রেনেসাঁ যুগে নারী

রেনেসাঁ যুগে নারী

রেনেসাঁ যুগে নারী
রেনেসাঁ যুগে নারী

ইউরোপে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ যুগে মানুষের মর্যাদা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জয়গান গাওয়া হয়েছিল। অথচ এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও নাগরিক অধিকারের বার্তায় নারীসমাজের প্রতি নিস্পৃহতা সত্যই বিস্ময়কর। মানবতাবাদে মানুষের জয়গান গীত হয়েছে বটে, কিন্তু এই মানুষ কেবল পুরুষ, মহিলা নয়। মানবতাবাদের আলোকিত চক্রে মানবীদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। তবে এই বেড়াজাল সত্ত্বেও নবজাগরণ পর্বে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিল নারীশক্তির বিচ্ছুরণ। ধর্মীয় ও সামাজিক বাধার ঊর্ধ্বে উঠে সেই সময় কয়েকজন নারী শিল্প, সাহিত্য ও রাজনীতিতে নিজস্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।

বঞ্চনার বারমাস্যা

ফরাসি লেখিকা এবং দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ার (Simone de Beauvoir) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Second Sex-এ উল্লেখ করেছেন যে, “One is not born, but rather becomes, woman.”F (নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, তাদের নারী বানানো হয়।)। মধ্যযুগের ইউরোপীয় নারীসমাজের ক্ষেত্রে এই উক্তিটি যেন অকপট সত্য। সেসময় ইউরোপে নারীকে নৈতিকভাবে দুর্বলরূপে দেখা হত। একমাত্র মাতা মেরি ছিলেন এর ব্যতিক্রম। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে ইউরোপের তথাকথিত মধ্যযুগের এই অন্ধকার থেকে নারীদের নবজাগরণের আলোর রাজ্যে উত্তরণের কোনও প্রয়াস মানবতাবাদী কবি-সাহিত্যিক, সংস্কারকদের কাজে প্রতিফলিত হয়নি। এই যুগে-

  1. নারীর উচ্চশিক্ষা লাভের অধিকার ছিল না।
  2. নারীকে এই কালপর্বে কল্পনা করা হয়েছে সাধ্বী স্ত্রী ও সুমাতা হিসেবে।
  3. বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যাপণ বা যৌতুক (Dowries) দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। সেই যৌতুকের অর্থে ছিল স্বামীর একচ্ছত্র অধিকার।
  4. বাবা-মা যৌতুকের অর্থ জোগাড় করতে ব্যর্থ হলে কুমারী কন্যার ভবিতব্য ছিল চার্চে সন্ন্যাসিনীর জীবন।
  5. গৃহকোণের বাইরে সমাজ বা রাজনীতির বৃহত্তর অঙ্গনে নারীর প্রবেশ ছিল সীমাবদ্ধ। ষোড়শ শতকে ইউরোপের নারীরা তাঁত বোনা বা পুরুষদের সাথে চাষবাসের কাজের চেয়ে ঘরের কাজেই বেশি সময় ব্যয় করতেন।
  6. গৃহকর্তার দাপট এত প্রবল ছিল যে, স্ত্রী নিগ্রহের ঘটনা মাত্রাছাড়া হয়েছিল।
  7. কারিগরি কাজে দক্ষতা থাকলেও নারীদের কারিগরি গিল্ডে (Guild) সদস্য হওয়ার অনুমতি দেওয়া হত না। এ ছাড়া
  8. যাজকত্বেও নারীদের স্থান ছিল গৌণ। সন্ন্যাস জীবন গ্রহণে আগ্রহী ‘নান’-দেরও পুরুষ যাজকের কাছ থেকে ধর্মীয় পবিত্রতার শপথ (Sacrament) নিতে হত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যায় মঠেও নারীর প্রবেশ অবাধ ছিল না। এমনকি লুথারপন্থী, ক্যালভিনপন্থী ও অ্যাংলিকানগণও ধর্ম আন্দোলনে নারীদের ভূমিকাকে বেশ সংশয়ের দৃষ্টিতেই দেখতেন। এঁরা মনে করতেন, প্রধানত একজন কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রী এবং মাতা হিসেবে প্রোটেস্ট্যান্ট নারীর দায়িত্ব সীমাবদ্ধ থাকবে। চার্চে তাদের নীরবতা পালনই শ্রেয়। বরং সেই তুলনায় ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীরা অধিক দায়িত্ব পালন করতেন।

বিশিষ্ট চিন্তাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি

বিশিষ্ট লেখক ও কূটনীতিবিদ বালদাসার কাস্টিগলিওনে (Baldassare Castiglione) তাঁর The Book of the Courtier গ্রন্থে (১৫২৮ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন- ‘আমি মনে করি, একজন নারী তার জীবনযাপন পদ্ধতি, ভাবভঙ্গি, আচার-আচরণের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই একজন পুরুষের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। পুরুষের আচরণে দৃঢ়তা, রূঢ়তা, অনমনীয় পৌরুষ যেমন স্বাভাবিক, তেমনই নারীর ক্ষেত্রে কাম্য নম্র, ভদ্র এবং একান্ত নারীসুলভ মাধুর্যের প্রকাশ।’ প্রখ্যাত ফরাসি চিন্তাবিদ বোদাও পুরুষের সামাজিক আধিপত্যকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি নারীদের উপর কোনোরকম শারীরিক নিপীড়নকে সমর্থন না করলেও এটা বলেছিলেন যে, দরকার পড়লে পুরুষ নারীকে তার ভুলের জন্য তিরস্কার করতে পারে। পাশাপাশি নারী এবং পুত্র-কন্যার উপর পুরুষের কর্তৃত্বকে বোদাঁ সোচ্চার কণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন।

এইভাবে পুরুষশাসিত সমাজে অসংখ্য বিধিনিষেধ ও সংস্কারের অধীন নারীজীবন নবজাগরণের যুগেও ছিল গতিহীন, বন্ধ, একঘেয়ে। ধ্রুপদি সংস্কৃতি পুনর্জাগরণের প্রাণকেন্দ্র ফ্লোরেন্স, ভেনিস, জেনোয়া কোথাও নবসংস্কৃতির চর্চায় নারীদের সামিল করার আন্তরিক প্রয়াস দেখা যায়নি।

নারীদের ব্যতিক্রমী ভূমিকা

তবে উপরোক্ত পরিস্থিতি সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও দেখা গিয়েছে। যেমন ব্যবসায়ী ও বণিক পরিবারে নারীদের অবস্থা কিছুটা আলাদা ছিল। এক্ষেত্রে বাড়ির মহিলারা পুরুষদের সাথে ব্যবসায় সাহায্য করতে পারতেন। বণিক ও ব্যাংকারদের ঘরের বাইরে দূরদেশে কর্মোপলক্ষে থাকার সময় মহিলারা তাদের কাজকর্ম দেখতে পারতেন। বণিক গৃহকর্তার অকালমৃত্যু ঘটলে মহিলারাই সেই কাজ চালাতে বাধ্য হতেন। যদিও অভিজাত পরিবারের ক্ষেত্রে এই সুযোগ ছিল না। আবার নিম্নবর্গের মহিলারা অভিজাত মহিলাদের তুলনায় অধিক স্বাধীনতা ভোগ করতেন। সেযুগে বস্ত্র বা উলের দ্রব্যাদি বুননের ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী।

নারীদের প্রতিবাদী কণ্ঠ

নবজাগরণের আশীর্বাদপুষ্ট পুরুষশাসিত সমাজ নারীস্বাধীনতার প্রশ্নে উদাসীন ও বিরোধী থাকা সত্ত্বেও অদম্য মানসিকতার কিছু নারী মানবতাবাদী আন্দোলনে তাঁদের অবদান রেখে যান।

(1) ইসোত্তা নোগারোলা 

রেনেসাঁ যুগের প্রথমদিককার মহিলা মানবতাবাদীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভেরোনার ইসোত্তা নোগারোলা (Isotta Nogarola, ১৪১৮-১৪৬৬ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি পুরুষশাসিত সমাজের ভ্রুকুটি ও বিদ্রুপ অগ্রাহ্য করে উচ্চশিক্ষা নিয়েছিলেন। কিন্তু মানবতাবাদী পুরুষেরা তা পছন্দ করেননি। তাই নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, এমনকি তাঁর চরিত্র হননেরও চেষ্টা চালানো হয়। এই সময় ইসোত্তা ভেনিসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তাঁর বোন জিনেভ্রারও (Ginevra) একই পরিণতি হয়। শেষপর্যন্ত ভেনিসের গভর্নরের সহায়তায় ইসোত্তা কর্তৃক তাঁর বোনকে লেখা পত্রাবলি সংকলিত করে Dialogue on the Equal Or Unequal Sin of Adam and Eve এবং And Oration on the Life of St. Jerome নামে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলির ছত্রে ছত্রে পুরুষশাসিত সমাজের অসহনশীলতা, নারীবিদ্বেষ এবং নানা ধর্মীয় বিধানের অযৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে।

(2) কাসান্দ্রা ফেডেল

ভেনেসীয় রমণী কাসান্দ্রা ফেডেল (Cassandra Fedele, ১৪৬৫-১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দ) গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে বিতর্কে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কাসান্দ্রা লিখেছিলেন যে, ‘শিক্ষিত নারীর জন্য সমাজে কোনও পুরস্কার বা সম্মানের সুযোগ নেই। তবুও সকল নারীর শিক্ষাগ্রহণে উদ্যোগী হওয়া উচিত।’ স্পেন এবং ইটালির বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত অভিজাত ও মানবতাবাদীদের সঙ্গে তাঁর পত্রবিনিময় হয়েছিল। কাসান্দ্রা স্পষ্ট ভাষায় নারীর ইচ্ছার উপর পুরুষের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়ার মতো সংকীর্ণ স্বাধীনতার আদর্শবাদ প্রচারের জন্য প্রজাতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।

(3) লরা সিরেতা

লরা সিরেতা (Laura Cereta, ১৪৬৯-১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন পঞ্চদশ শতকে ইটালির সর্বাধিক খ্যাতনামা মানবতাবাদী ও নারীবাদী লেখিকা। তিনি নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল নৈতিক দর্শন। পাশাপাশি গণিতশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র এবং কৃষিবিদ্যাতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। অল্প বয়সে বৈধব্যযন্ত্রণা সহ্য করেও তিনি ভাষাচর্চা এবং লেখালেখির কাজ চালিয়ে যান। এর জন্য নানাভাবে তাঁকে ব্যঙ্গ- বিদ্রুপও করা হয়। ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে সিরেতা তাঁর লেখা ৮২টি চিঠিপত্রের সংকলন প্রকাশিত করেন। তাঁর রচনাগুলি প্রাক্-আধুনিক কালে ইটালির বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায় এবং সমাদৃত হয়। মাত্র তিরিশ বছর বয়সে এই প্রতিবাদী নারী পরলোকগমন করেন।

(4) ইসাবেলা দ্য এস্তে

ইটালির ক্ষুদ্র রাজ্য মান্ডুয়া (Mantua) ছিল শিক্ষাচর্চার গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র। মান্তুয়ার শাসকের পত্নী ইসাবেলা দ্য এস্তে (Isabella d’ Este, ১৪৭৪-১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন রেনেসাঁ যুগের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক জগতের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। ধ্রুপদি শিক্ষায় শিক্ষিত এই মহীয়সী নারী শিল্পকলা, নৃত্য ও সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। পাশাপাশি নারীর অধিকার ও মর্যাদা বৃদ্ধির পক্ষেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। ইসাবেলা বলেন যে, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা, সম্পত্তি ও শিক্ষা থাকা জরুরি, যা পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে পরিচিতি দিতে পারবে। ইসাবেলার গুণাবলি ও অবদানকে প্রশংসা করে বিশিষ্ট ইতালীয়  লেখক এবং ধর্মব্যক্তিত্ব মাতেও বান্দেলো (Matteo Bandello) তাঁকে ‘Supreme among Women’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। 

(5) রেনেসাঁ যুগের অন্যান্য বরণীয়ারা

এই নারীগণ ছাড়াও নবজাগরণ পর্বের অন্যান্য বরণীয়াদের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন সিস্টার প্লাতিল্লা নেল্লি (Sister Plautilla Nelli, ১৫২৪-১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দ)। ষোড়শ শতকের ফ্লোরেন্সের এই মহিলা চিত্রশিল্পীকে রেনেসাঁ যুগের প্রথম মহিলা চিত্রশিল্পী বলা হয়ে থাকে। এ ছাড়া প্রখ্যাত চিত্রকর আর্টিমিসিয়া জেন্টিলেসি (Artemisia Gentileschi, ১৫৯৩-১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দ) পুরাণ-বাইবেল ও রূপকথাকে ভিত্তি করে বহু চিত্র অঙ্কন করেন। আবার গ্যাসপারা স্টাম্পা (Gaspara Stampa, ১৫২৩-১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দ), ভেরোনিকা ফ্রাঙ্কো (Veronica Franco, ১৫৪৬-১৫৯১ খ্রিস্টাব্দ) গীতিকবিতা রচনায় পারদর্শিতা দেখান। অবশ্য শুধু শিল্পকলাতেই নয়, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চেও নারীরা তাঁদের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ষোড়শ শতকের শেষের দিকে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের রাষ্ট্রপ্রধান এবং শাসিকা প্রথম এলিজাবেথ এবং মেরি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের সমান্তরালে ফ্রান্সের রানি ক্যাথরিন দ্য মেডিচিও (Catherine de Medici, ১৫১৯-১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দ) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন।

(6) উপসংহার

পরিশেষে বলা যায় যে, পঞ্চদশ শতকের নবজাগরণ তথা মানবতাবাদ সংস্কারমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ এবং আলোকিত জীবনদর্শনের পথিকৃৎ হিসেবে বন্দিত হয়। কিন্তু নারীজাতির প্রতি তার উদাসীনতা তথা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশকে নবজীবনের আস্বাদন থেকে দূরে রাখা  নিঃসন্দেহে এই মহান আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment