শৈশবের বিকাশমূলক বৈশিষ্ট্য ও চাহিদাগুলি আলোচনা করো [Developmental Characteristics and Need of Different Stages of Human Life] (Class 11 Exclusive Answer)

বিভিন্ন স্তরে ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন চাহিদা দেখা দেয়। আর বিকাশের ফলে সেই চাহিদা ও ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে। নীচে জীবনবিকাশের প্রধান চারটি স্তরের (জোসের স্তরভাগ অনুযায়ী) বিকাশগত বৈশিষ্ট্য ও চাহিদা সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

মানবজীবনের বিভিন্ন স্তরের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য ও চাহিদা

শৈশবের বিকাশমূলক বৈশিষ্ট্য ও চাহিদাগুলি আলোচনা করো
শৈশবের বিকাশমূলক বৈশিষ্ট্য ও চাহিদাগুলি আলোচনা করো

শৈশবকাল [Infancy]

জন্মের পর থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সময়কালকে শৈশবকাল বলা হয়। এই শৈশবকালকে দুটি স্তরে বিভক্ত করা হয়, যথা-প্রারম্ভিক শৈশব (1 মাস-1½ বছর) ও প্রান্তীয় শৈশব (2 বছর-5 বছর) স্তর। শিক্ষাগত দিক দিয়ে এটি হল প্রাবিদ্যালয় স্তর। শিক্ষার ভিত্তি ও ব্যক্তিত্ব গঠনে এই স্তরটি জীবনবিকাশে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

শৈশবকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য

শৈশবকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্যগুলি প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত, যথা- দৈহিক বিকাশ,  মানসিক বিকাশ,  সামাজিক বিকাশ এবং  প্রাক্ষোভিক বিকাশ। জীবনবিকাশের এই স্তরে শিশুর এই চার ধরনের বিকাশই দ্রুত ঘটে।

(1) দৈহিক বিকাশ: 

শিশুর দৈহিক বিকাশের ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায়, সেগুলি হল-

  1. প্রারম্ভিক শৈশবে দৈহিক বিকাশ খুব দ্রুত ঘটে।
  2. সদ্যোজাত শিশুর গড় উচ্চতা ও ওজন যথাক্রমে 17 ইঞ্চি থেকে 21 ইঞ্চি এবং 6 থেকে ৪ পাউন্ড হয়।
  3. এরপর সাধারণভাবে ও বছরে উচ্চতা হয় 3৪ ইঞ্চি এবং ওজন হয় 33 পাউন্ড।
  4. প্রান্তীয় শৈশবে প্রারম্ভিক শৈশবের মতো দৈহিক বিকাশ দ্রুত ঘটে না। দৈহিক বৃদ্ধির মধ্যে একটা সমতা পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। পায়ের দিকের বৃদ্ধি খুব দ্রুত ঘটে এবং মোট উচ্চতার প্রায় অর্ধেক হয়। মাথার বৃদ্ধি ধীরে ঘটে এবং মধ্য অংশের বৃদ্ধি মাঝারি ধরনের হয়।
  5. পাঁচ বছরের মধ্যে বালকদের গড় ওজন ও উচ্চতা যথাক্রমে 43 পাউন্ড এবং 43 ইঞ্চি হয়। বালিকাদের উচ্চতা ও ওজন বালকদের থেকে সামান্য কম হয়।
  6. দৈর্ঘ্য ও উচ্চতা ছাড়াও শিশুর মধ্যে আরও বিভিন্ন রকমের দৈহিক বিকাশ ঘটে। দীর্ঘ পেশিগুলি ক্ষুদ্র পেশিগুলির চেয়ে দ্রুত এবং সুষমভাবে বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তনও ঘটে। যেমন শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃদযন্ত্রের গতি হ্রাস পায়, রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। এই বয়সের মধ্যেই মস্তিষ্কের প্রায় নব্বই শতাংশ গঠন সম্পন্ন হয়ে যায়। মস্তিষ্কের কাছাকাছি স্নায়ুতন্ত্রগুলি প্রাবিদ্যালয়ের শেষদিকেই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়।

(2) মানসিক বিকাশ: 

মানসিক বিকাশকে দু-ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়-ভাষার বিকাশ এবং বৌদ্ধিক বিকাশ।

  1. ভাষার বিকাশ: শিশুর ভাষার বিকাশ জন্মানোর সময় কান্নার মধ্যে দিয়েই শুরু হয়। দশ মাসের শিশু একটি শব্দ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়, কিন্তু প্রথম বছরের শেষের দিকে তার শব্দভান্ডারে তিন থেকে চারটি শব্দ সঞ্চিত হয়। 6 বছরের শিশু প্রায় 2562টি শব্দ বলতে পারে।
  2. বৌদ্ধিক বিকাশ: শিশুর বৌদ্ধিক বিকাশ দু-বছর বয়স থেকে দ্রুত ঘটে, কারণ এই বয়স থেকেই শিশু সমাজ- পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। বৌদ্ধিক বিকাশের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল-[a] এই পর্যায়ে প্রাকৃতিক ও সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে। [b] এই স্তরের শেষের দিকে বস্তুর আকার, গঠন, রং ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে। [c] স্মৃতি খুব দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। শিখনে স্মৃতির ব্যবহার খুব বেশি। [d] শিশুর মধ্যে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। কল্পনা করার ক্ষমতা প্রকাশ পায়। [e] প্রত্যক্ষ বিষয়ভিত্তিক চিন্তার ও বিচার করার ক্ষমতার বিকাশ ঘটে। [f] মনোযোগের পরিসর এবং পরিবেশকে জানার প্রতি কৌতূহল বৃদ্ধি পায়। [g] এই বয়সে শিশু ভাষার সংকেত ব্যবহার করতে শেখে। খেলার বস্তু আঁকতে পারে এবং ছোটোখাটো সমস্যা সমাধান করতে পারে। [h] শিশু তার পরিবেশ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করে।

(3) সামাজিক বিকাশ: 

শিশু সমাজ-পরিবেশের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করে এবং তার ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী। এই পর্যায়ের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য হল-

  1. এই স্তর থেকেই শিশুদের স্বাধীন চেতনার বিকাশ ঘটে। তারা নিজেরাই পরিবেশকে জানতে চায়।
  2. গৃহের বাইরে সমাজ-পরিবেশের সঙ্গে শিশুর মিথস্ক্রিয়া শুরু হয়।
  3. লিঙ্গগত পার্থক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ না ক’রে ছেলে ও মেয়েরা একত্রে খেলা করে। শারীরিক শক্তির প্রয়োজন নেই এমন দলগত খেলা, যেমন-লুকোচুরি খেলায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
  4. একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে, যৌথ স্বার্থের ভিত্তিতে বন্ধুত্ব করে।
  5. জীবজন্তু ও রূপকথার গল্পের প্রতি কৌতূহল দেখায়।
  6. তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। যে শিশু যত বেশি বয়স্কদের কাছ থেকে বাধা পায় তার আচরণে তত ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে।

(4) প্রাক্ষোভিক বিকাশ: 

এই স্তরের শিশুদের প্রাক্ষোভিক বিকাশের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

  1. প্রক্ষোভের (ভাবাবেগ) খুব ঘন ঘন বহিঃপ্রকাশ হয়।
  2. মূর্ত বা প্রত্যক্ষ বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
  3. এই স্তরের প্রক্ষোভ খুবই অস্থায়ী। শিশুর প্রক্ষোভ খুব দ্রুত এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে চলে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ক্রন্দনরত শিশুকে একটি চকোলেট দিলেই সে আনন্দ প্রকাশ করে।
  4. এই বয়সে উদ্দীপকের মাত্রা অনুযায়ী প্রক্ষোভের মাত্রা স্থির হয় না। সর্বদাই প্রক্ষোভ চড়া মাত্রায় থাকে।
  5. শিশুরা প্রক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অনেক সময় নিজের অজান্তে প্রক্ষোভ প্রকাশ করে, যেমন-নখ খোঁটা, আঙুল চোষা, তোতলামি ইত্যাদি। শৈশবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরেই শিশুর শিক্ষা-পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।

শৈশবের চাহিদা

শৈশবকালের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শিশুর মধ্যে বিভিন্ন চাহিদা দেখা যায়। এই চাহিদাগুলি শৈশবকালীন শিক্ষাব্যবস্থা অর্থাৎ প্রাক্সাথমিক শিক্ষাস্তরে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চাহিদাগুলির মধ্যে অন্যতম হল- দৈহিক বা জৈবিক চাহিদা,  মানসিক চাহিদা ও সামাজিক চাহিদা।

(1) জৈবিক চাহিদা: 

জৈবিক চাহিদা বলতে এমন কতকগুলি চাহিদাকে বোঝায় যা শিশুকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এই চাহিদাগুলি হল-

  1. খাদ্যের চাহিদা: শৈশবে দৈহিক বৃদ্ধি খুব দ্রুত হারে হয়ে থাকে। এই জন্য শিশুর খাদ্যের চাহিদা অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠে। এই চাহিদাপূরণ তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্বার্থে জরুরি। শুধু খাদ্য হলেই হবে না। প্রয়োজনমাফিক উন্নতমানের খাদ্য আবশ্যক।
  2. ঘুমের চাহিদা: শিশুর ঘুমের চাহিদাও এই বয়সে প্রবল হয়। দ্রুত বৃদ্ধির জন্যই এই অতিরিক্ত ঘুমের চাহিদা দেখা যায়।
  3. নিরাপত্তার চাহিদা: শিশু পিতা-মাতা বা বয়স্কদের কাছ থেকে দৈহিক নিরাপত্তা চায়। যেমন- নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র, জল, বায়ু প্রভৃতি।
  4. সক্রিয়তার চাহিদা: কোনো শিশুই চুপ করে থাকতে চায় না। সবসময় সে কিছু না কিছু করতে চায়। তার ইচ্ছামতো চলাফেরা, নড়াচড়া ও দৌড়োদৌড়িতে বাধা দিলে সে বিরক্ত হয়।
  5. পুনরাবৃত্তির চাহিদা: শিশুর মধ্যে পুনরাবৃত্তির চাহিদা লক্ষ করা যায়। একই কথা সে বারবার বলে, একই কাজ সে বারবার করতে চায়।

(2) মানসিক চাহিদা: 

শৈশবে শিশুর দৈহিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলি মানসিক চাহিদা দেখা দেয়। এই চাহিদাগুলি হল-

  1. অনুকরণের চাহিদা: শিশু তার বাবা-মা কিংবা অন্যান্য বয়স্কদের নানান আচার-আচরণ অনুকরণ করে। এই অনুকরণই হল শৈশবকালীন আচরণের অন্যতম উৎস।
  2. আয়ত্তে আনার চাহিদা: শিশু সবকিছুকে নিজের আয়ত্তে আনতে চায়। শিশু যা দেখে তা-ই নিতে চায় ও পেতে চায়। নিজের জিনিস সে অন্যকে দিতে চায় না।
  3. জানার চাহিদা: শিশুর মধ্যে সবকিছু জানার চাহিদা দেখা দেয়। কী, কেন-এইসব প্রশ্নের উত্তর সে চায়। এই চাহিদার ফলে অনেক সময় সে কোনো জিনিসকে ভেঙে তার ভেতরে কী আছে তা দেখতে চায়।
  4. কল্পনার চাহিদা: শিশু কল্পনাপ্রবণ। সে গল্প শুনে কল্পনায় রূপকথার রাজ্যে বিচরণ করে আনন্দ পায়।

(3) সামাজিক চাহিদা: 

শিশু জন্মায় সামাজিক পরিবেশে। সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই তার বিকাশ ঘটে। তাই তার মধ্যে কতকগুলি সামাজিক চাহিদা পরিলক্ষিত হয়। এই চাহিদাগুলি হল-

  1. দলবদ্ধ হওয়ার চাহিদা: কোনো শিশুই একা থাকতে চায় না। সে তার বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে থাকাটাই পছন্দ করে।
  2. সমবেদনার চাহিদা: শিশু কোনো কারণে শরীরে ব্যথা পেলে পিতা-মাতা ও অন্যান্য বয়স্কদের কাছ থেকে সমবেদনা প্রত্যাশা করে।
  3. প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাহিদা: শিশুরা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছোনোর জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
  4. সহযোগিতার চাহিদা: শিশুরা বড়োদের কাছ থেকে সব কাজে সহযোগিতা পেতে চায়। এই চাহিদাপূরণের জন্য বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে তারা বড়োদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

শৈশবের উপরিউক্ত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শৈশবের শিক্ষাব্যবস্থা রচনা করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুনLink
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তরClick Here
চার্বাক সুখবাদ প্রশ্ন উত্তরClick Here
পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা প্রশ্ন উত্তরClick Here

Leave a Comment