শিক্ষায় ও চরিত্রগঠনে খেলাধুলা- মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

শিক্ষায় ও চরিত্রগঠনে খেলাধুলা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

শিক্ষায় ও চরিত্রগঠনে খেলাধুলা - মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
শিক্ষায় ও চরিত্রগঠনে খেলাধুলা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

আমরা জানি শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠার পথে জ্ঞানচর্চা ও খেলা পরস্পরের পরিপূরক ভূমিকা পালন করলে মানবমন সুন্দরভাবে বিকশিত হতে পারে। কারণ পরিপূর্ণ দৈহিক এবং মানসিক বিকাশের ফলেই কোনো মানুষের পূর্ণাঙ্গ চরিত্রগঠন সম্ভব হয়। আর সত্যি কথা বলতে জীবনে চলার পথে খেলাধুলার মধ্যেই মানুষ খুঁজে পায় অফুরন্ত আনন্দের চাবিকাঠি।

রবীন্দ্রনাথের মতে, প্রকৃতপক্ষে দেহ ও মনের যুগল সম্মিলনে শিক্ষা পূর্ণতা পায়। উপনিষদেও বলা হয়েছে, ‘বলহীনের দ্বারা আত্মালাভ হয় না।’ জ্ঞানসাধনার তপশ্চর্যায় দৈহিক কর্মশক্তির একান্ত প্রয়োজন। ‘Health is wealth’ -এই সুবচনকে জীবনে কার্যকারী করতে হলে, স্বাস্থ্যগঠন অপরিহার্য-দরকার খেলাধুলার।

শিক্ষা ও খেলাধুলা একে অন্যের পরিপূরক। খেলাধুলায় দৈহিক উৎকর্ষসাধনের সঙ্গে মানসিক উৎকর্ষও সাধিত হয়। রুগ্ম ও জীর্ণ দেহ লেখাপড়া ও কাজকর্মের পক্ষে অনুপযোগী। ফলে মনোযোগসহকারে কোনো কাজই করা যায় না। কাজে বিরক্তি, অনীহা ও আলস্য দেখা দেয়। তাই দেহ-মন সুস্থ রেখে বিদ্যার্জনের পথ সুগম করার জন্যই বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। দেহ ও মনের যুগলবন্দিতে গড়ে ওঠে মানবচরিত্রের ইমারত। তাই, খেলাধুলা শিক্ষার এক প্রয়োজনীয় অঙ্গ।

শিশুদের চরিত্রগঠনে খেলাধুলার ভূমিকা অপরিসীম। শিশুর মধ্যে শৃঙ্খলাপরায়ণতা, একাগ্রতা, দৃঢ়তা খেলাধুলার মাধ্যমেই জাগরিত হয়। শিশু জীবনের জয়-পরাজয়কে খেলোয়াড়ি মনোভাবে গ্রহণ করতে শেখে। খেলাধুলা নেতৃত্ব শক্তির সঙ্গে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। বিশেষ করে ফুটবল, ক্রিকেট, হকির মতো সংঘবদ্ধ খেলার ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার শিক্ষা তাদের বাস্তব জীবনে ব্যাপক ও উপযোগী প্রভাব বিস্তার করে। এককথায় তার ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিকাশ ঘটে। বিবেকানন্দ বলেছেন, “খেলার মধ্য দিয়েই শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব পায় উজ্জ্বলতা, হয়ে ওঠে সে নিয়মানুবর্তী, মানবতাবোধে হয় উদ্ভাসিত।”

শরীরের সঙ্গে মনের আনন্দের জন্যও খেলাধুলার প্রয়োজন। খেলা আমাদের জানার বাসনাকে বাড়িয়ে দেয়। ক্লান্তি দূর করে। খেলার মধ্য দিয়ে মানুষ যেমন নিয়মের অনুবর্তী হয় তেমনি সময় সম্পর্কে সচেতন হতে শেখে। কেন-না খেলায় যেমন আনন্দ আছে, তেমনই তার মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা ও ঐক্যবোধের শিক্ষাও আছে। এমনকি অপরের নেতৃত্ব মেনে চলা কিংবা অন্যকে নেতৃত্ব দিতে শেখা যায় খেলার মাধ্যমে।

খেলাধুলার প্রতি শিশুর আকর্ষণ সহজাত। জন্মের পর হাত-পা ছোড়ার মধ্য দিয়ে যে খেলা শুরু, তা ক্রমশ ঘরে এবং ঘর থেকে বাইরে মাঠে তাকে টেনে নিয়ে যায়। এই মুক্তি তার চরিত্রকে উন্মুক্ত ও প্রসারিত করে। তাই আধুনিক শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ হল খেলাধুলা ও শরীরচর্চা। স্কুলের পাঠক্রমে বাধ্যতামূলকভাবে এসেছে দৌড়, হা-ডু-ডু, খো-খো, ব্যায়াম, যোগাসন, জিমন্যাস্টিকস, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, ক্রিকেট প্রভৃতি নানান ধরনের ব্যক্তিগত ও দলগত খেলা।

অনেকে মিলে খেলতে অভ্যস্ত দলগত খেলাগুলিতে খেলার হার-জিতের পাশাপাশি এক বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবনারও জন্ম হয়। শিশুমনে সহযোগিতা ও সহানুভূতির বিকাশ ঘটে। এখানে উল্লেখ্য পরাধীন ভারতে শরীরচর্চার জন্য ব্রতচারী শিক্ষা শুরু করেছিলেন গুরুসদয় দত্ত। ব্রতচারী এমনই একটি চর্চা যা নাচগানের মধ্যে দিয়ে শরীর ও মনকে বিকশিত হতে সহায়তা করে। তিনি জ্ঞান, শ্রম, সত্য, একতা এবং আনন্দ-এই পাঁচটি ব্রত নিয়ে কিশোরদের উদ্দীপিত করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

হার্বার্ট স্পেনসার খেলাধুলাকে ‘অতিরিক্ত শক্তির প্রকাশ পথ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। খেলাধুলা ব্যক্তিত্ব বিকাশের মাধ্যম। এর মধ্যে রয়েছে বিশেষ ধরনের সৃষ্টিশীলতা। ফলে খেলাধুলা একাধারে সৃষ্টি ও আনন্দের মাধ্যম। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার মাধ্যমে প্রতিযোগী মনের মুক্তি ঘটে, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের সৃষ্টি হয় এবং নেতৃত্বলাভের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়।

খেলাধুলায় সংযম ও শৃঙ্খলার চর্চা থাকায় চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং মানসিক বলিষ্ঠতার জন্ম হয়। খেলার সাফল্য এবং ব্যর্থতা আমাদের জীবন সম্পর্কেও গভীর প্রত্যয়ী করে তোলে। মনের প্রকৃত ভারসাম্য বা sportsman’s spirit-এর খোঁজ মানুষতো খেলার মাঠেই লাভ করে। ধৈর্য, সাহস, দক্ষতা, একাগ্রতা, সহ্যশক্তি, উদারতা ও সর্বোপরি মানুষকে ভালোবাসার গভীর উপলব্ধি জন্মায় খেলার মধ্য দিয়ে। সর্বোপরি এ দরিদ্র দেশে সম্ভাবনাময় অজস্র শিশু-কিশোর সকলেই খোলা মাঠে খেলার সুযোগ পেলে হয়ে উঠবে সবল, উদার, অকুতোভয়, সচল ও গতিশীল। আমরা সমাজকে এই ব্যাপ্তিই তো দিতে চাই।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment