স্বামী বিবেকানন্দের সামাজিক সংস্কার আলোচনা করো

স্বামী বিবেকানন্দের সামাজিক সংস্কার
বিবেকানন্দের সামাজিক সংস্কার সব দিক থেকেই ব্যতিক্রমী এবং ভিন্নধর্মী। তাঁর পূর্বে যাঁরা সামাজিক সংস্কারের কথা ভেবেছেন তাঁরা কেউই সমাজের নিম্নবর্গের প্রান্তিক মানুষদের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেননি, তাঁরা সংস্কার করতে চেয়েছেন উচ্চবর্গের দিক থেকে। অর্থাৎ হতদরিদ্র নয়, অপেক্ষাকৃত ধনী ও সচ্ছল মধ্যবিত্তদের সামাজিক সমস্যাকেই তাঁরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে
গিয়ে লিখেছেন, ‘গত দশ বছর ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করে দেখেছি যে, দেশ সমাজ সংস্কারসাধক প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ। কিন্তু যেসব মানুষ রক্ত শোষণ করে ভদ্রলোক নামে পরিচিত লোকেরা ভদ্রলোক হয়েছেন এবং থাকছেন, সেই সব মানুষের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান দেখতে পাইনি।’
স্বামীজি সমাজের উৎপত্তি ও তার বিবর্তনের এক সুস্পষ্ট ধারণা ব্যাখ্যা করেছিলেন। অতীতকালে জলপথেই একমাত্র দেশের নানাপ্রান্তে এমনকি বিদেশেও যোগাযোগসাধন করা সম্ভব হত। তাই নদীর তীরকে কেন্দ্র করেই সমাজ বা জনপদ গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে নানান কারণে এই সকল জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ, জীবনযাত্রা, কাজকর্ম প্রভৃতির পরিবর্তন ঘটাতে থাকে, যাকে বিবেকানন্দ সামাজিক বিবর্তন আখ্যা দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ গঠনের কাজটি একসময় জটিলরূপ পরিগ্রহ করে।
বিবেকানন্দ সমগ্র মানবজাতির ঐক্য ও সংহতিসাধনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি সামাজিক ভেদাভেদ, বিচ্ছিন্নতার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। পৃথিবীর মানুষের যা কিছু ভালো রয়েছে স্বামীজি সেই সবকিছুই গ্রহণ করার জন্য ভারতবাসীকে আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, সমন্বয়ী সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই এক সভ্য ও আধুনিক সভ্যতা তথা জীবনধারা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। বিবেকানন্দ ছিলেন গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন এক ব্যক্তিত্ব। তিনি স্বাভাবিক সাম্য ও স্বাভাবিক স্বাধীনতাকে একে অপরের পরিপূরক বলে মনে করতেন। স্বামীজি চেষ্টা করেছিলেন সমাজ থেকে অসাম্য, অন্যায়-অবিচারকে দূরীভূত করে এক সুস্থ সামাজিক বাতাবরণ তৈরি করতে।
জাতিভেদ প্রথাকে সমাজ থেকে সমূলে উৎপাটিত করে নিষ্ঠুর সামাজিক নিপীড়ন, শোষণের অবসান ঘটানোর পথনির্দেশ দান করেছিলেন বিবেকানন্দ। তবে অন্যদিকে তিনি আবার মানবসমাজের আর্থিক উন্নয়নের উপরও গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বিবেকানন্দ যে বেদান্ত প্রচারের মাধ্যমে, রামমোহনের মতোই সামাজিক সংস্কার ও রাজনৈতিক চেতনার বিকাশকে তরান্বিত করতে চেয়েছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
স্বামীজির সামাজিক সংস্কারের প্রধান দিকগুলির মধ্যে যেগুলি উল্লেখযোগ্য সেগুলি হল-
(1) দারিদ্র্যমুক্ত ভারত
স্বামীজির সামাজিক সংস্কারের কেন্দ্রে ছিল দারিদ্র্যমুক্ত ভারত। তিনি মনে করতেন, ভারতের জাতীয় জীবন দারিদ্র্যের কুটিরেই বাস করে। এই কারণে জাতীয় উন্নয়ন বলতে স্বামীজি দরিদ্রমুক্তির প্রকৃত উন্নয়নকেই বুঝিয়েছেন। ভারতবাসীর দুঃখ, দারিদ্র্যের যন্ত্রণা, অজ্ঞতার অভিশাপ বিবেকানন্দকে ব্যাথিত করেছিলেন। তিনি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষ অতীতের গৌরবোজ্জ্বল গরিমা থেকে বঞ্চিত হয়ে বর্তমানে দারিদ্র্যতার গ্লানিময় জীবনযাত্রায় নিমজ্জিত হয়েছে। সার্বিক দিক থেকে বিশেষত আর্থিক দিক থেকে ভারতবাসীর অবস্থার উন্নতিসাধন এবং ভারতের অতীত গরিমা ফিরিয়ে আনতে স্বামীজি তৎপর হয়েছিলেন। তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে, দীর্ঘকালযাবৎ শোষণ-পীড়নের ফলে কেবলমাত্র যে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নয়, বরং এর ফলে সমগ্র দেশ শক্তিহীন হয়ে পড়েছে।
ভারতবর্ষের দারিদ্র্যের জন্য স্বামীজি ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিক শাসনকে দায়ী করেছেন। তিনি দারিদ্র্যকে মনুষ্যত্বেরও ক্ষতি বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে, “The one thing that is at the root of all evil in India is the condition of the poor… priest-power and foreign conquest have trodden them down for centuries and at last the poor of india have forgotten that they are human being.”। তাই ভারতের জাতীয় ঐক্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বিবেকানন্দ যে পূর্বশর্তগুলির কথা বলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং এর মধ্যে দিয়ে আপামর ভারতবাসীর ন্যায্য সামাজিক অবস্থানকে প্রতিষ্ঠা করা।
তাঁর স্পষ্ট অভিমত ছিল, খালি পেটে ধর্ম হয় না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নিরন্ন মানুষকে ধর্মের নীতিকথা শোনানো বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ভগবান শুধুই স্বর্গের কথা বলে, খাদ্য জোগাতে পারে না, সেই ভগবানের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না। এজন্য স্বামীজি দরিদ্র নারায়ণ সেবা ধারণাটির উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এর অর্থ হল দরিদ্রদের সেবা করার মধ্য দিয়েই ঈশ্বরকে সেবা করা।
একজন সমাজসংস্কারক হিসেবে হিসেবে বহুকাল পূর্বেই তাই তিনি চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন দারিদ্র্যই হল ভারতের প্রধান সমস্যা এবং এটিই হল ভারতের প্রধান শত্রু। স্বামীজি বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ‘কয়েক হাজার ডিগ্রিধারী ব্যক্তি দিয়ে একটা জাতি তৈরি হয় না, অথবা মুষ্টিমেয় কয়েকটি ধনীও একটি জাতি নয়। চাষা, তাঁতি, মুচি-মেথর, কামার-কুমোর ‘বিজাতিবিজিত স্বজাতি নিন্দিত জাত’-এরাই জাতির মেরুদণ্ড। এদের উন্নতিতেই ভারতে উন্নতি ঘটতে পারে। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে শিকাগো সম্মেলনে যোগদানের পূর্বে তিনি বেশ কয়েকটি প্রাচ্যের দেশ পরিভ্রমণ করেন।
এরপর প্রায় ১৭ দিনযাবৎ অনুষ্ঠিত শিকাগো সম্মেলনে তাঁর প্রদত্ত বক্তৃতাগুলিতে দারিদ্র্যের প্রসঙ্গটি যথেষ্ট পরিমাণে গুরুত্ব লাভ করেছিল। আমেরিকা ভ্রমণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় উদ্দেশ্যের চেয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই তাঁর কাছে অধিক প্রাধান্য পেয়েছিল। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতবাসীর প্রথম প্রয়োজন বুটি, ধর্ম নয়। তাই এ প্রসঙ্গে তিনি স্বামী ব্রহ্মানন্দ-কে বলেছিলেন, “দেখ ভাই এদেশে যেরকম দুঃখ-দারিদ্র্য, এখানে এখন ধর্ম প্রচারের সময় নয়। যদি কখনও এদেশের দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করতে পারি, তখন ধর্মকথা বলব। সেই জন্য কুবেরের দেশে যাচ্ছি, দেখি যদি কিছু উপায় করতে পারি” (স্বামী অখণ্ডানন্দ স্মৃতিকথা)।
(2) শিক্ষার প্রসার
স্বামীজির সামাজিক সংস্কারের ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হল শিক্ষার প্রসার। তিনি দেখেছিলেন নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের অন্ধকারে ডুবে রয়েছে ভারতবর্ষের এক বিশাল অংশের হতদরিদ্র মানুষ। তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষার আলোয় অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য নিছক জ্ঞানচর্চা নয়, শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা। তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজের পরিবর্তন সম্ভব। এজন্য তিনি জনগণের সার্বিক শিক্ষার কথা প্রচার করেন, যে শিক্ষা নারী তথা • নিম্নবর্গের জাতিকে সামাজিক স্তরে উন্নীত করতে সাহায্য করবে। তাই তিনি ব্যবহারিক (Practical) ও বৃত্তিমূলক (Vocational) শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন, যা ব্যক্তিকে দৈনন্দিন সমস্যার মোকাবিলা করতে এবং জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে প্রস্তুত করবে।
উপযুক্ত শিক্ষা ও চেতনা ব্যতিত সমাজ পরিবর্তন যে কল্পনাতীত তিনি তা জানতেন। যুক্তি, বুদ্ধি, সৃজনশীলতা, সদ্গুণ, উদারতা এগুলি বিকাশের উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কিন্তু তিনি মানুষের চিন্তাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার বিরোধী ছিলেন। তাই তিনি শিক্ষায় নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার কথা বলেন। তাঁর মতে, শিক্ষার লক্ষ্য হল চরিত্র গঠন। রক্ষণশীল মনোবৃত্তি বর্জন, দেশ-বিদেশের শিক্ষা অর্জন, নানান অভিজ্ঞতা অর্জন, স্বাজাত্যবোধ ইত্যাদিকে তিনি গ্রহণ করতে নির্দেশদান করেছিলেন। জনশিক্ষায় তাঁর বিপুল আগ্রহ ছিল।
তিনি লিখেছিলেন, “যদি আমরা গ্রামে গ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় খুলিতে সমর্থ হই তবু দরিদ্র ঘরের ছেলেরা সেসব স্কুলে পড়িতে আসবে না। কারণ ভারতে দরিদ্র এত অধিক যে, দরিদ্র বালকেরা বিদ্যালয়ে না গিয়া বরং মাঠে গিয়া তাহার পিতাকে কৃষিকার্যে সহায়তা করিবে অথবা অন্য কোনোরূপ জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা করিবে; সুতরাং যেমন পর্বত মহম্মদের নিকট না যাওয়াতে মহম্মদই পর্বতের নিকট গিয়েছিলেন, সেইরূপ দরিদ্র বালকগণ যদি শিক্ষা লইতে আসিতে না পারে, তবে শিক্ষাকেই চাষির লাঙলের কাছে, মজুরের কারখানায় এবং অন্যত্র সকল স্থানে পৌঁছিতে হইবে।”
তাঁর এই আদর্শের ভিত্তিতে এবং অনুপ্রেরণায় ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১ মে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। সামাজিক সংস্কার বিষয়ে স্বামীজির উদ্যোগ কেবলমাত্র তত্ত্বকথা বা প্রচারের মধ্যেই থেমে থাকেনি, তা মূলত বাস্তবে রূপায়িত হয়েছিল এই রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। ভারত তথা বিশ্বের মানুষের সামাজিক, শিক্ষাগত, ধর্মীয় উন্নতিসাধনের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তীকালে তার কার্যপরিচালনা চালিয়ে যেতে এবং বিশ্বজুড়ে বিবেকানন্দের আদর্শকে প্রচার করতে সক্ষম হয়।
- রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা ও সমাজকল্যাণ: বিবেকানন্দের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের একটি গৌরবোজ্জ্বল দিক হল পরাধীন ভারতে সংগঠিত সমাজকল্যাণের উদ্দেশ্যে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা। স্বামীজি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ২১ ফ্রেব্রুয়ারি এক চিঠিতে মিশনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে জানান, ‘আমাদের কাজ হচ্ছে, অনাথ, দরিদ্র, মূর্খ, চাষাভুষোর জন্য আগে তাদের জন্য করে যদি সময় থাকে তো ভদ্রলোকের জন্য।’ রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হিসেবে তিনি বলেছেন-
- বেদান্ত ও ধর্মচর্চার বিষয় জনসাধারণকে উৎসাহিত করে তোলা। তবে তিনি স্পষ্টভাবে একথা উল্লেখ করেছিলেন যে, মিশনের সঙ্গে রাজনীতির কোনোরূপ সম্পর্ক থাকবে না।
- জনসাধারণের বৈষয়িক ও মানসিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে শিল্প ও কারিগরি বিষয়ে তাদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর দুঃখ-দুর্দশা মোচনের তাগিদ ছিল তার কাছে সবচেয়ে বেশি।
(3) নারীর ক্ষমতায়ন
স্বামীজির সমাজ সংস্কারের ভাবনায় নারীমুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীশিক্ষা একটি বৃহৎ অংশ জুড়ে ছিল। বিবেকানন্দ নারী শিক্ষার উপর জোড়ালভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজের উন্নয়নের কেন্দ্রে শিক্ষিত নারীর ভূমিকা অন্তর্নিহিত থাকে। তিনি নারী ও পুরুষের আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন উভয়েরই আধ্যাত্মিক অবস্থা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁর জন্য তিনি আধ্যাত্মিক অনুশীলনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। তিনি নারীদের সম্মান প্রদানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন এবং জীবনধারণের সকল ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। স্বামীজি নারীর ক্ষমতায়নকে একটি জাতির সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন।
তৎকালীন সমাজে প্রচলিত নারী-পুরুষের বৈষম্য বিবেকানন্দকে ব্যথিত করে তুলেছিল। নারীকে যেভাবে পায়ে বেড়ি পরিয়ে নানান সংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ রাখা হয়েছিল, তিনি তার তীব্র বিরোধিতা করেন। বিবেকানন্দের দৃঢ় ধারণা ছিল স্ত্রীজাতিকে অবজ্ঞা অবহেলা করলে যে-কোনো জাতিই অনগ্রসরতার কড়াল গ্রাসের সম্মুখীন হবে। তিনি নারী জাতিকে পবিত্র মাতৃমূর্তির মর্যাদায় ভূষিত করতে চেয়েছিলেন। নারী জাতিকে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মঠ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর মতে, নারীরা প্রয়োজনে যাতে আত্মরক্ষা করতে পারে সেই সংক্রান্ত শিক্ষাও নারীদের দেওয়া উচিত।
স্বামী বিবেকানন্দ নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারীদের জীবিকা অর্জনের সুযোগ দেওয়া উচিৎ। নারীদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার জন্য তিনি তাদের কারিগরি শিক্ষাদানের কথাও বলেছিলেন। কোনো জাতির প্রগতির মাপকাঠি নির্ধারিত হয় নারী জাতির প্রতি তাদের মনোভাবের উপর ভিত্তি করে। নারীমুক্তির ধারণা বস্তুত সনাতন হিন্দু ধর্মের মধ্যেই অন্তর্নিহিত ছিল। তিনি মনে করতেন, বৈদিক যুগে স্ত্রী-পুরুষ বৈষম্য ছিল না। ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা কালক্রমে নিজেদের স্বার্থে নারীদের অধিকার, শিক্ষা, মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেছেন।
তাঁর মতে ভারতবর্ষের দুই মহাপাপের একটি হল ‘মেয়েদের পায়ে দলানো’। অর্থাৎ মেয়েদের পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখা। তিনি বলতেন, যেখানে স্ত্রীলোকের আদর নেই, নারী নিরানন্দে অবস্থান করে, সে সংসার তথা দেশের কখনো উন্নতির আশা নেই। সমাজে নারীদের এরূপ অবস্থান প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ বলেন, “আমরা পাপীষ্ঠ। আমাদের অধঃপতনের কারণ হল আমরা নারী জাতিকে ‘ঘৃণ্য কীট’, ‘নরকের দ্বার’ বলে অমর্যাদা করি।” এজন্য তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়েদের আগে তুলতে হবে, Mass-কে জাগাতে হবে, তবে তো দেশের কল্যাণ, ভারতের কল্যাণ।’ স্বামীজি এও বলতেন যে, মেয়েরা প্রত্যেকে এমন কিছু শিখুক যাতে প্রয়োজন হলে তাদের জীবিকা তারা নিজেরাই অর্জন করতে পারে। বিবাহের ক্ষেত্রেও নারীদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকারকেও বিবেকানন্দ সমর্থন করতেন। তিনি নারীদের বেশি বয়সে বিবাহ সম্পন্ন করার পক্ষে সমর্থন জানান।
স্বামীজি সতীদাহ প্রথা, পণ প্রথার মতো বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, এইসব প্রথাগুলি নারীদের মর্যাদাহানি ঘটায়। তাই তিনি এই প্রথাগুলি বাতিলের আহবান জানিয়েছিলেন। তবে নারীর অধিকার প্রসঙ্গে তাঁর যুক্তিসমূহে কিছু স্ববিরোধ লক্ষ করা যায়। যেমন- বিবেকানন্দ বিধবা বিবাহকে সমর্থন করেননি, নারীদের গৃহকর্মে আবদ্ধ থাকা শ্রেয় বলে মনে করতেন এবং বালিকা বিদ্যালয়ে পুরুষের অবস্থানকেও স্বীকার করতে চাননি।
(4) সামাজিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা
ভারতীয় সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথার পর্যালোচনা করে দেখতে গিয়ে স্বামীজি উপলব্ধি করেছিলেন, বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা গুণগত না হয়ে বংশগত হওয়াতেই উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে সমাজব্যবস্থাকে করায়ত্ত করে রেখেছে। স্বামী বিবেকানন্দ বেদান্তের প্রবক্তা ছিলেন। বেদান্ত বলতে বোঝায়, প্রতিটি ব্যক্তির আত্মা, পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্ন। সাম্যের এই বিশ্বাসই সামাজিক সাম্যের পক্ষে তাঁর ভিত্তি প্রস্তুত করেছিল। জাতিভেদের বন্ধনে মানুষকে সারাজীবন আবদ্ধ রাখার বিরোধী ছিলেন তিনি। সনাতনী ঐতিহ্যকে সমর্থন জানালেও তিনি জাতপাতের রক্ষণশীলতাকে অস্বীকার করেছেন। ভারতীয় গোঁড়া ব্রাহ্মণদের আধিপত্যবাদের শাসনকে তিনি মেনে নিতে পারেননি।
সমাজের বর্ণব্যবস্থায় সর্বনিম্নে অবস্থিত ‘শূদ্র’-দের শাস্ত্রপাঠ ও পরমজ্ঞান লাভ করা থেকে ব্রাহ্মণরা বঞ্চিত করে রেখেছে। অথচ পরমজ্ঞান অর্জনের অধিকার সকলেরই থাকা কাম্য। তাই তিনি আধ্যাত্মিক দিক থেকে সাম্য, সমতা প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তবে একথা সত্য যে, তিনি বর্ণাশ্রম প্রথাকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু জাতিভেদকে তিনি সমাজ থেকে সমূলে উৎপাটিত করতে চেয়েছিলেন। স্বামীজি সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের ধারণার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁর মতে, সমস্ত মানুষ একটি বৈশ্বিক পরিবারের অংশ। এই নীতিটি প্রচারের মাধ্যমে তিনি সামাজিক বৈষম্যকে ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যরা যেমন শাসন করছে স্বামীজির আশা ছিল একদিন শূদ্ররাও শাসন করবে। সমাজের নিম্নস্তরে অবস্থিত শূদ্রদের শাসনকে স্বাগত জানিয়ে স্বামীজি বলেছেন, ‘শূদ্রযুগ আসবেই আসবে, কেউ তার প্রতিরোধ করতে পারবে না।’
স্বামীজি তৎকালীন ভারতীয় সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন গুণের ভিত্তিতে বর্ণাশ্রম প্রথার সংস্কার করতে। আসলে বর্ণাশ্রম প্রথার দোহাই দিয়ে ব্রাহ্মণদের বংশ কৌলিন্যের কর্তৃত্বকে স্বামীজি মানতে চাননি। মাদ্রাজের ব্রাহ্মণরা অব্রাহ্মণ মানতে চাননি। মাদ্রাজের ব্রাহ্মণরা অ-ব্রাহ্মণ বিবেকানন্দের সন্ন্যাসীর বেশভুষা, গেরুয়া বসন দেখে যখন নিন্দায় সোচ্চার হন স্বামীজি তখন মাদ্রাজী ব্রাহ্মণদের চণ্ডালের অধম বলে আখ্যা দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন জাতিভেদের মধ্যে সামাজিক অন্যায় নিহিত। আর জাতপাতের সংঘর্ষ বা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। নিম্ন জাতিকে উপরে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজস্থ সকল ব্যক্তিবর্গের সামাজিক অবস্থান তথা বর্ণ নির্বিশেষে স্বামীজি প্রতিটি ব্যক্তির অন্তর্নিহিত দেবত্বে বিশ্বাস করতেন।
তিনি ভারতবর্ষের জনসাধারণ অর্থাৎ শ্রমজীবী জনসাধারণকে হিন্দু বর্ণব্যবস্থার নিম্নবর্ণ ‘শূদ্র’ বলে বর্ণনা করেছেন। শূদ্রদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুঃখ -দুর্দশাকে তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর মতে, এর জন্য একমাত্র দায়ী বিশেষ সুবিধাভোগী ধনিক-বণিক শ্রেণী এবং ইংরেজ শাসক। সামাজিক যে প্রথাগুলির মাধ্যমে সমাজব্যবস্থায় অকাম্য বৈষম্যের সৃষ্টি হয়, তার অবসানের জন্য স্বামীজি জনসাধারণের কাছে আহবান জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ক্রমশ আমার মনে এই প্রত্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে যে, জাতি ব্যবস্থার ধারণাই হল সর্বাধিক বিভেদমূলক উপাদান এবং মায়ার মূল। জন্মগত বা গুণগত সকল জাতিই হল বন্ধনস্বরূপ।’
বিবেকানন্দ নিম্নশ্রেণির মানুষের অবস্থার জন্য তাদেরকেই স্বয়ং দায়ী করেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, আধ্যাত্মিক জ্ঞানলাভের মধ্যে দিয়ে যে-কোনো বর্ণের মানুষই আধ্যাত্মিকতা লাভ করতে বা ব্রাহ্মণত্ব লাভ করতে সক্ষম। কিন্তু নিম্নবর্ণের মানুষ এ প্রসঙ্গে উদাসীন। বর্ণভেদ ও জাতিভেদ ব্যবস্থার ভিত্তিতে সমাজজীবনে যে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ ও সামাজিক ব্যাধির সৃষ্টি হয়েছে স্বামীজি তার স্পষ্টতই বিরোধিতা করেছিলেন।
(5) অস্পৃশ্যতার বিরোধী
স্বামীজি তৎকালীন হিন্দু সমাজের অস্পৃশ্যতার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি একে নির্বোধের আচরণ আখ্যা দিয়েছেন। সমাজের তথাকথিত নিচু জাতিতে জন্ম নিয়েছে বলে তাদের অচ্ছুৎ করে রেখে দেওয়া হবে-এই অন্যায় ও অমানবিক রীতিনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন স্বামীজি। এজন্য শূদ্রের গলায় ব্রাহ্মণের পৈতা ঝুলিয়ে, মেথরের হাতে অন্নগ্রহণ করে স্বামীজি সমগ্র দেশবাসীর সামনে অস্পৃশ্যতা ও জাতপাতবিরোধী এক বর্ণহীন সাম্যবাদী আদর্শের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। অস্পৃশ্যতার আচরণ তার কাছে ঘৃণ্য বলেই বিবেচিত হত। বিবেকানন্দ তাঁর বিভিন্ন লেখায় অস্পৃশ্যতার তীব্র নিন্দা করেছেন।
ভারতে এবং ভারতের বাইরে তিনি জাতিভেদ প্রথার অযৌক্তিকতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি ভারতবাসীকে জাতিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার জন্য আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি ধর্মকে কখনোই স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের মাঝে স্থান দিতে চাননি। হাঁড়ি-হেঁশেল বা রান্নাঘরের ছোঁয়াছুয়ি তথা গোঁড়ামির বিষয়ে তিনি ধর্মকে পরিণত করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। জন্মের ভিত্তিতে মানুষকে তিনি অচ্ছুৎ করে রাখার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। অস্পৃশ্যতার উদ্ভবের জন্য তিনি বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথাকেই দায়ী করেছেন। তবে তিনি এই সমস্যার সমাধান হিসেবে জাতিভেদ প্রথার বিলুপ্তির পরিবর্তে এই ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
(6) সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ
সমাজে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছিলেন এবং অযৌক্তিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আপামর জনসমাজকে সচেতন করারও চেষ্টা করেছিলেন। এই সামাজিক ব্যাধিগুলি সমাজের প্রগতিকে তরান্বিত হতে দেয় না। তিনি যুক্তির আলোকে সব কিছু বিশ্বাস করতে মানুষকে উৎসাহিত করেন এবং বৈজ্ঞানিক ভাবধারার বিকাশে অনুপ্ররণা জোগান। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষাই হল সমাজের কুসংস্কার দূরীকরণের মূল চাবিকাঠি। এজন্য তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, আধ্যাত্মিক অধ্যয়ন প্রভৃতি বিষয় জ্ঞান অর্জনের কথা বলেন। পৌত্তলিকতা, বাল্যবিবাহ, বিধবাবিবাহ বর্জন, জাতপাতের সমালোচনা করেছিলেন স্বামীজি। বিবেকানন্দ সামাজিক হিন্দু কুপ্রথাগুলির জন্য হিন্দুধর্ম বা তার অনুশাসনকে দায়ী করেননি। তাঁর মতে, পুরুষ ও ব্রাহ্মণের প্রাধান্যকে বজায় রাখার জন্যই এই কুপ্রথা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের আবিষ্কার।
(7) আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ
স্বামী বিবেকানন্দ শিব জ্ঞানে জীব সেবা-র আদর্শ প্রচার করেন। যার অর্থ হল মানবতার সেবা ধর্মের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সেবা। তিনি নিঃস্বার্থ সেবার আদর্শে বিশ্বাস করতেন। তিনি তার শিষ্যদের অন্যের সেবায় কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর সমাজ সংস্কারের অন্যতম দিক ছিল এই মানবতাবাদ। মানুষের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখার বাণী প্রচার করেন স্বামীজি। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে তিনি কাজ করার জন্য তাঁর অনুগামীদের আহবান জানান। তাঁর কাছে মানুষ একটি পবিত্র সত্তা। সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণ আদর্শে একে কলঙ্কিত করা উচিৎ নয়।
মানুষের ক্ষমতার উপর তাঁর যে বিশ্বাস ছিল, তা থেকেই জন্ম নিয়েছিল তাঁর মানবতাবাদী দর্শন। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, ভয়মুক্ত সমাজগঠন, আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধন ইত্যাদির জন্য বিবেকানন্দ তাঁর মানবতাবাদকে ধর্মের ভিত্তিতে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর আদর্শ বিশ্বমানবতাবাদী আদর্শে পরিণত হয়েছিল। তিনি ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সকল ধর্মের ঐক্যের ধারণা প্রচার করেছিলেন। তিনি একথা বিশ্বাস করতেন যে, সকল ধর্মই চূড়ান্ত সত্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
(8) সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন
বিবেকানন্দ ভারতের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের গর্ববোধকে জাগ্রত করেছিলেন। তিনি ভারতীয় শিল্প ও সাহিত্যের সংরক্ষণের কথা প্রচার করেছিলেন। তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভারতের পরিচয় ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করতেন। তিনি একাধারে পাশ্চাত্যের যা কিছু ভালো তা গ্রহণ করতে এবং অন্যদিকে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় দ্বারা প্রভাবিত হতে ভারতীয়দের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি ভারতকে একটি সর্বোৎকৃষ্ট সাংস্কৃতিক দেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তাছাড়াও বিবেকানন্দ তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে বেদান্ত দর্শনকে জনপ্রিয় করেছিলেন, যা ভারতবর্ষের অস্তিত্বগত ঐক্য, আত্মার পবিত্রতা, মানবতাবাদের একত্বের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করে। তাঁর এই দর্শন সামাজিক সংস্কারের জন্য একটি শক্তিশালী নৈতিক ও ন্যায়-নীতিপরায়ণতার ভিত্তির উপর প্রাধান্য দান করে।
(9) গ্রামোন্নয়ন
বিবেকানন্দ উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষই গ্রামে বসবাস করেন। তাই তিনি গ্রামীণ উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন যে, গ্রামের রূপান্তরের জন্য শিক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। গ্রামবাসীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উন্নত করার লক্ষ্যে তিনি ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন, যেখানে শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া ব্যবহারিক দক্ষতাও অর্জন করতে পারবে। স্বামীজি গ্রামের স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিচ্ছন্নতার কথাও ভেবেছিলেন। গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধির উন্নতির কথাও তিনি বলেন। তিনি মনে করতেন, ব্যক্তিরা সুস্থ থাকলে তাদের সম্প্রদায়ের উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারবে।
বস্তুগত উন্নতির পাশাপাশি আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতির কথাও তিনি ভেবেছিলেন। গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন জীবনে নৈতিক মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলার জন্য তিনি উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। বিবেকানন্দ বর্ণ এবং ধর্মের বাধা অতিক্রম করে গ্রামবাসীদের মধ্যে ঐক্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এইভাবে তিনি গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য পরিসেবার উন্নয়ন এবং প্রতিটি ভারতবাসীর স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে সুনিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দের মানোন্নয়ন ঘটানোর পক্ষে জোড়াল সমর্থন জানান।
(10) অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি
স্বামীজির সামাজিক সংস্কারের অন্যতম একটি দিক ছিল ভারতবাসীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারকরণ। তিনি দেশীয় শিল্পের অগ্রগতিকে এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাকে তরান্বিত করার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার। এই উদ্দেশ্যে তিনি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প এবং কারুশিল্পকে গ্রামীণ অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার একটি মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেন।
বিবেকানন্দ কৃষি চর্চা এবং উৎপাদন পদ্ধতিকে উন্নত করার কথা বলেন। তিনি কৃষকদের জীবিকা বৃদ্ধির সহায়ক আধুনিক কৌশল ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। এ ছাড়াও সম্পদের উন্নত ব্যবস্থাপনার পক্ষে যুক্তি অবতারণা করেন। তিনি ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কাজের ক্ষেত্রে নৈতিকতার গুরুত্বের উপর জোর দেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্যতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার নীতি দ্বারা পরিচালিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে তিনি আধ্যাত্মিক ভিত্তির কথাও বলেন। তিনি মনে করতেন সত্যিকারের অর্থনৈতিক অগ্রগতি কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করেই অর্জিত হতে পারে। এই ধারণাটির মধ্য দিয়ে তিনি প্রচার করেন যে, সামাজিক সম্পদকে সমাজের উন্নতির জন্য ব্যবহার করা উচিত।
অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধিতে স্বামীজির একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হল রামকৃয় মিশন প্রতিষ্ঠা। এর মধ্য দিয়ে তিনি বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন, যার মাধ্যমে বিনামূল্যে দরিদ্রের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করার ফলে তাদের আর্থিক উন্নতি সাধিত হয়। স্বামীজির অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতবাসীর উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে, তাদের আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি ও উন্নতিতে সহায়তা করেছে।
মূল্যায়ন
স্বামী বিবেকানন্দের সামাজিক সংস্কার মূলত শিক্ষার অগ্রগতি, সামাজিক অন্যায়ের ধ্বংসসাধন, প্রচলিত কুসংস্কার ও কুপ্রথার অবসান, বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ স্থাপন ইত্যাদি বিষয়গুলির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। তাছাড়াও তিনি ব্যক্তির চরিত্র গঠন, আত্মনির্ভরশীলতা এবং আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশে যথেষ্ট জোর দিয়েছিলেন। তিনি আজীবন সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের ক্ষমতায়ন, নারীর সামাজিক মানোন্নয়ন এবং জাতপাতহীন সমাজগঠনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তিনি তাঁর আদর্শের মাধ্যমে এমন এক ভারতবর্ষ গঠনের চেষ্টা করেছিলেন যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি অজ্ঞতা, কুসংস্কার, বৈষম্যবাদ ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে এবং সকলেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে সামাজিক ঐক্যকে বজায় রাখবে। সর্বোপরি তাঁর দর্শন বিশ্বজুড়ে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শ প্রচার করেছিল।
আরও পড়ুন – গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দাও