সমাজজীবনে মেলার প্রয়োজনীয়তা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

সমাজজীবনে মেলার প্রয়োজনীয়তা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

সমাজজীবনে মেলার প্রয়োজনীয়তা - মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
সমাজজীবনে মেলার প্রয়োজনীয়তা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

‘মেলা’ কথাটির অর্থ মিলন। বিশেষ উপলক্ষ্যে যেখানে অনেক মানুষের সমাগম ঘটে, নানা জিনিসপত্রের প্রদর্শনী হয়, তাকে মেলা বলা হয়। মেলার পিছনে কোনো-না-কোনো সামাজিক উৎসব, পুজো, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় প্রথা বা বিশ্বাস থাকে।

নানা উৎসব উপলক্ষ্যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল দুর্গোৎসব। দুর্গাপুজো শুধুমাত্র পুজো নয়, এটি এখন একটি জাঁকজমকপূর্ণ জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। দুর্গোৎসব ছাড়া রথযাত্রা, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, সরস্বতীপুজো প্রভৃতি উৎসবগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এইসব পুজোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা, প্রদর্শনী প্রভৃতিরও আয়োজন হয়। মুসলমানদের উৎসবগুলির মধ্যে মহরম, ইদ, বকরি ইদ, সবেবরাত, সবেমিরাজ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড়ো উৎসব হল বড়োদিন। এ ছাড়া বৌদ্ধগণ বুদ্ধপূর্ণিমা, জৈনগণ পরেশনাথের জন্মদিন এবং বৈয়বগণ চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি সাড়ম্বরে পালন করেন। ধর্মোৎসবগুলির মধ্যে সামাজিকতার থেকে বড়ো হয়ে দেখা দেয় ধর্মীয় অনুরাগ।

সামাজিক ও পারিবারিক উৎসবগুলির মধ্যে জন্মদিন পালন, বিবাহ, নববর্ষ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, জামাইষষ্ঠী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই উৎসবগুলি মূলত পারিবারিক, কিন্তু বহু মানুষের উপস্থিতির ফলে ওইগুলি মিলনোৎসবে পরিণত হয়। এ ছাড়া ‘অম্বুবাচি’, ‘নবান্ন’, ‘পৌষসংক্রান্তি’ প্রভৃতি উৎসবগুলি মূলত কৃষিভিত্তিক। নববর্ষ, বৃক্ষরোপণ, বর্ষামঙ্গল, হলকর্ষণ, শারদোৎসব, বসন্তোৎসব প্রভৃতি ঋতু উৎসবেও মেলা বসে।

বাংলার উৎসবানুষ্ঠানে বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য দুই-ই বিদ্যমান। নিতান্ত স্থানীয় পরিবেশ, লৌকিক প্রয়োজনে বা সমসাময়িক প্রভাবে বাংলার নিজস্ব উৎসবগুলির সৃষ্টি। চড়ক পূজা, গাজন উৎসব, শীতলা, সত্যনারায়ণ প্রভৃতি পুজো উপলক্ষ্যেও মেলা বসে। এগুলি একান্তভাবে গ্রামীণ মেলা।

মেলা প্রসঙ্গে যে মেলার কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হয় সেটি হল বইমেলা। জ্ঞানের প্রসারের ক্ষেত্রে বই হল একটি বড়ো মাধ্যম। তাই বইমেলা একক ও স্বতন্ত্র মেলা রূপে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বইপ্রেমী মানুষের মিলনতীর্থ হল বইমেলা। বইমেলায় প্রকাশক এবং পুস্তক বিক্রেতারা বিশ্বের নানা প্রান্তের নানা বিষয়ের বই এনে বিভিন্ন রুচির মানুষের সামনে হাজির করেন। বইমেলা জ্ঞানের অসীম ভান্ডারকে আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়। বইমেলায় পাঠক যেমন বিপুলসংখ্যক বইয়ের সান্নিধ্যে আসেন, তেমনি প্রকাশক ও বিক্রেতারাও লাভবান হন। এ ছাড়াও বর্তমানে খাদ্যমেলা, হস্তশিল্প মেলা, বস্ত্রমেলা প্রভৃতিও লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে।

“আমার আনন্দে সকলের আনন্দ হোক, আমার শুভে সকলের শুভ হোক, আমি যাহা পাই তাহা পাঁচজনের সহিত মিলিত হইয়া উপভোগ করি-এই কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ।” তাই উৎসবের দিনটি ধনী-নির্ধন, জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের মিলনের, প্রীতি বিনিময়ের এবং ভাবের আদানপ্রদানের পবিত্র মুহূর্ত। মেলায় মিলনটাই বড়ো কথা। দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য মেলার প্রয়োজন অনেকখানি। মেলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব কম নয়। মেলায় ধর্ম, বর্ণ, ভাষার ভেদরেখা মুছে গিয়ে সবাই আনন্দে মেতে ওঠে।

মেলা মানবজীবনে আরও বেশিমাত্রায় প্রকাশ পেলে মানুষের মনের প্রসার বাড়বে। যেসব উৎসব উপলক্ষ্যে মেলা বসে সেইসব উৎসবের সঙ্গে যে মেলা অনুষ্ঠিত হয় তা আরও সমৃদ্ধ করার দিকে মনোনিবেশ করা দরকার। লোকসংস্কৃতির ধারক এই মেলা মানবজীবনকে আরও সমুন্নত ও সমৃদ্ধ করুক-এই কামনা আমাদের সকলের।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment