জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে যুক্তি দাও

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে যুক্তিসমূহ
(1) বহুবিভক্ত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সৃষ্টি
‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’ নীতি স্বীকৃত হলে পৃথিবীর সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলি বহুবিভক্ত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তার ফলে বিশ্বজুড়ে বিশৃঙ্খলা ও জটিল রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র যে শুধু আকৃতিতে ক্ষুদ্র হবে তাই-ই নয়, প্রকৃতিতেও এই রাষ্ট্রগুলি দুর্বল হয়ে পড়বে। এসব ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্র কখনও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারবে না। এরা বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির শিকারে পরিণত হবে। যা ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলির স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করবে। অধ্যাপক ফ্রিডম্যান (Milton Friedman) বলেছেন, ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির স্বাধীনতা অলীক কল্পনামাত্র।
(2) বাস্তবে পুরোপুরি অকার্যকর
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে একটি প্রধান যুক্তি হল এই যে, তত্ত্বটি বাস্তবে পুরোপুরি কার্যকর করা অসম্ভব। একই ভৌগোলিক পরিবেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দীর্ঘকাল পরস্পর একত্রে বসবাস করার ফলে তাদের বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না। উদাহরণস্বরূপ অবিভক্ত ভারতে জাতীয়তাবাদে ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও বহু মুসলমান গোষ্ঠীর মানুষ ভারতে রয়ে গেছেন। অনেকে মনে করেন, কোনো দেশে একাধিক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে একাত্মবোধ থাকে, এই নীতি রূপায়িত হলে তা বিনষ্ট হয়ে গুরুতর অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকট দেখা দিতে পারে। এই নীতি যদি বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে ব্রিটেন চারটি এবং সুইটজারল্যান্ড তিনটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়বে যা বাস্তবে কাম্য নয়।
(3) বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে উন্নত
ইংরেজ দার্শনিক লর্ড অ্যাক্টন (Lord Acton)-এর বক্তব্য হল, বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে উন্নততর পর্যায়ে যেতে সমর্থ হয়। কারণ, অনগ্রসর জাতিগুলি অগ্রসর জাতির সান্নিধ্যে বসবাস করে উন্নত হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের ফলে এক উন্নত সভ্যতার জন্ম হয়। অপরদিকে, রাষ্ট্রীয় সীমারেখার ভিতর যেখানে শুধু একটিমাত্র জাতি বসবাস করে, সেই সমাজ অনগ্রসর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ব্লুন্টস্ট্সি-র মতে, বিভিন্ন জাতির উপাদানের সমন্বয়েই কোনো রাষ্ট্রের উৎকর্ষ এবং বৈচিত্র্যের প্রসার ঘটে। বহু জাতি সমন্বিত রাষ্ট্রে শিল্প, সাহিত্য, চারুকলা ও বিজ্ঞানের সুদূরপ্রসারী উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ড, সুইটজারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশের কথা বলা যায়।
(4) উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি
বহু জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলিকে জাতীয়তার ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন করা হলে উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়। জাতীয়তার ভিত্তিতে অবিভক্ত ভারত বিভাগের ফলে বহু হিন্দু পরিবার উদ্বাস্তু হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন। এর ফলে ভারতে তীব্র উদ্বাস্তু সমস্যা দেখা দেয়।
(5) অবিভক্ত ভারত খন্ডিত হয়
উইলসন-এর বক্তব্য ছিল, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারতত্ত্ব সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানে ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে-সমালোচকরা এ যুক্তি মানতে পারেননি। এই নীতির ভিত্তিতে অবিভক্ত ভারত দ্বিখন্ডিত হয়, তা সত্ত্বেও ভারত ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘু জাতি সমস্যার সমাধান হয়নি। দু-দেশের মধ্যে কয়েকবার সংঘর্ষও ঘটে গেছে। এমনকি এখনও দু-দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হয়নি।
(6) বৈরী মনোভাব ও সংশয়ের উদ্ভব
বহু জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বর্তমান থাকায় তাদের মধ্যে বৈরী মনোভাব ও সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে, যার ফলে দেশপ্রেম বিনষ্ট হতে পারে বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, তাও অমূলক বলে সমালোচকরা মনে করেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে সুইটজারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশের কথা বলা হয়। এই দেশগুলি বহুজাতির সমন্বয়ে গঠিত তা সত্ত্বেও দেশপ্রেম বা রাষ্ট্রীয় একতার কোনো অন্তরায় সৃষ্টি হয়নি।
(7) অগণতান্ত্রিক
যারা গণতন্ত্রের সাফল্যের সপক্ষে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্বের কথা বলেন, তাঁদের যুক্তিও অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। এক জাতি তত্ত্বের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। বহু জাতিভিত্তিক ভারতবর্ষ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সুইটজারল্যান্ডের অধিবাসীরা কোনো অংশে কম গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করেন না।
(8) লর্ড কার্জনের অভিমত
লর্ড কার্জন (Lord Curzon)-এর অভিমত অনুযায়ী, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কিত তত্ত্ব হল এমন একটি অস্ত্র যার দু-দিকেই ধার আছে। যেমন, একদিকে এই নীতিটি একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন করে তুলতে সাহায্য করে, অন্যদিকে তেমনই বিভিন্ন জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা, বিদ্বেষ ও সন্দেহের সৃষ্টি করে বৈরী মনোভাবের জন্ম দেয়। এর ফলে উগ্র জাতীয়তাবাদ এমনকি যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই অনেকে মনে করেন, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি একটি সীমাহীন দাবি। এই দাবি কার্যকর হলে এই প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকবে, কারণ প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি তাদের নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানাতে থাকবে। আর তাদের এই দাবি পূরণের অর্থই হল একটি বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্র সৃষ্টির পরিবর্তে কতকগুলি দুর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের আবির্ভাবকে সমর্থন করা।
(9) লর্ড অ্যাক্টনের অভিমত
লর্ড অ্যাক্টনের মতে, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইতিহাসের পশ্চাৎগতির ইঙ্গিত দেয়। এই সভ্য যুগে মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে থাকার বদলে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চাইলে তা মানবসমাজের পশ্চাৎগতির সূচনা করে। সেজন্য এই তত্ত্ব সমর্থনযোগ্য নয়। মানুষ যেমন সমাজবদ্ধ জীব, তেমনই রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া সমাজজীবনের স্বার্থে প্রয়োজন।
(10) মার্কসবাদী অভিমত
মার্কসবাদে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রগতিশীল আন্দোলন বলে অভিহিত করা হয়েছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমেও রূপায়িত হওয়া সম্ভব। এজন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রয়োজন পড়ে না, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় বহু জাতি একত্রে নিজ নিজ আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে অতি সহজেই ভারতবর্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা উল্লেখ করা যায়।
(11) অসমর্থনযোগ্য
অনেকে এই নীতিটিকে অসমর্থনযোগ্য বলে মনে করেন। কারণ, বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক স্তরে নানা দিক থেকে অধিক শক্তিশালী ও উন্নত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ ব্রিটেন, গণপ্রজাতন্ত্রী চিন প্রভৃতি রাষ্ট্রের কথা বলা যায়। তাই, এক জাতি এক রাষ্ট্র তত্ত্বের চেয়ে বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র সর্বাধিক কাম্য বলে অনেকে মনে করেছেন।
(12) সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা
একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতির উপস্থিতি থাকলেই যে প্রতিটি জাতির মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব প্রতিষ্ঠা পাবে, তা কিন্তু সঠিক নয় বলেই অনেক মনে করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চিনে প্রায় ৫৬টি ক্ষুদ্র-বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীর বাস রয়েছে। অভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শকে সামনে রেখে কোনোরকম সংঘর্ষের সৃষ্টি না করে সেখানে প্রতিটি জাতি সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে। এরূপ, বিরল দৃশ্য পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক দেশসমূহে দেখতে পাওয়া যায় না বলে অনেকে মনে করেন।
(13) আর্থ-রাজনৈতিক সমস্যা বৃদ্ধি
অনেকে মনে করেন, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র বিভক্ত হয়ে দুটি পাশাপাশি পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হয়। কিন্তু প্রায় একই ভৌগোলিক সীমানা বরাবর একাধিক জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে উঠলে প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে অসমতা দেখা দেয়, যা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির আর্থ-রাজনৈতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। তাই এক জাতি এক রাষ্ট্র নীতি গ্রহণযোগ্য নয়।
উপসংহার
জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্বের মূল্যায়ন করে বলা যায়, বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও তত্ত্বটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পৃথিবীতে পরাধীন জাতিগুলি বিশেষত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার মতো তৃতীয় বিশ্বের নিপীড়িত দেশসমূহ তাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের তত্ত্ব থেকে বিপুল অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর মানচিত্রে এর ফলস্বরূপ ১০০টির মতো স্বাধীন দেশ আত্মপ্রকাশ করে। তত্ত্বটি এদিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ।
Read More – The Garden Party Question Answer