ভ্রমণের মূল্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

ভ্রমণের মূল্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

ভ্রমণের মূল্য - মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
ভ্রমণের মূল্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
"বিশ্বভুবন আমারে ডেকেছে 'ভাই', 
চার দেওয়ালের গণ্ডি ছেড়ে তাইতো ছুটে যাই।"

মানুষ চিরকাল সুদূর পথের যাত্রী। তার রক্তে বাজে রবীন্দ্রনাথের গান “আমি চঞ্চল হে, আমি সুদুরের পিয়াসী।” গৃহের সীমা মানুষকে বদ্ধ করে রাখতে পারে না। দূর আকাশ, দূরদিগন্ত, দূর ভুবন হাতছানি দিয়ে ডাকে পিঞ্জরের পাখিকে। পাখির মতো গৃহবদ্ধ মানুষও ছটফট করে ঘরের বাইরে পা রাখার জন্য। কিন্তু পথ ডাকলেও অনেকসময় পাথেয় জোটে না, কখনও-বা পথের বন্ধু জোটে না। তবু মনপাখি বেরিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশে।

‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে’- মানুষের রক্তে আছে ভ্রমণের নেশা। পথ তাকে ডাকে, তাই যুগ যুগ ধরে গতিশীল মানুষ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে চলেছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যখনির অজানা রহস্যকে উদ্‌ঘাটিত করার উদ্দেশ্যে। সংকীর্ণ জীবনযাপনে আবদ্ধ থাকা মানুষের ধর্ম নয়। মানুষ চিরপথিক ও ভ্রমণশীল। পথ চলাতেই তার আনন্দ। পথ চলতে চলতেই মানুষ পায় নতুনের সন্ধান, জানে অজানাকে।

শস্যশ্যামলা ধরিত্রী কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে রয়েছে সৌন্দর্যের ঐশ্বর্যে। নদনদী, অরণ্য-সমুদ্র, পথ-প্রান্তর, মানুষের বিচিত্র সংস্কৃতি, বিচিত্র জীবনযাত্রা নিয়ে পৃথিবীর বিপুল আয়োজন। মানুষ সেই আয়োজনে অংশগ্রহণ করে অচেনা পৃথিবীকে জানতে চায়। তাই সে অন্তহীন সমুদ্রে পাড়ি দেয়, ছুটে যায় গহন অরণ্যে, অভিযান করে দুর্গম পাহাড়চূড়ায়। ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’ লঙ্ঘন করে কৌতূহলী মানুষ যাত্রা করে বৃহতের উদ্দেশে। প্রতিদিনের তুচ্ছ জীবনযাপন থেকে মুক্তি পায় উদার প্রকৃতির স্নেহধন্য আশ্রয়ে।

দেশভ্রমণের মধ্য দিয়ে মানুষের পরিধি বিস্তৃত হয়, একইসঙ্গে মানুষ নিজেকে উন্নত করে তোলে। দেশভ্রমণ আমাদের শিক্ষা দেয় ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ভারতীয় ঐতিহ্য বিষয়ে সচেতন হতে। সারা ভারতে নানা রাজ্য, নানা ভাষা, বিভিন্ন ধরনের মানুষের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের মধ্যে যে বৈচিত্র্য এবং ঐক্যের অনুরণন ফুটে ওঠে, তা দেশের নানা স্থান ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আমরা অনুধাবন করতে পারি। অন্যদিকে দেশভ্রমণের ফলে অন্য দেশের  অধিবাসীদের জীবনযাত্রা, আচার-ব্যবহার ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফলে মানুষের জ্ঞানভান্ডার বৃদ্ধি পায়। ভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয়, ভাবের আদানপ্রদান, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের ফলে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে। এইভাবে ভ্রমণ মানুষের হৃদয়কে সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে ঔদার্য্যের শিক্ষা দেয়।

দেশভ্রমণ মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে মানব সংস্কৃতিকেও সমৃদ্ধ করে তোলে। যুগ যুগ ধরে মানুষের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে – রচিত ভ্রমণসাহিত্য যে-কোনো দেশের ইতিহাসের অন্যতম সাহিত্যিক উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাং, অলবেরুনি, ইবন বতুতা প্রমুখদের রচনা তৎকালীন ইতিহাসকে আমাদের সামনে মূর্ত করে তোলে। শুধুমাত্র ইতিহাসের উপাদান হিসেবে নয়, ভ্রমণসাহিত্য সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট ধারা হিসেবেও জনপ্রিয়। ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে তা ঘরে বসে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করার এক মাধ্যম। 

দীর্ঘজীবনের প্রান্তভূমিতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথও হয়তো তাই বলেছিলেন-

"বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু বা জানি।”
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী।"

আসলে পৃথিবীটা অনেক অনেক বড়ো। অথচ এই পৃথিবীতে দীর্ঘদিন বাস করেও আমরা একবারের জন্যও পথে নামলাম না, দেখলাম না চোখ মেলে কত-না শহর-নগর-রাজধানী, কত-না মরুপ্রান্তর-বরফচূড়া-শ্যামল বনান্তর। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। পৃথিবীর প্রথম মানুষও কিন্তু ছিল পথিক মানুষ। যাযাবর মানুষ তখন নতুন নতুন বাসভূমির সন্ধানে অরণ্য-পর্বতে ঘুরে ঘুরে বেড়াত। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের অনুভূতিতে পূর্ণতার স্বাদ এনে দেয়। পুথিপোড় জগতের মানুষের জীবনের অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করে তোলে দেশভ্রমণ। প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক প্রকৃতি-ভ্রমণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় যেন মৃন্ময়ী হয়ে ওঠে।

মানুষ আজ পারস্পরিক শক্তির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। সুখ, বৈভব, উন্নতির পিছনে ধাবমান মানুষের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব আজ অন্যতম সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এই একাকিত্বকে দূর করার জন্য দেশভ্রমণ এক অন্যতম উপায় হয়ে উঠতে পারে। তাই ভ্রমণের আনন্দে মানুষকে বারবার বেরিয়ে পড়তে হবে নিরুদ্দেশের পথে। সূচিত হবে নিঃসঙ্গ যাযাবর মানুষের অন্তহীন পরিক্রমা, বিরামহীন পথচলা-‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনো খানে।’

ভ্রমণে প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মিলন ঘটে। নতুন জীবনদৃষ্টি আর জীবনীশক্তি দেয় ভ্রমণ। ভ্রমণকে কেন্দ্র করে নানা দেশে আজ গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প। এতে বৈদেশিক মুদ্রাও দেশের ঘরে আসে। এই সূত্রে বহু মানুষ বেঁচে থাকার মতো কাজও খুঁজে পায়। তাই একালে দেশভ্রমণ হয়ে উঠেছে জীবিকা অর্জনের হাতিয়ার।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment