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, জাতির রক্ত সম্পর্কিত বিশুদ্ধতা বলে বাস্তবে কিছু নেই। ইংরেজ ও ফরাসি-বিশ্বের এই দুটি শ্রেষ্ঠ জাতির মধ্যেও বিভিন্ন জাতির রক্ত প্রবাহিত হয়ে চলেছে। তাই বর্তমানে তারা নিজেদের বিশুদ্ধ জাতি বলে দাবি করলেও ব্রিটিশ, ফরাসি, মার্কিন এবং ভারতীয়দের মতো শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ জাতিগুলির কোনো রক্ত সম্পর্কিত বিশুদ্ধতা নেই। রবীন্দ্রনাথ-এর ভাষায় ‘জাতি-মিশ্রণ হয় নাই য়ুরোপে এমন দেশ নাই’। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও অবশিষ্ট মহাদেশগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় তুলে ধরেছিলেন কীভাবে আর্য, অনার্য, শক, হুন, পাঠান, মোঘল ইত্যাদি নানান জাতির সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় জাতির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ ঘটেছে। আবার, ইংরেজ, জার্মান, ওলন্দাজ প্রভৃতি জাতিগুলি অভিন্ন জাতিভুক্ত হলেও, জাতীয় জনসমাজের প্রশ্নে তাদের মধ্যে অনৈক্য বিদ্যমান তথা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সুতরাং, বংশগত ঐক্য জাতি গঠনের একমাত্র উপাদান নয়।
(3) ভাষাগত ঐক্য
ভাবপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম ভাষাকে অনেকে জাতীয় জনসমাজ গঠনের অপরিহার্য উপাদানরূপে চিহ্নিত করেছেন। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় একই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী থাকলে ভাষাগত ঐক্যের (Unity of Language) ভিত্তিতে তাদের মধ্যে একধরনের সহজাত একাত্মবোধের জন্ম হয়। এভাবে নিজেদের প্রচলিত ভাষা জাতীয় ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক মজবুত বুনিয়াদ রচনা করে। জার্মান দার্শনিক ফিক্টে (Fichte) জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির প্রধান উপাদান হিসেবে ভাষার কথা উল্লেখ করেছেন। র্যামসে ম্যুর জাতীয় জনসমাজ গঠনে বংশগত ঐক্যের চেয়ে ভাষাগত ঐক্যকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত বলা যায়, ভাষা কীভাবে একটি জনসমাজকে জাতীয় জনসমাজে রূপান্তরিত করতে পারে, তার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত হল-আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গেটেল-এর অভিমত অনুসারে, ‘যেসব উপাদান জাতীয় জনসমাজকে সমৃদ্ধ করেছে, তাদের মধ্যে ভাষাগত ঐক্য এমন একটি উপাদান যার সম্বন্ধে জনগণ অত্যন্ত সচেতন, ভাষার জন্য তারা যাবতীয় দমনপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রামে নামতেও পিছপা হন না’ (‘of all the factors that contribute to nationality, community of language is usually the one of which people are most conscious, and for which they will struggle most bitterly against supression.’)
অবশ্য ভাষাগত ঐক্যকেও জাতীয় জনসমাজ গঠনের একমাত্র অপরিহার্য উপাদানরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। কারণ, পৃথিবীতে বহুভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে অধিকাংশ জাতীয় জনসমাজ গঠিত হয়েছে। ভারতে প্রায় ১,৬৫২টি কথ্যভাষা চালু থাকা সত্ত্বেও ‘ভারতবাসী’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার ব্যাপারে ভারতীয়দের কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। গণসাধারণতন্ত্রী চিন, রাশিয়া, সুইটজারল্যান্ডের ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা বলা যায়।
(4) ধর্মগত ঐক্য
ধর্মগত ঐক্যকেও (Unity of Religion) জাতীয় জনসমাজের অন্যতম প্রধান উপাদানরূপে বিবেচনা করা হয়। একই ধর্মের মানুষদের মধ্যে সমজাতীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনা পদ্ধতি ইত্যাদি প্রচলিত থাকায় গভীর একাত্মবোধের উদ্ভব হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসে এ ধরনের দৃষ্টান্ত রয়েছে। লয়েড (Lloyed)-এর মতে, অভিন্ন ধর্মীয় মনোভাব জাতীয় রাষ্ট্রগঠনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান। অধ্যাপক গিলক্রিস্ট-এর মতে, যেখানে ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে পার্থক্য বিদ্যমান, সেখানে জাতিগত ঐক্যের ধারণা ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে অখন্ড ভারতবর্ষ থেকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
ধর্মগত ঐক্যকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতীয় জনসমাজ গঠনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। আধুনিক পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ। ভারতের মতো বিশাল দেশে বহু ধর্মের অস্তিত্ব প্রকট থাকা সত্ত্বেও ভারতীয়দের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে কোনো বাধার সৃষ্টি হয়নি। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, পারসি, খ্রিস্টান, আদিবাসী প্রভৃতি পৃথক ধর্মাবলম্বী মানুষ স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র গঠনের জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছিল।
তবে ভারতে গোর্খা বা শিখ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষগণ অভিন্ন হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও, তারা নিজেদের জাতি নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে, যার ফলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে। আবার, ভারতে বসবাসকারী মুসলমান জাতিগোষ্ঠী হিন্দুদের ন্যায় সমভাবেই ভারত রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত। তাই এ প্রসঙ্গে, হায়েস মন্তব্য করেছেন যে, মানুষের ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মাচরণ ভিন্ন ভিন্ন হলেও পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রেরই সামাজিক উন্নতি অক্ষুণ্ণ রয়েছে। এমনকি, বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ গৃহীত হওয়ার পরেও বিভিন্ন রাষ্ট্রের বহু ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের মধ্যে নিজ দেশের প্রতি জাতীয়তাবাদের অভাব পরিলক্ষিত হয় না। ভারত ছাড়াও ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে বহু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা নিজেদের ধর্মীয় ভিন্নতা সত্ত্বেও পরস্পর একত্রে গভীর একাত্মতাবোধের সঙ্গে বসবাস করছেন।
(5) রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য
রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য (Political Unity) জাতীয় জনসমাজ গঠনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘকালব্যাপী কোনো জনসমষ্টি একই সরকারের শাসনের অধীনে থাকলে তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ঐক্যবোধের সৃষ্টি হয়। ডুর্কহেইম (Durkheim)-এর মতে, জাতীয় জনসমাজ এমন একটি জনসমষ্টি, যার প্রতিটি সদস্যই অভিন্ন আইনের অধীনস্থ হয়ে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনে আগ্রহী। দৃষ্টান্তস্বরূপ ব্রিটিশ শাসনাধীনে থাকা ভারতবর্ষের কথা উল্লেখ করা যায়। দুশো বছরের সুদীর্ঘ ব্রিটিশ শাসন আসমুদ্রহিমাচলের বহু বিচিত্র ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করেছিল।
ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, বংশ, ঐতিহ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিভেদ থাকা সত্ত্বেও ভারতবাসীরা ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে একই মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা আপামর ভারতবাসীকে জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত করেছিল। একই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে একইভাবে নিপীড়িত ও শোষিত না হলে ভারতবাসীর মনে এই আকাঙ্ক্ষার জন্ম হত না বলে অনেকে মনে করেন। কাজেই রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য জাতীয় জনসমাজ গঠনের একটি অপরিহার্য উপাদান।
জাতীয় জনসমাজ গঠনে রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য একমাত্র উপাদান নয়। পৃথিবীতে রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য ছাড়াই জাতীয় জনসমাজ গঠিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে ইহুদিদের অবস্থার কথা পুনরায় উল্লেখ করতে পারি। ইহুদিদের মধ্যে কোনো ধরনের রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য না থাকলেও জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে তাদের কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি।
(6) অর্থনৈতিক সমস্বার্থ
অর্থনৈতিক সমস্বার্থও (Equal Economic Interest) জাতীয় জনসমাজ গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। অভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থ জনসমষ্টিকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে সাহায্য করে। ব্রিটিশ শাসনকালে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক শোষণে আপামর ভারতবাসীর জীবনে যে আর্থিক বিপর্যয় নেমে আসে, তা ভারতবাসীকে অত্যাচারী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শামিল হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম যে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালিত হয়, তার পশ্চাতে অর্থনৈতিক সমস্বার্থের একটা বড়ো ভূমিকা ছিল।
আবার ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বন্ধন না থাকায় উভয়ই পৃথক জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করেছে। জর্জিয়ানরা আবার একই ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হলেও এবং অভিন্ন ভাষাভাষী হলেও নিজেদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। দীর্ঘকালব্যাপী তারা একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে উদারনৈতিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে জর্জিয়া একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
অবশ্য অর্থনৈতিক সমস্বার্থের অস্তিত্ব ছাড়াই জাতীয় জনসমাজ গঠনের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে, কলকারখানার শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক সমস্বার্থ না থাকলেও তা জাতি গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। শ্রমিকরা সম অর্থনৈতিক স্বার্থে আবদ্ধ হলেও তারা একটি ক্ষমতাশালী বিপ্লবী রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, যারা পুঁজিবাদী সমাজে ‘রাষ্ট্র’ নামক যন্ত্রের ধ্বংসসাধনের মাধ্যমে প্রলেতারিয়েত একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। তবে, সার্বভৌমিকতা বা নিজস্ব জাতিসত্তাকে বর্জন না দিয়ে একটি অর্থনৈতিক জোট গঠন করা সম্ভব। যেমন-জি- সেভেন (G-7), ইউরোপীয় কমন মার্কেট ইত্যাদি।
ভাবগত উপাদানসমূহ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, জাতীয় জনসমাজ গঠনে ভাবগত উপাদানের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই ভূখণ্ডে দীর্ঘকাল যাবৎ বসবাস করলে নাগরিকদের মধ্যে ঐতিহাসিক কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে এক ঐতিহ্যগত ঐক্য গড়ে ওঠে। যেমন-ভাষা, বংশ, আচার-ব্যবহার প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হলেও সকল ভারতবাসী ভারতীয় ঐতিহ্যেরই অংশ-একথা অনস্বীকার্য। ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রেনা-র মতে, জাতীয় জনসমাজ সম্পর্কিত ধারণা হল প্রধানত একটি ভাবগত ধারণা (The idea of nationality is essentially spiritual in character)। এই ভাবগত উপাদান আবার দুটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। যথা- অতীত স্মৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণের আকাঙ্ক্ষা।
গেটেল-এর অভিমত হল আধুনিক রাষ্ট্রের ঐক্যের বনিয়াদ বাহ্যিক নয়, তা সম্পূর্ণভাবে মানসিক। তিনি এও বলেন যে, জাতীয় জনসমাজ একটি জীবনাদর্শ, একটি ভাবনা ও অনুভূতির বিষয় (a state of mind, a way of living, thinking and feeling)। জিমার্নও অনুরূপ মত প্রকাশ করে বলেছেন, কোনো জনসমাজ যখন নিজেদের জাতি বলে মনে করে, তখন সেই জনসমাজ জাতিতে পরিণত হয়। বার্নস-এর মতে, অভিন্নতা অপেক্ষা একটি জাতির সম রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ইতিহাস এবং যৌথ আদর্শ জাতি গঠনে অধিক কার্যকরী।
বস্তুতপক্ষে, সুদীর্ঘকাল একই ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাসের ফলে জনসমাজের মধ্যে যে সম মানসিকতার বিকাশ ঘটে, তা একধরনের আত্মিক নৈকট্যের সৃষ্টি করে। কোনো জনসমাজ যখন ভাবে যে তাদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, গৌরব-গ্লানি সব এক, তখন সেই জনসমাজের চেতনায় জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটে। এভাবে অতীতের স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস, ভবিষ্যতের স্বপ্ন ও সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সমন্বয় ইত্যাদির ফলে যে ঐক্য গড়ে ওঠে, তা জাতি গঠনের সহায়ক উপাদানের কাজ করে। স্তালিন-এর মতে, রাষ্ট্রীয় চরিত্র বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে এরও পরিবর্তন ঘটে। সংস্কৃতিগত ঐক্যই একটি জাতির বৈশিষ্ট্য।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় জনসমাজ গঠনের জন্য বাহ্যিক উপাদান ও ভাবগত উপাদান উভয়ের ভূমিকাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কোনো একটি উপাদান জাতি গঠনে অপরিহার্য নয়। জাতীয় জনসমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বাহ্যিক উপাদানের অন্তর্ভুক্ত বংশ, ভাষা ও ধর্ম অপেক্ষা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপাদান অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। আবার অনেকে বাহ্যিক উপাদানের পরিবর্তে ভাবগত উপাদানকে অধিক প্রাধান্য দান করেছেন। এঁনারা মনে করেন, কেবলমাত্র ভাবগত উপাদানই একটি জাতীয় জনসমাজকে জাতিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, একটি জনসমাজের মধ্যে সকল প্রকার উপাদান উপস্থিত না থাকলে সেই জনসমাজ জাতীয় জনসমাজে পরিণত হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে স্তালিন মন্তব্য করেছেন, “যখন কোনো সমাজে এই সব বৈশিষ্ট্যের প্রত্যেকটিই বর্তমান থাকবে, কেবল তখনই তাদের একটি জাতি বলে গণ্য করা যাবে।”
Read More – The Garden Party Question Answer