বিজ্ঞান বিপ্লব’ ও তার বিতর্ক সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

বিজ্ঞান বিপ্লব’ ও তার বিতর্ক সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

অথবা, ‘বৈজ্ঞানিক বিপ্লব’ কতদূর বৈপ্লবিক ছিল

বিজ্ঞান বিপ্লব' ও তার বিতর্ক সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো
বিজ্ঞান বিপ্লব’ ও তার বিতর্ক সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো

বিজ্ঞান বিপ্লবৰ

ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি পর্ব থেকে প্রায় অষ্টাদশ শতকের সূচনাকাল পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপে যুক্তিবাদী মননশীলতার চর্চা প্রচলিত বিভিন্ন ধ্যানধারণার আমূল পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরে। আর এইরূপ চর্চা তথা গবেষণা বিজ্ঞানের নানান শাখায় যে অভাবনীয় আলোড়ন সৃষ্টি করে, তাকে বিজ্ঞান বিপ্লব বা Scientific Revolution বলে অভিহিত করা হয়। এই পর্বে বিশ্বপ্রকৃতি, সমাজ, মহাকাশ সম্পর্কিত এক নতুন চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটে। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে নতুন যুক্তিসম্মত ও বাস্তব চিন্তাধারা, অনুসন্ধিৎসু মন গড়ে ওঠে। আধুনিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, বিজ্ঞান বিপ্লব ছিল প্রচলিত কুসংস্কার ও ধ্যানধারণার প্রতিবাদস্বরূপ। ইউরোপীয় সমাজকে আধুনিক চিন্তাচেতনা দ্বারা সমৃদ্ধ করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বিজ্ঞান বিপ্লব বা বৈজ্ঞানিক বিপ্লব।

বিজ্ঞান বিপ্লব সংক্রান্ত বিতর্ক / বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কতদূর বৈপ্লবিক ছিল

প্রকৃত অর্থে ‘বিপ্লব’ বলতে বোঝায় ‘আকস্মিক ও আমূল’ পরিবর্তন। নবজাগরণের পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের চরিত্র কি সেই অর্থে বৈপ্লবিক ছিল-এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কয়েকটি বিষয় এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন-

(1) ধর্মবিশ্বাসের সমান্তরাল অবস্থান: নবজাগরণ যুগের প্রথম পর্বের  বিজ্ঞানীরা ধর্মের সঙ্গে তাঁদের বিজ্ঞান অনুসন্ধানের কোনও সংঘাত দেখেননি। গ্যালিলিও, বেকন প্রমুখ ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। পার্থিব জগৎ তাঁদের দৃষ্টিতে ছিল ঈশ্বরের সৃষ্টি।

(2) অতীত অনুসন্ধান: আধুনিক বিজ্ঞানসাধকেরা ধর্মবিমুক্ত পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েও অতীতের বিশ্বপ্রকৃতির ধর্মীয় কল্পনার উৎস এবং তা থেকে তার যুক্তিসিদ্ধতা বিশ্লেষণ করতে বাধ্য হন।

(3) দীর্ঘ বিবর্তনের ফল: কিছু ঐতিহাসিক বিজ্ঞান বিপ্লবের সময়কাল অর্থাৎ বিজ্ঞান বিপ্লবের সূচনাপর্ব ও সমাপ্তিপর্ব নিয়ে বিতর্কের অবতারণা করেন। আবার কারও মতে, নবজাগরণোত্তর বিজ্ঞানচিন্তা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। বিশিষ্ট আমেরিকান ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী স্টিভেন শ্যাপিন (Steven Shapin)-এর মতে, দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটেছিল। গ্রিক, আরবীয় জ্ঞানসাধনার পথ ধরেই আধুনিক বিজ্ঞানচেতনা বিকশিত হয়েছে।

(4) প্রাক্-বিজ্ঞান মনন: আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের আগে প্রাক্-বিজ্ঞান মননশীলতার চর্চা প্রচলিত ছিল। অপরসায়ন (Alchemy), জাদুবিদ্যা, জড়িবুটি দ্বারা রোগ নিরাময় ইত্যাদি প্রথা-পদ্ধতির উদ্ভাবন আধুনিক বিজ্ঞানচিন্তার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।

(5) ইউরোপকেন্দ্রিকতা: আরব, মিশর, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি সাধিত হয়েছিল পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের পূর্বেই। কিন্তু বিজ্ঞান বিপ্লব শুধুমাত্র ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল।

(6) প্রাকৃতিক জগতের প্রাধান্য: পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের বৈজ্ঞানিকরা প্রাকৃতিক জগতের অন্তর্নিহিত সত্য অনুসন্ধানে অধিক উৎসাহী ছিল। তারা পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র, সৌরজগৎ ইত্যাদি সম্বন্ধে জানার তাড়নায় আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আবিষ্কারে মনোনিবেশ করেছিলেন।

(7) উপেক্ষিত নারীসমাজ : বিজ্ঞান বিপ্লব ইউরোপীয় নারীসমাজকে বিশেষ প্রভাবিত করতে পারেনি। এসময় নারীদের জন্য শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার সুযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত।

মূল্যায়ন

এইসব কারণে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চাকে ‘বিপ্লব’ বলা কতটা যুক্তিযুক্ত সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে। কারণ আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের আগে এক প্রাক্-বৈজ্ঞানিক মনন গড়ে উঠেছিল, যাকে Proto Science-ও বলা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য, জুড়িবুটির মাধ্যমে রোগ সারানো সম্ভব হত। এটিও ছিল বিজ্ঞানেরই অংশ। তবে কিছু সীমাবদ্ধতা বা বিজ্ঞানচিন্তায় ধারাবাহিকতা থাকলেও সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের বিজ্ঞানচর্চা অভাবনীয় আবিষ্কারের ঐতিহ্য তৈরি করেছে, জন্ম দিয়েছে আধুনিক সমাজ, সংস্কৃতি ও নৈতিকতাবোধের। মানুষের চিন্তাচেতনার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে বিজ্ঞান। দি অরিজিনস অফ মডার্ন সায়েন্স (The Origins of Modern Science) গ্রন্থে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও দার্শনিক স্যার হারবার্ট বাটারফিল্ড (Herbert Butterfield) বলেছেন যে, খ্রিস্ট ধর্মের অভ্যুদয়ের পর যা কিছু ঘটেছে, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সেগুলিকে ম্লান করে দিয়েছে। তাই এই ঘটনাকে বৈপ্লবিক বললে অতিরঞ্জন হবে না।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment