আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে আলোচনা করো

আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে আলোচনা করো

আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে আলোচনা করো
আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে আলোচনা করো

আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভব হল একটি বহুস্তরীয় ও জটিল প্রক্রিয়ার ফলাফল, যা ইউরোপের সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিগত এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল। বস্তুতপক্ষে প্রাচীন বিজ্ঞানভাবনা দ্বারা অনুপ্রাণিত আধুনিক বিজ্ঞানের উৎস সন্ধান করতে হলে গ্রিক এবং গ্রিকো-রোমক বিজ্ঞানের মধ্যেই তার অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। নবজাগরণের যুগেও প্রাচীন গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পুথিপত্রের প্রতি ইউরোপের অনুরাগ অব্যাহত ছিল। এই সকল পুথিপত্র ঘেঁটে সেখানে প্রাচীন মনীষীদের অসাধারণ মেধা ও কর্মগুণের পরিচয় পেয়ে ইউরোপ এক নব উদ্যমে বিজ্ঞানসাধনায় লিপ্ত হয়। ড. সমরেন্দ্রনাথ সেনের মতে, প্রাচীন বিজ্ঞানীরা যেখানে শেষ করেছেন, তারপর থেকেই আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়েছে।  ত্রয়োদশ শতকে রজার বেকনের আবির্ভাবের পর জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নবজীবনের সূচনা ঘটে। কোপারনিকাসের মহাকাশ তত্ত্ব এবং ভেসালিয়াসের শারীরতত্ত্ব প্রাচীন ধ্যানধারণার ভিত্তি টলিয়ে দেয়। এখান থেকেই শুরু হয় আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রা।

আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট

আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাব ও বিকাশের প্রেক্ষাপটে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যথা-

(1) বিজ্ঞানচেতনায় নবজাগরণ: যুক্তি এবং বিজ্ঞানচেতনা ছিল পঞ্চদশ শতকের ইউরোপে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট রচনায় যা ছিল সহায়ক। আধুনিক বিজ্ঞান হল পরীক্ষামূলক, যুক্তিপূর্ণভাবে তথ্যের বিচারবিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ, তুলনা, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি দ্বারা সিদ্ধ সর্বজনগ্রাহ্য নীতি বা সিদ্ধান্ত। ফলে বিজ্ঞানের জ্ঞান অভ্রান্ত, নির্ভুল ও সর্বজনবিদিত বলেই পরিগণিত হয়। তাই বলা যায়, রেনেসাঁ পর্বের ইউরোপের এই বিজ্ঞানচেতনা যে আধুনিক বিজ্ঞানের উষালগ্ন বা ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর বিজ্ঞান বিপ্লবের পটভূমি সৃষ্টি করেছিল সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

(2) বৈজ্ঞানিক বিপ্লব: ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে অষ্টাদশ শতকের সূচনাকাল পর্যন্ত সময়ে বিশ্বব্র্যান্ড, মহাকাশ ইত্যাদি ক্ষেত্র সম্পর্কে মানুষের নবলব্ধ জ্ঞানের উৎস প্রসঙ্গে বিজ্ঞান বিপ্লব কথাটি প্রয়োগ করা হয়। বস্তুতপক্ষে, এই কালপর্বে ইউরোপে মানবচেতনায় বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে এক নতুন চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটে। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের পরিবর্তে গড়ে ওঠে যুক্তিবাদী ও অনুসন্ধিৎসু মন। এককথায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মৌলিক আবিষ্কারসমূহ কৃষিকাজ, শিল্পোৎপাদন, সামরিক ব্যবস্থা তথা মুদ্রণ ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় অগ্রগতি সূচিত করে, তাকে অনেকে বিজ্ঞান বিপ্লব বলে অভিহিত করেন। এই কালপর্বে নিকোলাস কোপারনিকাস, গ্যালিলিও গ্যালিলি, জোহানেস কেপলার, আইজ্যাক নিউটন প্রমুখ ব্যক্তিত্ব প্রাকৃতিক ঘটনাবলি, মহাবিশ্বের গঠন প্রভৃতি বিষয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে নতুন তত্ত্ব প্রবর্তন করেন।

(3) সৃজনশীল ভাবনা ও আবিষ্কারসমূহ: প্রয়োগগত দিক দিয়ে বিজ্ঞানসাধনা, বিজ্ঞানীদের অধীত বিদ্যা নতুন আবিষ্কার ও বৈজ্ঞানিক সৃজনশীলতায় ভাস্বর। এই সৃজনশীল ভাবনা ও নব নব আবিষ্কারসমূহ বিজ্ঞান বিপ্লবের দ্বারা গতি পায়, উদ্ভব ঘটে আধুনিক বিজ্ঞানের। ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ থেকে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত যুগান্তকারী কিছু বিজ্ঞানচিন্তা আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর প্রস্তুত করে।

(4) ধর্মসংস্কার আন্দোলন: ইউরোপে নবজাগরণ বা রেনেসাঁ পর্বেও সমাজে চার্চ ও পোপের প্রাধান্য ছিল সর্বাধিক। তৎকালীন বিজ্ঞানে চার্চ বা খ্রিস্ট ধর্মবিরুদ্ধ কোনও তত্ত্ব উত্থাপিত হলে তাকে পরিত্যাগ করা হত। ষোড়শ শতকের ধর্মসংস্কার আন্দোলন চার্চ ও পোপের কর্তৃত্বকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়। ফলে মানুষের চিন্তাচেতনা জগতের সঙ্গে সঙ্গে গবেষণা, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্রেও স্বাধীনতা আসে। ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্তিলাভ করে মানুষের প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়, বৃদ্ধি পায় পরীক্ষানির্ভর গবেষণা ও অনুসন্ধানের আগ্রহ।

(5) ইউরোপে ধারাবাহিক বিজ্ঞানচর্চা: আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ও প্রেক্ষাপট লক্ষ করে দেখা যায় ইউরোপে ধারাবাহিক বিজ্ঞানচর্চা প্রাক্-নবজাগরণ যুগ থেকেই প্রবহমান ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইতালীয় পণ্ডিত টমাস অ্যাকুইনাস, জার্মান পণ্ডিত অ্যালবার্ট ম্যাগনাস, রজার বেকন (ইংল্যান্ড) ভেসালিয়াস (নেদারল্যান্ড), আমব্রোয়াজ পারে (ফ্রান্স), কোপারনিকাস (পোল্যান্ড) প্রমুখের কথা। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে শুরু করে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভব। পরবর্তীকালে অর্থাৎ ইউরোপের নবজাগরণের পর থেকে বিজ্ঞানসাধনার যে সূত্রপাত তা আজও থামেনি। বরং উত্তরোত্তর – এর জয়যাত্রার বিজয়রথ সমানগতিতে এগিয়ে চলেছে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment