উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ
আধুনিক রাষ্ট্রে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ-
(1) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য
উদারনৈতিক গণতন্ত্রে জনগণই হল রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রধান উৎস। এখানে রাজনৈতিক সাম্যের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। বর্তমান রাষ্ট্র মূলত আয়তন ও আকৃতিতে বিশাল ও বিপুল। ফলত, জনগণ পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করে। সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের মাধ্যমে এক ব্যক্তি এক ভোট-এই নীতির ভিত্তিতে নাগরিকদের ভোটদানের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এখানে। উদার গণতন্ত্রে জনগণের শাসন কার্যত সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়, তবে তা জনসাধারণের সর্বাধিক হিতসাধনে পরিচালিত হয়ে থাকে। কোনো বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণির স্বার্থে গণতান্ত্রিক সরকার কাজ করে না বলে মনে করা হয়।
(2) পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার
উদারনৈতিক গণতন্ত্র ব্যক্তির সার্বিক বিকাশে বিশেষভাবে আগ্রহী। তাই এখানে প্রতিটি নাগরিকের পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ব্যক্তির পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারগুলির মধ্যে অন্যতম হল-জীবনের অধিকার, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, নির্বাচিত হওয়ার ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার, যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি পদ লাভের অধিকার প্রভৃতি, যা উদার গণতন্ত্রে বর্তমান থাকে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই অধিকারগুলি অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কথা বলা যেতে পারে। এই সকল উদারনৈতিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারগুলি সংবিধান কর্তৃক লিপিবদ্ধ করা হয়ে থাকে।
(3) সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষা
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। কিন্তু সেই শাসন যাতে স্বৈরাচারী না হয়ে উঠতে পারে, সেদিকেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এই শাসনব্যবস্থায় সংখ্যালঘু শ্রেণির স্বার্থ উপেক্ষিত হয় না। এই শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। যেমন-কেন্দ্র ও রাজ্য আইনসভাতে তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য আসন সংরক্ষণ, সরকারি চাকুরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণ, সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, সুনির্দিষ্ট ভোটপদ্ধতি ইত্যাদি। এই সকল বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করা হয়।
(4) সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার
সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। গণতন্ত্র-এর অর্থ হল জনগণের শাসন। তাই জাতি, বর্ণ, ধর্ম, স্ত্রী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন, অভিজাত-অভাজন নির্বিশেষে সকলের সমান ভোটাধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের মাধ্যমে গণসার্বভৌমিকতার তত্ত্বকে বাস্তবে রূপায়িত করার প্রচেষ্টা করা হয়।
(5) সংবিধানের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা
উদার গণতন্ত্রে দেশের সর্বোচ্চ ও মৌলিক আইন হিসেবে সংবিধানের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুই বিভাগ যথা-শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগকে সংবিধানের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে নিজ নিজ কার্যসম্পাদন করতে হয়। এরূপ শাসনব্যবস্থায় দেশের সংবিধান জনগণের দ্বারা রচিত এবং জনগণের শাসনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য গৃহীত হয়। তাই বর্তমানে অধিকাংশ উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবটি ‘We the People’ বা ‘আমরা জনগণ’-এই শব্দগুলি দিয়ে শুরু হয়, যা উপরোক্ত ধারণাটিরই তাৎপর্য বহন করে। আর এভাবেই এরূপ শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের প্রাধান্যকে সর্বাগ্রে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে।
(6) আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা
উদার গণতন্ত্রে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত। এরূপ শাসনব্যবস্থায় আইনের দৃষ্টিতে সাম্য (Equality before the law) এবং আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার (Equal protection of the laws)-কে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বল যায়, ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নং ধারায় আইনের অনুশাসনের এই দুই নীতির উল্লেখ রয়েছে। এই নীতিগুলির মাধ্যমে মূলত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপরই গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে।
(7) বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা
উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতি বাঞ্ছনীয় বলে মনে করা হয়। আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের স্বৈরাচারী কার্যকলাপ থেকে ব্যক্তির অধিকারকে সংরক্ষিত করতে এবং সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা, রক্ষাকর্তা ও অভিভাবক হিসেবে ব্যক্তির মৌলিক অধিকারগুলিকে সংরক্ষিত করতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(8) সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন
উদার গণতন্ত্রে বৈপ্লবিক বা হিংসাত্মক উপায়ের পরিবর্তে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সুষ্ঠুভাবে সরকারের পরিবর্তন ঘটে। এরূপ শাসনব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট কার্যকলাপের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর সরকারের রদবদল ঘটানো সম্ভব হয় বলে মনে করা হয়। অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ই ভি এম মেশিন (EVM), ব্যালট বাক্স (Ballot Box) ইত্যাদির সাহায্যে জনগণ শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজেদের পছন্দমতো জনকল্যাণমূলক এবং সামাজিক উন্নয়নমুখী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
(9) বহুদলীয় ব্যবস্থার স্বীকৃতি
উদারনৈতিক গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বহুদলীয় ব্যবস্থার স্বীকৃতি। কারণ যে রাষ্ট্রে একদলীয় ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে কখনোই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বাস্তবে সকল শ্রেণির মানুষের বহুবিধ স্বার্থ এবং নানান সমস্যার প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব হয় বলে, তার সুষ্ঠু সমাধান করাও সহজসাধ্য হয়। সমাজস্থ সকল নাগরিকদের নিজ নিজ মতামত অর্থাৎ, জনমত এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রকাশের স্বাধীনতাকে এখানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাছাড়া বিরোধী দলগুলি এখানে সরকারের স্বৈরাচারী কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে থাকে।
(10) জনকল্যাণকর রাষ্ট্র
জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে বলে উদারপন্থীরা মনে করেন। তাই তারা মনে করেন, উদারনৈতিক গণতন্ত্রে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতার নীতির পাশাপাশি সুপরিকল্পিত গণতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাকে গ্রহণ করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্যকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে ক্ষেত্রভিত্তিক শিল্পের জাতীয়করণ, ব্যাবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ব্যবস্থা এরূপ রাষ্ট্রে গ্রহণ করা হয়েছে।
(11) আমলাতন্ত্রের অস্তিত্ব
আধুনিক রাষ্ট্র জনকল্যাণকামী। কিন্তু উদার গণতন্ত্রে নির্বাচনে জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব, নির্বাচিত নেতাদের প্রশাসনিক দক্ষতা, যোগ্য ও অভিজ্ঞতার অভাব, শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশে ঘন ঘন পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক আদর্শ যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে শাসন বিভাগের অরাজনৈতিক অংশ তথা আমলাতন্ত্রকে অধিক গুরুত্ব ও প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। তাই বলা যায়, উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বহুলাংশে আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
(12) স্বার্থগোষ্ঠীর উপস্থিতি
উদার গণতন্ত্রে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীগুলি সরকারের নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানগুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ কঠোরভাবে প্রযুক্ত থাকে না। ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই গোষ্ঠীগুলি নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য সর্বতোভাবে উদ্যোগী হয়। এক্ষেত্রে তারা আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এমনকি প্রয়োজনানুসারে বিচার বিভাগের দ্বারস্থও হয়ে থাকে।
(13) গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
এরূপ শাসনব্যবস্থায় সংবাদপত্র, বেতার মাধ্যম, দূরদর্শন প্রভৃতি গণমাধ্যমগুলির অবাধ স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। ফলে কোনোরূপ বাধানিষেধ, নিয়ন্ত্রণ ব্যতীতই গণমাধ্যমগুলি সরকারি ক্রিয়াকলাপের সমালোচনা করতে সক্ষম।
(14) ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার
সর্বোপরি, উদারনৈতিক গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে অবাধে স্বীকৃতি দান করা হয় এবং মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার অস্বীকৃত হলে জনসাধারণের কর্মে অনীহা দেখা দেবে বলে মনে করা হয়। ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যাহত হবে। তবে, আধুনিককালে কিছু কিছু রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত মালিকানার উপর শর্তসাপেক্ষ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, – ভারতীয় সংবিধানে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকারের অধ্যায় থেকে – বাদ দিয়ে বর্তমানে আইনগত অধিকারের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে।
উপসংহার
গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলি তত্ত্বগতভাবে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করা হলেও কার্যত নানান ক্ষেত্রে অসংগতি ও অসম্পূর্ণতা পরিলক্ষিত হয়। সাম্য, সমানাধিকার, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলির বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব হলেও বাস্তবে যেহেতু অর্থনৈতিক সাম্যকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না, তাই অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলি অর্থহীন হয়ে পড়ে। এজন্য অনেকে মনে করেন, উদার গণতন্ত্র অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ায় সমাজে আক্ষরিক অর্থে সাম্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি।
আবার, অনেকে বলেছেন, এরূপ গণতন্ত্র আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারকে প্রাধান্য দিলেও, বাস্তবে এই শাসনব্যবস্থা প্রভুত্বকারী শ্রেণির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, উদার গণতন্ত্র যেহেতু ধনবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার অন্যতম রূপ, তাই এখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে অ্যালান বল (Alan Ball) মন্তব্য করেছিলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ‘আধা-অলীক’ (Semi- fiction) ধারণা। তবে, ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও উদার গণতন্ত্রের উপযোগিতাকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বৈরাচারী অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার চেয়ে উদার গণতন্ত্র অধিক কাম্য। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা যায়।
Read More – The Garden Party Question Answer