জিয়াউদ্দিন বরণীর ‘ফতওয়া-ই-জাহান্দারি’-তে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কী ধারণা ছিল

জিয়াউদ্দিন বরণীর ‘ফতওয়া-ই-জাহান্দারি’-তে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কী ধারণা ছিল

অথবা, জিয়াউদ্দিন বরণীর ‘ফতওয়া-ই-জাহান্দারি’ থেকে দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে কী জানা যায়

জিয়াউদ্দিন বরণীর 'ফতওয়া-ই-জাহান্দারি'-তে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কী ধারণা ছিল
জিয়াউদ্দিন বরণীর ‘ফতওয়া-ই-জাহান্দারি’-তে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কী ধারণা ছিল

ভূমিকা

জিয়াউদ্দিন বরণী ছিলেন সুলতানি যুগের একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রনীতিবিদ। তিনি দীর্ঘকাল সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ সভাসদ ছিলেন। তাঁর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি রচনা করেন তারিখ-ই-ফিরোজশাহী নামক বিখ্যাত গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলকের প্রথম ছয় বছরের রাজত্বকাল পর্যন্ত মোট আটজন সুলতানের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। এই তারিখ-ই-ফিরোজশাহীর সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে তিনি রচনা করেন ফতওয়া-ই-জাহান্দারি। এই গ্রন্থে তিনি সুলতানি যুগের রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেছেন।

(1) রাজতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা

  • ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান: জিয়াউদ্দিন বরণী তাঁর ফতওয়া-ই- জাহান্দারিতে রাজতন্ত্রকে একটি ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দুই ধরনের রাজ্য বা রাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, -আল্লাহ বা ঈশ্বরের রাজ্য এবং ইহলোকের রাজ্য। তাঁর মতে, ঈশ্বরের রাজ্য হল আদর্শ রাজ্য। তিনি লিখেছেন, আল্লাহ বা ঈশ্বরই হলেন পার্থিব জগতের প্রকৃত শাসক এবং সকল ক্ষমতার উৎস। ঈশ্বর পার্থিব বা ইহলোকের জন্য শাসক (সুলতান) মনোনীত করেন। সুলতান বা শাসক হলেন তাঁর প্রতিনিধি মাত্র। তাই শাসক বা সুলতানকে তিনি ‘জিলুল্লাহ’ বা ঈশ্বরের ছায়া বলে উল্লেখ করেছেন।
  • বংশকৌলীন্য: বরণী তাঁর ফতওয়া-ই-জাহান্দারিতে সুলতানের বংশগত কৌলীন্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, সুলতানের বংশকৌলীন্য থাকা একান্ত আবশ্যক। নতুবা তিনি প্রজাসাধারণের আনুগত্য ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারবেন না। তাঁর আচার-আচরণেও গাম্ভীর্য থাকা দরকার।
  • সাসানীয় রাজতন্ত্রের অনুকরণ: পারস্যের সাসানীয় রাজতন্ত্রকে বরণী আদর্শ ইসলামীয় রাজতন্ত্র বলে গণ্য করতেন। তিনি মনে করতেন পারস্য সম্রাটই ইসলামের আদর্শের প্রকৃত রক্ষক। তাই জাঁকজমকপূর্ণ সাসানীয় রাজতন্ত্রের অনুকরণেই দিল্লি সুলতানির রাজতন্ত্র গড়ে তোলা উচিত।
  • শাসকের ক্ষমতা ও মর্যাদা: বরণীর মতে, রাষ্ট্রে শাসক বা সুলতান হলেন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি সব ধরনের বন্ধন থেকে মুক্ত। অর্থাৎ, তিনি একপ্রকার চরম রাজতন্ত্রকেই সমর্থন করেছেন। বরণী মনে করতেন, একজন শাসককে সবসময়ই কাফেরকে পরাজিত করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা উচিত। শাসক হবেন রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। রাজসভায় তাঁর সামনে সভাসদদের নতজানু হওয়ার রীতি চালু রাখা উচিত। তাঁর মতে, এতে শাসকের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

(2) রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা

  • ইসলামীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা: বরণী ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান। সেজন্য তিনি সুলতানদের ইসলামীয় আদর্শ অনুসরণে রাষ্ট্র পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, সুলতানি যুগে ভারতীয় মুসলিমরা ইসলামের মূল আদর্শ থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছেন। তাই সুলতানের উচিত চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইসলামের ভাবধারা ও আদর্শকে ফিরিয়ে আনা।
  • শরিয়তি বিধান অনুসরণ: বরণী তাঁর ফতওয়া-ই-জাহান্দারিতে বলেছেন, একজন শাসক বা সুলতান শরিয়তি আইন বা বিধান মেনেই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। তবে তিনি এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় শরিয়তি আইনকে পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি আলাউদ্দিন খলজি ও কাজি মুঘিসুদ্দিনের কথোপকথনের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। আলাউদ্দিন খলজি কাজি মুঘিসুদ্দিনকে বলেছিলেন “কোল্টিন্ট শরিয়তের বিধিসম্মত বা বিধিসম্মত নয় তা আমি জানি না। রাষ্ট্রপক্ষে যা কল্যাণকর বা আপৎকালে যা জরুরি বলে মনে করি, আমি তাই করি।”
  • জাওয়াবিত বা রাষ্ট্রীয় আইন: বরণীর মতে, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেহেতু শরিয়তি আইন পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, তাই এখানে সুলতানকে ‘জাওয়াবিত’ বা রাষ্ট্রীয় আইন প্রবর্তন করতে হবে।
  • মন্ত্রণাসভা বা পরামর্শ পরিষদ গঠন: বরণী বলেছেন, যে-কোনো দক্ষ ও বিচক্ষণ শাসকের উচিত জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ‘মন্ত্রণাসভা’ বা পরামর্শ পরিষদ গঠন করা। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে শাসক এই সভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
  • শাসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য: বরণীর মতে, শাসকের প্রধান কর্তব্য হল রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এ ছাড়াও রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, প্রজাকল্যাণ করাও শাসকের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন।

মূল্যায়ন

সবশেষে বলা যায় যে, বরণী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তাই তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে ধর্মীয় আদর্শের প্রভাবই বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। তিনি বলেছেন, “ধর্ম ছাড়া রাজনীতি অর্থহীন, আবার রাজনীতি ছাড়া ধর্ম অসহায়”। বরণী দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রকে জাহান্দারি বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলবনের একটি উক্তির মধ্য দিয়ে দিল্লির সুলতানদের ধর্মনিরপেক্ষতার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। বলবন একবার বলেছিলেন,-“আমার প্রভু ইলতুৎমিস প্রায়শই বলতেন যে, সুলতানের পক্ষে ধর্মবিশ্বাস মেনে কাজ করা সম্ভব নয়। আমার পক্ষে এটাই যথেষ্ট যে, তিনি ধর্মবিশ্বাস রক্ষা করতে সক্ষম।”

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment