চিত্রকলায় রেনেসাঁর প্রভাব

চিত্রকলায় রেনেসাঁর প্রভাব

চিত্রকলায় রেনেসাঁর প্রভাব
চিত্রকলায় রেনেসাঁর প্রভাব

ভাষা ও সাহিত্যের মতো নবজাগরণ-প্রসূত মানবতাবাদী চেতনা শিল্পকলার নানা ক্ষেত্র, যেমন- চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদিকে প্রভাবিত করেছিল। বুখার্ডের মতে, পঞ্চদশ শতকের শিল্পচর্চা ছিল মূলত অতীতের পুনরুজ্জীবন (Revival of Antiquity) এবং জগৎ আবিষ্কার (Discovery of the World)। তবে এই অভিমত সম্পর্কে কিছু সংশয় আছে। কারণ- সেই সময় গ্রিক ও রোমান শিল্পের অধিকাংশ নিদর্শন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ফলে রেনেসাঁ শিল্পীরা তাঁদের পূর্ববর্তী ধ্রুপদি শিল্প প্রত্যক্ষ করেননি। অবশ্য স্থানীয় শাসক, পোপ এবং অভিজাতদের কেউ কেউ ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে প্রয়াসী ছিলেন। সম্ভবত সেখান থেকেই মানবতাবাদী শিল্পীরা ঐতিহ্যের আভাস পেয়ে থাকতে পারেন।

বৈশিষ্ট্য

মধ্যযুগে শিল্পকলার গতি স্বচ্ছন্দ বা সাবলীল ছিল না। শিল্পের বিষয়বস্তু ছিল একান্তই ধর্মকেন্দ্রিক এবং শিল্পীর স্বাধীনতা ছিল নিয়ন্ত্রিত। ফলে গির্জা বা প্রাসাদ নির্মাণে কিংবা কোনও মূর্তি তৈরিতে অথবা চিত্রাঙ্কনে ফুটে উঠত গথিক শৈলী, নিষ্প্রাণ ও কৃশ কিছু সাধুসন্তের দেহ অথবা মেরি বা জিশুর বেদনাদীর্ণ প্রতিচ্ছবি। নবজাগরণ সেই গতানুগতিকতা ভেঙে দিয়ে নিয়ে আসে পরিবর্তনের ধারা। এই যুগের শিল্পচর্চায় ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের প্রবণতা যেমন ছিল, তেমনি আধুনিক শিল্পমনস্কতাও সমকালীন শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। নানা দিক থেকে নবজাগরণ যুগের শিল্পচর্চা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিল-

(1) মৌলিক সৃষ্টি 

ধ্রুপদি যুগের শিল্পশৈলীর ধারাবাহিকতা মধ্যযুগে স্তব্ধ হয়ে যায়। মানবতাবাদী শিল্পী-ভাস্কররা সেই ছেদের অবসান ঘটান এবং ধ্রুপদি ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করেন। একইসঙ্গে তাঁরা ধ্রুপদি ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁদের দক্ষতা ও কল্পনার সমন্বয় ঘটিয়ে আরও প্রাণবন্ত ও মৌলিক শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন। পুরোনো বিষয়বস্তুর সঙ্গে নবজাগরিত ভাবধারার এই সুস্থিত মিশ্রণকে জার্মান শিল্প ঐতিহাসিক এরউইন পনোফস্কি (Erwin Panofsky) বলেছেন Innovatory Synthesis.

(2) বহুমাত্রিক প্রকাশ 

মধ্যযুগের চিত্রকলা বা ভাস্কর্যে ধ্রুপদি যুগের শৈলী ও আঙ্গিক অবহেলিত ছিল। ছবিগুলি ছিল একমাত্রিক। কেবল সামনের দিকে মুখ করে থাকা নির্জীব চিত্র বা ভাস্কর্য। নবজাগরণ যুগের শিল্পীরা প্রেক্ষিত (Perspective)-এর ব্যবহার করে শিল্পকর্মকে বহুমাত্রিক রূপ দেন। এই শিল্পশৈলীতে পারিপার্শ্বিক, উঁচুনীচুর আভাস, পার্শ্বরেখা ইত্যাদি চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে ত্রিমাত্রিক প্রকাশ ঘটায়, যা তাঁদের সৃষ্টিকে জীবন্ত ও গতিশীল করে তোলে। দোনাতেল্লোর ব্রোঞ্জ মূর্তি ডেভিড (David) বহুমাত্রিকতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

(3) ধর্মীয় ও জীবনমুখী শৈলীর সহাবস্থান

নবজাগরণ পর্বে মানবতাবাদী শিল্পী ও শিল্পচর্চার পৃষ্ঠপোষক যেমন ছিলেন পোপ ও যাজকবৃন্দ, তেমনই ছিলেন নগর-বণিক শ্রেণি ও অভিজাতগণ। ফলে একালের শিল্পচর্চার বিষয়বস্তু হিসেবে ধর্মীয় ভাবনা অর্থাৎ ক্রুশবিদ্ধ জিশু, ম্যাডোনা, খ্রিস্টান সম্ভদের প্রতিকৃতি যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনই ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) বা জীবনমুখী ঘটনাবলি, যেমন- শোভাযাত্রা, হাটবাজার, নৈসর্গিক দৃশ্য ইত্যাদিও রূপায়িত হয়েছে।

(4) অন্তর্নিহিত ভাবের প্রকাশ

মধ্যযুগের চিত্র বা ভাস্কর্যগুলির উপস্থাপনা ছিল ভাবাবেগ বর্জিত। দেহগুলির সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত থাকত। তাই দেহসৌষ্ঠবের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য প্রকাশ পেত না। চিত্রকলায় চোখ-মুখ থাকত স্থির, ভাবহীন। নবজাগরণের শিল্পভাবনায় সেই ত্রুটি দূর করা হয়। পোশাকের অন্তরালে শরীরের পেশি ও ভঙ্গিমাগুলি দর্শকের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। আবার চিত্রকল্পে চোখ-মুখের অভিব্যক্তি ছবিগুলিকে জীবন্ত করে তোলে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘শেষ ভোজ’ (The Last Supper) ছবির চরিত্রগুলির চোখে-মুখে বিস্ময়, আনন্দ, প্রতিহিংসা, বেদনা ইত্যাদি নানা অভিব্যক্তির প্রকাশ সত্যই অভূতপূর্ব।

নবজাগরণ যুগের শিল্পীগণ

(1) জিওতো ডি বনডোনে (চিত্রশিল্পী এবং স্থপতি)

ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং স্থপতি ছিলেন জিওত্তো ডি বনডোনে (Giotto di Bondone, ১২৬৭ – ১৩৩৭ খ্রি.)। তিনি নবজাগরণের আদি রূপকার নামে পরিচিত। অনেকে আবার তাঁকে আধুনিক শিল্পরীতির অগ্রদূত এবং ম্যাসাচিও, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি প্রমুখের পূর্বসূরি বলেও অভিহিত করেন। প্রাক্-নবজাগরণ পর্বের এই শিল্পী তাঁর শিল্পে ধর্মের পরিবর্তে বাস্তব জীবনের ঘটনাবলিকে বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেন।

আধুনিক শিল্প-সমালোচকদের মতে, জিওত্তোর আঁকা চিত্রগুলি মধ্যযুগীয় গথিক শিল্পরীতি থেকে উন্নত, প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বল ছিল। কিন্তু তিনিও পারিপার্শ্বিক বা প্রেক্ষিতের ব্যবহার করেননি। তাই অনেকেই জিওত্তোকে ধ্রুপদি শিল্পচর্চার উদ্ভাবক বলতে রাজি নন। স্ক্রোভেগনি চ্যাপেল (Scrovegni Chapel) গির্জার দ্য লাস্ট জাজমেন্ট (The Last Judgement) ফ্রেসকো তাঁর অমর কীর্তি।

(2) ফিলিপ্পো ব্লুনেলেস্কি (স্থপতি)

অনেকে মনে করেন ফ্লোরেন্সের ফিলিপ্পো বুনেলেস্কি (Filippo Brunelleschi, ১৩৭৭ ১৪৪৬ খ্রি.)-ও অন্য শিল্পীদের মতোই রোমের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে ধ্রুপদি স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি এক নতুন স্থাপত্যরীতির জন্ম দেন। বুনেলেস্কির অবিস্মরণীয় কীর্তি হল সেন্ট মেরি ক্যাথিড্রালের (St. Mary’s Cathedral) ডোম। এ ছাড়া পঞ্চদশ শতকের ফ্লোরেন্সের বহু গির্জাই বুনেলেস্কির ধ্রুপদি স্থাপত্যরীতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। তিনি রেনেসাঁ স্থাপত্যের জনক নামেও অভিহিত হন।

(3) দোনাতেল্লো (ভাস্কর)

পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে ভাস্কর্য শিল্পে একটি বিখ্যাত নাম দোনাতেল্লো (Donatello, ১৩৮৬ ১৪৬৬ খ্রি.)। বিভিন্ন চার্চ ও প্রাসাদের বহির্ভাগের অলংকরণের জন্য তিনি যে পাথরের মূর্তিগুলি বাানিয়েছিলেন সেগুলিতে ধ্রুপদি শিল্পরীতির প্রভাব স্পষ্ট। তাঁর তৈরি সেন্ট জর্জ (St. George)-এর মূর্তি ছিল মানব শরীরের বাস্তবানুগ প্রতিকৃতি। দোনাতেল্লোর ব্রোঞ্জনির্মিত ডেভিড (David) মূর্তি অসাধারণ শিল্পকর্মের নিদর্শন।

(4) ফ্রা এঞ্জেলিকো (চিত্রশিল্পী) 

নবজাগরণকালে ইটালির অপর এক প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী ছিলেন ফ্রা এঞ্জেলিকো (Fra Angelico, ১৩৯৫ – ১৪৫৫ খ্রি.)। জর্জিয়ো ভাসারি (Giorgio Vasari) তাঁর লেখায় ফ্রা এঞ্জেলিকো-কে ‘…a rare and perfect talent’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ধর্মকে তাঁর শিল্পের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ফ্লোরেন্সের সান মারকো (San Marco) চার্চে এঞ্জেলিকো সৃষ্ট একাধিক ফ্রেসকো (Fresco) শিল্পপ্রেমীদের আজও আকর্ষণ করে।

(5) ম্যাসাচিও (চিত্রশিল্পী): ফ্লোরেন্সের অধিবাসী ম্যাসাচিও (Masaccio, ১৪০১-১৪২৮ খ্রি.) মানবতাবাদী চিত্রশিল্পীদের মধ্যে অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হন। ত্রিমাত্রিক (Three dimensional) চিত্রাঙ্কনে দৃঢ় প্রত্যয় তাঁকে নতুন চিত্রশৈলীর উদ্ভাবক-এর আখ্যা দিয়েছে। তিনি চিত্রে সর্বপ্রথম রৈখিক দৃষ্টিভঙ্গির (Linear Perspective) প্রয়োগ এবং ভ্যানিশিং পয়েন্ট (Vanishing Point)-এর কৌশল ব্যবহার করেন। ব্রাঙ্কাচ্চি চ্যাপেল (Brancacci Chapel)-এ তাঁর আঁকা সেন্ট পিটার (St. Peter)-এর ফ্রেসকো এই ধারার অঙ্কনশৈলীর শ্রেষ্ঠ নির্দশন। ম্যাসাচিওর মেরি (Mary) সিরিজের ছবিগুলিতে ফ্রেসকোর ব্যবহার এবং আলো-ছায়ার বৈপরীত্য ছিল খুবই নিপুণ।

(6) লিও বাতিস্তা আলবার্টি (লেখক, শিল্পী, স্থপতি) 

মানবতাবাদী শিল্পীদের মধ্যে লিও বাতিস্তা আলবার্টি (Leon Battista Alberti, ১৪০৪ ১৪৭২ খ্রি.)-র নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি ডেলা পিটুটুরা (Della Pittura) নামে ইতালীয় ভাষায় চিত্রকলা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। নতুন অঙ্কনশৈলীর প্রসারে বুনেলেস্কি-কে উৎসর্গ করা এই রচনার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। আলবার্টি নিজে একজন স্থাপত্যবিদ (Architect) ছিলেন। ফলে ভাস্কর্য ও স্থাপত্য বিষয়েও তিনি বেশকিছু বই লিখেছিলেন। শিল্পীর জগৎ এবং মানবতাবাদী বিদ্যাচর্চার মধ্যে সেতুবন্ধন করে শিল্পীর সামাজিক অবস্থানে রূপান্তর আনেন আলবার্টি।

পাঁদোনাতো ব্রামান্তে (স্থপতি, চিত্রশিল্পী): নবজাগরণ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থপতি ছিলেন দোনাতো ব্রামান্তে (Donato Bramante, ১৪৪৪ – ১৫১৪ খ্রি.)। তাঁর অন্যতম সেরা কীর্তি হল রোমে সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকা (St. Peter’s Basilica)-র পরিকল্পনা। তিনি রোমে High Renaissance বা পরিণত নবজাগরণ শিল্পরীতির প্রসার ঘটান। এ ছাড়াও বহু সুন্দর সুন্দর চার্চ ও প্রাসাদ নির্মাণ করেন তিনি।

(7) স্যান্ড্রো বত্তিসেল্লি (চিত্রশিল্পী)

ফ্লোরেন্সে নবজাগরণ যুগের প্রথমদিকের সুবিখ্যাত চিত্রকর ছিলেন স্যান্ড্রো বত্তিসেল্লি (Sandro Botticelli, ১৪৪৫ – ১৫১০ খ্রি.)। পৌরাণিক গল্পকথা ছাড়াও ধর্মীয় বিষয়ভিত্তিক বহু ছবি তিনি এঁকেছেন, এগুলির মধ্যে ম্যাডোনা (Madonna) বিখ্যাত। ফ্লোরেন্সের শাসক লরেঞ্জোর পৃষ্ঠপোষকতায় বত্তিসেল্লি বার্থ অফ ভেনাস (Birth of Venus) নামক জীবনমুখী চিত্র অঙ্কন করে চিত্রাঙ্কনের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করেন। ভেনাস ছিলেন সৌন্দর্যের দেবী।

এই চিত্রাঙ্কনে বিবস্ত্ররূপে কল্পিত নারীমূর্তি আদৌ কামোদ্দীপক নয়, বরং অনেক বেশি সরল, নিষ্পাপ এবং স্বর্গীয় সুষমামন্ডিত। নারীকে তিনি মানবী থেকে দেবী, দেবী থেকে প্রতীকে রূপান্তরিত করেছেন। প্রতিকৃতি অঙ্কনে তাঁর দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় প্রাইমাভেরা (Primavera) থেকে। এই চিত্রকল্পে নারীদেহের স্বচ্ছ পোশাকে রোম্যান্টিক সৌন্দর্য মূর্ত হয়ে উঠেছে। বত্তিসেল্লির অপর এক অমর সৃষ্টি ভেনাস অ্যান্ড মার্স (Venus and Mars)। তাঁর সকল ছবিতেই আলো-ছায়া ও রঙের সুষম প্রয়োগ দ্বারা স্বাভাবিকতার পাশাপাশি আত্মার সৌন্দর্যও প্রতিভাত হয়েছে।

(8) জিওর্জিওনি (চিত্রশিল্পী)

ভেনেসীয় চিত্রশিল্পী জিওর্জিওনি (Giorgione, ১৪৭৭ ১৫১০ খ্রি.)-র বিখ্যাত সৃষ্টি দ্য টেমপেস্ট (The Tempest)। এখানে তিনি আলো-ছায়ার খেলায় অপূর্ব দক্ষতা ও রঙের সুষম প্রয়োগ দ্বারা ছবিটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। তাঁর অন্যান্য কয়েকটি বিখ্যাত শিল্পকর্ম হল- স্লিপিং ভেনাস (Sleeping Venus), দ্য থ্রি ফিলোজফারস (The Three Philosophers) ইত্যাদি।

(9) টিসিয়ান (চিত্রশিল্পী)

