নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা ও গুরুত্ব আলোচনা করো

নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা ও গুরুত্ব আলোচনা করো

নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা ও গুরুত্ব আলোচনা করো
নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা ও গুরুত্ব আলোচনা করো

নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা

অবাধ শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র প্রহসনে পরিণত হবে, একথা উপলব্ধি করেই সংবিধান প্রণেতারা অবাধ ও স্বাধীন নির্বাচন পরিচালনা করার মাধ্যমে ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় ও সাফল্যমন্ডিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই গণপরিষদ একটি নিরপেক্ষ সংস্থা নির্বাচন কমিশন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের পথে কতকগুলি প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এগুলি হল-

(1) নির্বাচন কমিশন গঠনে শাসক দলের ভূমিকা

সংবিধানে মুখ্য নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার-সহ সদস্যদের যোগ্যতা ও কার্যকাল সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। এক্ষেত্রে পার্লামেন্ট নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা লাভ করেছে। তবে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত এ বিষয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রপতি যেহেতু একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসক, সেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে তার পরামর্শদাতা প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভাই প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এম ভেঙ্কটরঙ্গাইয়া (M) Venkatarangayya)-র মতে, এই ব্যবস্থায় মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনের অন্যান্য সদস্যরূপে শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি আস্থাশীল প্রশাসকদের নিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আঞ্চলিক কমিশনারদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

(2) কর্মী নিয়োগে অক্ষমতা

নির্বাচন কমিশনের হাতে নির্বাচন পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব থাকলেও, এই বিরাট কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী নিয়োগ করা, চাকুরির শর্তাদি নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে নেই। এমনকি কমিশনের নিজস্ব কোনো স্থায়ী কর্মচারী নেই। কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে কমিশনকে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালদের উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু ভারতের সুপ্রিমকোর্ট, কেন্দ্রীয় জনপালক কৃত্যক কমিশনকে নিজেদের প্রয়োজনীয় কর্মী নিজেদের নিয়োগের ব্যাপারে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

(3) কমিশনের নিরপেক্ষতার অভাব

নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণরূপে শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয়, ফলে কমিশনের কাজে বিভিন্ন সময়ে পক্ষপাতিত্ব পরিলক্ষিত হয়। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের কার্যকালের মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষমতা কেন্দ্র সরকারের হাতে ন্যস্ত, ফলে তারা স্বাধীন ভূমিকা পালনের পরিবর্তে সরকারের অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনাররা তাদের পদ থেকে অব্যাহতি লাভ করার পর যে-কোনো পদে নিযুক্ত হতে পারেন। এক্ষেত্রে কোনো সাংবিধানিক বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি, ফলে কমিশনারগণ ভবিষ্যতে পদলাভের আশায় নিরপেক্ষভাবে কার্যসম্পাদন করেন না।

আবার, কমিশনার পদে পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রেও কোনো বাধা না থাকায় তারা পুনর্নিযুক্ত হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দল বা জোটের হয়ে কাজ করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে কে ভি রাও (KV Rao) বলেছেন, এগুলির জন্য কমিশনের নিরপেক্ষতা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অতীতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সুকুমার সেন, কে ডি সুন্দরমের কার্যকালের মেয়াদ বাড়িয়ে ৮ বছর করা হয়। কিন্তু একই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এস এল শাকধের-এর কার্যকাল বৃদ্ধি করা হয়নি।

অনেকে মনে করেন, ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে উত্তরপ্রদেশের গাড়োয়াল লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতৃত্ব হেমবতী নন্দন বহুগুণা (Hemwati Nandan Bahuguna) দুর্নীতি ও কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বাতিলের আবেদন জানালে শাকধের তাঁর আবেদনে সাড়া দেন, ফলে তিনি কংগ্রেসের বিরাগভাজন হন। এ কারণেই তাকে পুনর্নিয়োগ করা হয়নি।

অন্যদিকে, সুকুমার সেনকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (Vice-Chancellor) পদে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং আইন কমিশনের সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন কে ভি সুন্দরম। তাই সমালোচকদের মতে, প্রশাসনের কৃপাদৃষ্টিতে থাকার জন্যই তারা সরকারবিরোধী পদক্ষেপ নেয় না ফলে অবসর গ্রহণের পর গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে পারেন।

(4) কমিশনের সুপারিশ মান্যতায় বাধ্যবাধকতার অভাব

বিভিন্ন সময় দেশের নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে কমিশন যেসব সুপারিশ ও পরামর্শ দিয়ে থাকে, তা মানতে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য নয়। কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের ক্ষেত্রে এটি একটি অন্তরায় বলে মনে করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন নির্বাচন বিভাগ (Independent Election Depertment) গঠনের প্রস্তাব দিলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। আবার, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে ভারসাম্য রেখে লোকসভার আসন বৃদ্ধির পরামর্শ দিলেও তা খারিজ হয়ে গেছে। কেবলমাত্র কমিশনের সুপারিশ শাসকদলের স্বার্থের অনুকূল হলে তা স্বীকার করা হয়।

(5) আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের উপর নির্ভরশীলতা

নির্বাচন পরিচালনা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের উপর কমিশনকে নির্ভর করতে হয়। নির্বাচন পরিচালনার সময় রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও পুলিশ আধিকারিকরা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনি কাজকর্ম পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। বস্তুত, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছাড়া কমিশন নিরপেক্ষভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে না।

(6) পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা

নির্বাচন কমিশন অনেকসময় কেন্দ্র সরকার, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর চাপে বা পরামর্শে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করা বা নির্বাচন স্থগিত রাখার কাজটি সম্পাদন করে। ফলত, কমিশন শাসকদলের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয় বলে অনেকে সমালোচনা করেছেন।

(7) ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা

নির্বাচনের সময় ব্যাপক দুর্নীতি, হিংসার প্রয়োগ, ভোট জালিয়াতি, ভোটকেন্দ্র দখল, নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব ইত্যাদি দমন করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে বলে সমালোচিত হয়েছে। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির নির্বাচনকেন্দ্র আমেঠিতে ব্যাপক বুথ রিগিং ও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। পুপুল জয়কার, সোলি সরাবজি, রজনী কোঠারি-সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই ঘটনাকে ‘গণতন্ত্রের উপর চরম আক্রমণ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতিবাদপত্র প্রেরণ করেছিলেন এবং আমেঠি নির্বাচন কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলেন। যদিও কমিশন মাত্র কয়েকটি বুথেই পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দিয়েছিল।

(8) নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজ্যের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা

নির্বাচন কমিশনের গঠন বিষয়ে অঙ্গরাজ্যগুলির কোনো ভূমিকা থাকে না। প্রকৃতভাবে নির্বাচন পরিচালনার দায় কেন্দ্র সরকারের হাতে অর্পিত। তারাই নির্বাচন কমিশন সম্পর্কিত যাবতীয় আইন প্রণয়নের অধিকারী। এমনকি পার্লামেন্ট কেন্দ্র ও রাজ্য আইনসভার নির্বাচনের ব্যাপারে আইন তৈরি করতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখেই নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এখানে নির্বাচন পরিচালনার দায়ভার রাজ্যগুলির হাতে অর্পিত, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নয়। যদিও এ প্রসঙ্গে সকলের অভিমত যে, ভারতীয় নির্বাচন ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি বিরোধী হলেও জাতীয় ঐক্য স্থাপনের উপযোগী।

(9) সাংবিধানিক ত্রুটি

যে কমিশনের উপর সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, সেই কমিশনের নিরপেক্ষতা পালনে সব থেকে বড় প্রতিবন্ধকতা হল সাংবিধানিক ত্রুটি। কারণ, সংবিধানে কমিশনারদের যোগ্যতা, কার্যকালের মেয়াদ, কমিশনের গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি পরিবর্তে, যাবতীয় ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের চাকুরির শর্তসমূহ রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ করেন। রাষ্ট্রপতিই মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে ছয় বছরের জন্য নিযুক্ত করেন। এমনকি তাঁর কার্যকালের মেয়াদ বাড়ানো হবে কিনা তাও নির্ভর করে রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির উপর। ফলে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের নিরপেক্ষতা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে অধ্যাপক মাহেশ্বরী-র মতে, মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে ভারতের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দলের নেতা প্রমুখের সঙ্গে আলোচনা করে তবেই নিয়োগ করা উচিত।

(10) ভোটার তালিকা প্রণয়নের ত্রুটি

ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও সংশোধনের ক্ষেত্রে কমিশনের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। ভোটের তালিকা প্রকাশের পর তালিকায় নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি নজরে আসে। মৃত ব্যক্তির নাম তালিকায় থেকে যায়, বহু নতুন ভোটারের নাম তালিকাভুক্ত হয় না, জীবিত ব্যক্তির নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়, তালিকায় একই ব্যক্তির একাধিকবার নাম নথিভুক্ত থাকে ইত্যাদি।

(11) নির্বাচনি ব্যয় সংকোচ করতে ব্যর্থ

নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় কমিশন ব্যয়ের সর্বোচ্চসীমা ধার্য করে দেওয়ার পরেও রাজনৈতিক দলগুলি নির্দিষ্ট পরিমাণ অপেক্ষা অনেক বেশি ব্যয় করে এবং খরচের হিসাব পেশ করার সময় নানান কারচুপি করে। কমিশন এই বিষয়ে অবগত হলেও উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে।

(12) বৈষম্যমূলক আচরণ

এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অন্যতম সমালোচনা হল নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল দল সমান সুবিধা ও সম্পদ লাভের অধিকার পায় না। প্রকৃতপক্ষে, সকলের সমান সুযোগ ও সম্পদ লাভের অধিকার রয়েছে কিন্তু বাস্তবে তা হয় না বরং এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলই অধিক সুযোগসুবিধা লাভ করে থাকে। বলা যায়, কমিশনই অধিক সুবিধা পাওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেয়।

ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব

ভারতে নির্বাচন কমিশন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর গুরুত্ব হিসেবে যে বিষয়গুলি আলোচনা করা যায় তা হল নিম্নরূপ-

(1) অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন

নির্বাচন কমিশন লোকসভা, রাজ্যসভা এবং রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নির্বাচন কমিশন বিশ্বাসযোগ্যতা, জবাবদিহিতা দায়বদ্ধতা এবং পেশাদারিত্বের দ্বারা নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে।

(2) জনগণের অধিকার নিশ্চিতকরণ

নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ভোটারকেন্দ্রিক এবং ভোটারবান্ধব পরিবেশে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে সমস্ত যোগ্য নাগরিকদের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করে।

(3) রাজনৈতিক দলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ

ভারতে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলির কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে এবং নির্বাচনি আইনগুলির সঙ্গে তাদের সহমত ও সম্মতিকে সুনিশ্চিত করে, যাতে বহুদলীয় ব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলির মধ্যে একটি সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এভাবেই রাজনৈতিক দল, ভোটার, নির্বাচনি কর্মী, প্রার্থী এবং জনগণ সকলের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয় এবং দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।

(4) মূল্যবোধের সংরক্ষণ

সংবিধানে সংরক্ষিত মূল্যবোধকে সমর্থন করে নির্বাচন কমিশন ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে সফলভাবে জাতীয় ও রাজ্য নির্বাচন পরিচালনা করে আসছে। যেমন-সমতা, ন্যায়পরায়ণতা, নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা, শাসকের উপর তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা এবং আইনের শাসন ইত্যাদি। বর্তমানে এটি নির্বাচনে জনগণের বৃহত্তর অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

(5) নির্বাচনি আইনের প্রয়োগ

নির্বাচনে দুর্নীতি এবং অযাচিত প্রভাবের মতো অসদাচরণ প্রতিরোধ করতে নির্বাচনের সময় আদর্শ আচরণবিধি বলবৎ করে এবং নির্বাচনি প্রচার সংক্রান্ত নিয়ম মেনে চলাকে নিশ্চিত করে।

(6) ভোট গ্রহণের ব্যবস্থাপনা

ভোট গ্রহণের ব্যবস্থাপনা করা নির্বাচন কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সারা দেশজুড়ে ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্র (EVM) -এর মাধ্যমে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থাপনা, ভোটারদের সচিত্র পরিচয়পত্র প্রদান ইত্যাদি বিষয়গুলি এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। কমিশন সমস্ত রাজ্য সরকার ও দলকে এই ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য করেছে। নির্বাচন কমিশন বর্তমানে সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে আদর্শ আচরণবিধি মেনে চলার নির্দেশ জারি করে। নির্বাচনি প্রচার অভিযানে মুখ্যমন্ত্রীদের সরকারি গাড়ি, হেলিকপ্টার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলিকে নির্বাচনি প্রচারের রাজ্যভিত্তিক সর্বোচ্চ ব্যয়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে হলফনামা (Affidavit) দিয়ে জানানোর নির্দেশ দিয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন জাতীয় দলগুলিকে নিজেদের সাংগঠনিক নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমাধান করার কথাও জানিয়েছেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, সম্পত্তির বৈধ হিসাব-সহ ব্যক্তিগত হলফনামা পেশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এভাবে কমিশন একটি প্রগতিশীল ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নির্বাচন কমিশনের এসব সংস্কার সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থার মর্যাদাকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে।

সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক নীতিগুলিকে সমুন্নত রাখার জন্য এবং নির্বাচনের মাধ্যমে যাতে জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে, তা নিশ্চিত করতে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব অপরিসীম।

উপসংহার

ভারতের নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন, স্বতন্ত্র এবং নিরপেক্ষভাবে গড়ে তোলার জন্য সাংবিধানিক ব্যবস্থা গৃহীত হলেও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে একেবারে ত্রুটিমুক্ত করা যায়নি। বরং, নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে নানান ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। ভারতের নির্বাচন কমিশনের গঠন ও ভূমিকা মূল্যায়ন করে অধ্যাপক মাহেশ্বরী বলেছেন, গণতন্ত্রের চারটি মূল স্তম্ভ সুপ্রিমকোর্ট, রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন, নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক এবং নির্বাচন কমিশনের মধ্যে শেষেরটি হল সব থেকে দুর্বলতম (Weakest Pillar of our Democracy)। কারণ, নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতে ন্যস্ত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে কমিশনকে কেন্দ্রীয় সরকারই পরিচালনা করে।

আবার সাম্প্রতিককালে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাস, জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রসার ইত্যাদি কারণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এতসত্ত্বেও বলা যায়, ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি প্রধান স্তম্ভ হল নির্বাচন কমিশন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশন তাঁর নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন, কমিশন শাসকদলের অনুগত কোনো সংস্থা নয় বরং একটি নিরপেক্ষ সংস্থা। তিনি বিহার ও উত্তরপ্রদেশে অবাধ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন এবং দুটি সাধারণ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত করার মাধ্যমে ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।

এ ছাড়া এম এস গিল ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে তার সাংগঠনিক নির্বাচন শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কংগ্রেস (ই) দল তা অমান্য করায় উক্ত দলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (Show Cause Notice) দেওয়ার মাধ্যমে তিনি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন। জে এম লিংডো গুজরাটে সাধারণ নির্বাচন সংঘটিত করার পরিস্থিতি নেই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দেন কেন্দ্র সরকারের অনুগত থাকা অপেক্ষা সাংবিধানিক দায়িত্বপালন অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে নির্বাচন কমিশনকে ‘দুর্বলতম স্তম্ভ’ হিসেবে বিবেচনা করা অনুচিত।

এমনকি সম্প্রতি ভারতের নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে দেশের সাধারণ নির্বাচন ও রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন পরিচালনা করে চলেছে। সম্প্রতিককালে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা তার প্রাপ্য সাংগঠনিক মর্যাদা ও ক্ষমতা অর্জন করতে সফল হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। বর্তমানে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শোধন করার জন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য কমিশনের ক্ষমতা, কার্যকারিতা, উপকারিতা এবং সহযোগিতার এক্তিয়ারকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে।

তবে নির্বাচন কমিশনের কাজকে আরও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ করে তোলার জন্য দেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল নির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে হবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মাহেশ্বরী-র সুপারিশ হল যে, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের প্রধান বিচারপতি ও লোকসভার বিরোধী জননেতার পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি প্রয়োজন ভোটদাতাদের সচেতনতা। কারণ ভোটদাতাদের সক্রিয় সহযোগিতা পেলে এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে এগিয়ে এলে নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে পারবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন – গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দাও

Leave a Comment