জিওর্জিওনি-র সমসাময়িক ভেনেসীয় ঘরানার চিত্রশিল্পী টিসিয়ান (Titian, আনুমানিক ১৪৮৮ ১৫৭৬ খ্রি.) ফ্রেসকোর কাজে দক্ষ ছিলেন। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত চিত্র হল- আরবিনো-র নগ্নিকা (Venus of Urbino), সেন্ট মেরি ম্যাগদালেন (Penitent Magdalene), টারকুইন অ্যান্ড লুক্রেসিয়া (Tarquin and Lucretia) ইত্যাদি। উপরোক্ত মনীষীরা ছাড়াও নবজাগরণ যুগের আরও কয়েকজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ছিলেন- পিয়েরো দেল্লা ফ্রান্সেসকা (Piero della Francesca, আনুমানিক ১৪১৫ ১৪৯২ খ্রি.), বেনোজো গোজোলি (Benozzo Gozzoli, আনুমানিক ১৪২১ ১৪৯৭ খ্রি.), তিনতোরেত্তো (Tintoretto, ১৫১৮ – ১৫৯৪ খ্রি.) প্রমুখ।

দ্য গ্রেট খ্রি: লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো এবং সালজিও রাফায়েল

পঞ্চদশ শতকের শিল্প ও চিত্রকলা চর্চার ক্ষেত্রে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো এবং সানজিও রাফায়েল-এর নাম দ্য গ্রেট থ্রি (The Great Three) হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনজনই ছিলেন ফ্লোরেন্সের অধিবাসী।

(1) লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, স্থপতি, কবি, সংগীতজ্ঞ, বৈজ্ঞানিক, গণিতজ্ঞ, দার্শনিক) 

নবজাগরণ সংক্রান্ত আলোচনা যাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ, তিনি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (Leonardo da Vinci, ১৪৫২ ১৫১৯ খ্রি.)। লিওনার্দো ছিলেন বিচিত্রগামী প্রতিভার অধিকারী। চিত্রকলা, বিজ্ঞানচর্চা, ভাস্কর্য ইত্যাদি শিল্পকলার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তবে চিত্রকলাই ছিল তাঁর শিল্পসাধনার মুখ্য বিষয়। সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সময় তিনি সামরিক প্রযুক্তির জ্ঞান অর্জন করেন। এখান থেকেই শূন্যে উড়ে যাওয়ার বাসনা তাঁর মনে জাগে। আকাশে উড্ডীয়মান পাখির স্কেচগুলি (Sketch) থেকে তিনি আকাশে মানুষের ভেসে থাকার জন্য বায়ুযানের একটি স্কেচ এঁকেছিলেন। এ ছাড়া মানবশরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, বৃক্ষলতা, পশুপাখি, বৃষ্টির বেগ, ঝড়ের গতিময়তা ইত্যাদি সবকিছুই তিনি নিরীক্ষণ করে প্রায় অনুরূপ স্কেচ এঁকেছেন দুর্লভ দক্ষতার সঙ্গে। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্কেচগুলি দেখে অনেকে মনে করেন যে, সম্ভবত শবব্যবচ্ছেদের মাধ্যমেই মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়েছিল।

লিওনার্দো প্রথম জীবনে আন্দ্রে ভারিচ্চিও (Andrea del Verrocchio)-র চিত্রশালায় শিক্ষানবিশ ছিলেন। ভারিচ্চিও-র দ্য ব্যাপটিজম অফ ক্রাইস্ট (The Baptism of Christ) ছবিতে সহকারী হিসেবে তিনি প্রতিভার পরিচয় দেন। তিনি চ্যাপেল অফ সেন্ট বার্নার্ড (Chapel of St. Bernard), অ্যাডোরেশন অফ দ্য ম্যাগি (Adoration of the Magi) ইত্যাদি এঁকে দক্ষতা দেখান।

চিত্রশিল্পে লিওনার্দো যোগ করেছিলেন Aerial Perspective-এর ধারণা। এই ধারণার যথার্থ প্রতিফলন লক্ষ করা যায় তাঁর ভার্জিন অফ দ্য রকস (Virgin of the Rocks) চিত্রে। তাঁর ছবিতে Vanishing Point Perspective-এর ব্যবহার ছাড়াও শিল্পের মূল বিষয়বস্তু হল চরিত্রগুলির প্রতিকৃতি ও ব্যক্তিত্ব। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হল লেডি উইথ অ্যান এরমাইন (Lady with an Ermine) নামক চিত্রটি।

ষোড়শ শতকে লিওনার্দো আঁকেন তাঁর কালজয়ী মোনালিসা (Mona Lisa) ছবিটি। এখানে শিল্পী নির্মোহী মন থেকে একটি নারীর মুখ ফুটিয়ে তুলেছেন, যার ঠোঁট, বঙ্কিম কটাক্ষ এবং মৃদু হাসিতে গভীর কোনও চিন্তা, স্নিগ্ধ আবেশ, রহস্যময়তা দর্শকদের আজও বিস্ময়ে অভিভূত করে। এই চিত্রটি প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে (Louvre Musuem) সংরক্ষিত আছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অপর একটি বিস্ময়কর চিত্রকর্ম হল দ্য লাস্ট সাপার (The Last Supper) বা শেষ ভোজ। মিলানের গির্জার দেয়ালে অঙ্কিত এই ছবিতে জিশুখ্রিস্টকে শিষ্যদের মাঝে বসে নৈশভোজরত অবস্থায় দেখা যায়। এখানেই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এখানে উপস্থিত ১২ জন শিষ্যের মধ্যে একজন আগামীকালই তাঁর সঙ্গে প্রাণঘাতী বিশ্বাসঘাতকতা করবে। একথা শোনার পর তাঁর শিষ্যদের মুখ-চোখে সন্দেহ, ঘৃণা, ক্ষোভ, বেদনা, বিস্ময় ইত্যাদি পৃথক পৃথক অভিব্যক্তি যে দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা বিস্ময়কর।

সেযুগের মানুষ বিশ্বাস করতেন যে, লিওনার্দো কোনও সাধারণ মানুষ নন, ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য। তাঁর অসামান্য শিল্পকর্মের জন্য তিনি আজও পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা হিসেবে পরিচিত।

(2) মাইকেল এঞ্জেলো (ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, স্থপতি, কবি)

পরিণত নবজাগরণ শিল্প (High Renaissance Art)-এর দ্বিতীয় আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন মাইকেল এঞ্জেলো (Michelangelo, ১৪৭৫ ১৫৬৪ খ্রি.)। তিনি দীর্ঘ কর্মজীবনে ভাস্কর, চিত্রকর, প্রযুক্তিবিদ ও কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি ভাস্কর হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী ছিলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে মাইকেল এঞ্জেলো চিত্রশিল্পী এবং স্থপতি হিসেবেও প্রসিদ্ধি লাভ করেন। লরেঞ্জো দ্য মেডিচি এবং পোপের পৃষ্ঠপোষকতা তাঁর বহুমুখী প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়।

খ্রিস্টধর্মাশ্রিত আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে তিনি মানবতাবাদী বাস্তবতা, স্বাধীনতা ও বলিষ্ঠতার মিশ্রণ ঘটান। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি মার্বেল খোদাই করে ম্যাডোনা অফ দ্য স্টেয়ারস (Madonna of the Stairs) ভাস্কর্যটি তৈরি করেন। তাঁর অপর একটি কালজয়ী সৃষ্টি হল সেন্ট পিটারস গির্জায় রাখা পিয়েতা (Pieta) ভাস্কর্যটি। এখানে ক্রুশ থেকে নামানো জিশুর মৃতদেহ কোলে নিয়ে বসে আছেন শোকস্তব্ধ মা মেরি। বেলজিয়ামের বুজ (Bruges) শহরে রক্ষিত ম্যাডোনা ও শিশু জিশুর ভাস্কর্যটিও এঞ্জেলোর অনবদ্য সৃষ্টি। ১৫০১-১৫০৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি বাইবেল- বর্ণিত নায়ক ডেভিড (David)-এর প্রায় চৌদ্দ ফুট দীর্ঘ নগ্নমূর্তিটি তৈরি করেন। এখানে ডেভিড অসীম শক্তির অধিকারী এবং গ্রিক দেবতার প্রতিরূপ। তাঁর পেশিবহুল শরীর, কঠোর চাউনি এথেন্সের দেবতা অ্যাপোলোকে মনে করিয়ে দেয়।

চিত্রকর হিসেবে মাইকেল এঞ্জেলোর বহু স্মরণীয় সৃষ্টির অন্যতম হল দ্য ক্রিয়েশন অফ অ্যাডাম (The Creation of Adam), দ্য ডেলফিক সিবিল The Delphic Sibyl), দ্য লাস্ট জাজমেন্ট (The Last Judgement) প্রভৃতি। উঁচু মাচায় দাঁড়িয়ে সিস্টিন চ্যাপেল (Sistine Chapel)-এর দেয়ালে তিনি এই অনিন্দ্যসুন্দর ছবিগুলি অঙ্কন করেন। ক্রিয়েশন অফ অ্যাডাম ছবিতে তিনি জগতে আগত প্রথম মানবের নগ্ন প্রতিকৃতিতে তার দেহসৌষ্ঠব, প্রবল জীবনীশক্তি, অন্তরের আনন্দ- বেদনা-বিস্ময়কে নৈপুণ্যের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ঈশ্বরের রাজ্য থেকে বিচ্ছেদের বেদনা এবং ঈশ্বর প্রদত্ত দেহমন্দিরের সৌষ্ঠব ও শক্তির আনন্দ একই মাত্রায় প্রকাশিত হয়েছে।

দ্য লাস্ট জাজমেন্ট দেয়াল চিত্রে মানবতাবাদের সঙ্গে ধর্মভাবনার সংঘাত এবং ধর্মের পুনরুত্থানের কল্পনা গুরুত্ব পেয়েছে। জীবনের শেষদিকে তিনি সেন্ট পিটারস গির্জার প্রধান স্থপতি পদে মনোনীত হয়েছিলেন। এই সময়ে তিনি এই চার্চকে নতুন রূপে সুসজ্জিত করে তোলেন। চার্চের শীর্ষে নির্মিত বিশালাকার গম্বুজ মাইকেল এঞ্জেলোরই সৃষ্টি।

(3) সানজিও রাফায়েল (চিত্রশিল্পী, স্থপতি)

সানজিও রাফায়েল (Sanzio Raphael, ১৪৮৩ ১৫২০ খ্রি.) ছিলেন ইতালীয় চিত্রশিল্পী এবং স্থপতি। তাঁর সৃষ্টিগুলি গঠনের স্বচ্ছতা, রচনার স্বাচ্ছন্দ্য এবং মানুষের মহিমার নিওপ্লেটোনিক (Neoplatonic) আদর্শের দক্ষ প্রকাশ হিসেবে প্রশংসিত হয়। রাফায়েলের বাবা জিওভানি স্যান্টি (Giovanni Santi) ছিলেন সংস্কৃতিবান শহর উরবিনো (Urbino)-র শাসকের চিত্রশিল্পী। অল্প বয়সে পিতৃহারা রাফায়েল পিয়েত্রো পেরুজিনো (Pietro Perugino)-র কর্মশালায় প্রশিক্ষণ নেন। ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি পোপের আমন্ত্রণে রোমে আসেন। তাঁর অনেক কাজ ভ্যাটিকান প্রাসাদে (Vatican Palace) দেখতে পাওয়া যায়।

রাফায়েল ছিলেন মূলত চিত্রশিল্পী। উরবিনোতে জন্ম হলেও ফ্লোরেন্সের শিল্পীদের সান্নিধ্য তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছিল। ম্যাডোনার বহু ছবি তিনি এঁকেছেন। তাঁর অঙ্কনরীতি আপাতদৃষ্টিতে সহজ, সরল ও বোধগম্য। তবে এর মধ্যেই তিনি স্বর্গীয় অনুভূতি ও আধ্যাত্মিকতার গভীর ছাপ সংযোজন করেছেন। তাঁর ম্যাডোনা সিরিজের ছবিগুলি একইসঙ্গে সৌন্দর্যের প্রতীক এবং ঐশ্বরিক মহিমার আধ্যাত্মিক প্রকাশ। তাঁর বিখ্যাত চিত্র ম্যাডোনা অফ দ্য চেয়ার (Madonna of the Chair), যেখানে মাতৃস্নেহ এবং শিশুর চোখ-মুখে দেবরূপের অনবদ্য প্রকাশ ঘটেছে। পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস (Julius II)-এর আমন্ত্রণে তিনি মাইকেল এঞ্জেলোর সঙ্গে সিস্টিন চ্যাপেলে কয়েকটি ফ্রেসকো আঁকেন। এদের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি পায় দ্য স্কুল অফ এথেন্স (The School of Athens) শীর্ষক ফ্রেসকোটি।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment