দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে জিয়াউদ্দিন বরণীর অভিমত ব্যক্ত করো এবং সুলতানি রাষ্ট্র কি ‘ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র’ ছিল
অথবা, দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা করো

ভূমিকা
সুলতানি যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ও হলেন জিয়াউদ্দিন বরণী। তাঁর রচিত সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত গ্রন্থটি হল ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’। তিনি এই তারিখ-ই-ফিরোজশাহী-র সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে রচনা করেন ‘ফতওয়া-ই-জাহান্দারি’। এই গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রনীতি ও দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রাদর্শের মূলকথা
ইংরেজি ‘থিওক্র্যাটিক’ (Theocratic) শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘ধর্মাশ্রয়ী’ বা পুরোহিততান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই থিওক্র্যাটিক শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘থিওস’ (Theos) থেকে। এর অর্থ হল ঈশ্বর বা দেবতা (God)। এই অর্থে ঈশ্বর বা তাঁর প্রতিনিধি দ্বারা শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থাই হল ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র। এককথায়, ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হল ধর্মীয় আদর্শ বা বিধানের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা।
জিয়াউদ্দিন বরণীর অভিমত
জিয়াউদ্দিন বরণী দীর্ঘকাল উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত থাকার ফলে নানা রাজনৈতিক উত্থানপতন ও ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তিনি রচনা করেন ফতওয়া-ই-জাহান্দারি নামক গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে তিনি সুলতানি রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। জিয়াউদ্দিন বরণী দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে ‘জাহান্দারি’ বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এই অভিমতের স্বপক্ষে তিনি একাধিক যুক্তি দেখিয়েছেন।
- ইসলামীয় আদর্শের বিচ্যুতি: দিল্লির সুলতানরা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোরান-শরিয়ত বা ইসলামীয় আদর্শ থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচ্যুত হয়েছিলেন। বরণী লিখেছেন “সুলতান রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিয়মকানুন (জাওবিৎ) তৈরি করেন”।
- উলেমাদের ক্ষমতা হ্রাস: দিল্লির প্রায় সকল সুলতানই উলেমা বা ধর্মবিশারদদের পরামর্শ অনুযায়ী ধর্মনীতি বা শাসন পরিচালনা করতেন না।দ্যোজা
সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি
(1) ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের পক্ষে যুক্তি: আধুনিক ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ, আর পি ত্রিপাঠী, এ এল শ্রীবাস্তব প্রমুখরা বরণীর মতের বিরোধিতা করে সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে তাঁরা নানা যুক্তি দেখিয়েছেন। যথা-
- শরিয়তের আদর্শ অনুসরণ: ড. ঈশ্বরী প্রসাদ, আর পি ত্রিপাঠী প্রমুখরা মনে করেন দিল্লির সুলতানদের অধিকাংশই শরিয়ত বা ইসলামীয় আদর্শকে অনুসরণ করেই শাসন পরিচালনা করতেন। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন, সুলতানি যুগে শরিয়ত অনুসারে অমুসলমানদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় করা হত।
- খলিফার প্রতি আনুগত্য : ইসলাম জগতের প্রধান ধর্মগুরু হলেন খলিফা। আলাউদ্দিন খলজি ছাড়া দিল্লির সব সুলতানই খলিফার কাছ থেকে স্বীকৃতি গ্রহণ করেন। সুলতানরা খলিফার প্রতি আনুগত্য দেখানোর পাশাপাশি নিজেদের মুদ্রায় খলিফার নাম খোদাই করতেন এবং তাঁদের নামে খুৎবা পাঠ করতেন।
- উলেমা শ্রেণির প্রাধান্য: উলেমারা ছিলেন মুসলিম ধর্মবিশারদ। আলাউদ্দিন খলজি ও মহম্মদ বিন তুঘলক ছাড়া দিল্লির সকল সুলতানই শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের পরামর্শ মেনে চলতেন। উলেমারা চাইতেন সুলতান শরিয়তের বিধান মেনে ভারতবর্ষকে দার-উল-ইসলাম-এ (ইসলামীয় ধর্মরাজ্যে) পরিণত করবেন।
- শাসনকার্যে অমুসলমানদের উপেক্ষা: দিল্লির অধিকাংশ সুলতানই উচ্চ রাজপদগুলিতে মুসলমানদেরই নিয়োগ করতেন। উচ্চ রাজপদে নিয়োগ ও শাসনকার্য পরিচালনায় অমুসলমান বিশেষত হিন্দুরা ভীষণভাবে উপেক্ষিত হত।
(2) ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বিপক্ষে যুক্তি: ড. সতীশচন্দ্র, ড. মহম্মদ হাবিব, ড. কুরেশি, ড. হাবিবুল্লাহ, প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিকগণ সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে বরণী অভিমতকেই সমর্থন করেছেন। তাঁরা মনে করেন সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী ছিল না, এই রাষ্ট্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তিগুলি হল-
- ইসলামীয় আদর্শের বিচ্যুতি: ইসলামের বিধান অনুসারে মদ্যপান, মৃত্যুদণ্ড, সুদ গ্রহণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু দিল্লির সুলতানরা এইসকল ইসলামীয় বিধানগুলিকে মান্যতা দেননি। ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁরা ইসলামীয় আদর্শকে পুরোপুরি মেনে চলতেন না।
- খলিফার প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য: দিল্লির সুলতানরা ব্যক্তিগত দক্ষতা, যোগ্যতা ও সামরিক শক্তির ওপর ভিত্তি করেই ক্ষমতা ২১ দখল করেছিলেন। তাঁদের নিয়োগ, পদচ্যুতি কিছুই খলিফার মর্জির ওপর নির্ভরশীল ছিল না। তাই খলিফার প্রতি আনুগত্য ছিল বাহ্যিক, বাধ্যতামূলক নয়।
- উলেমাদের গুরুত্বহীনতা: দিল্লির অধিকাংশ সুলতানদের আমলেই রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে উলেমাদের কোনো গুরুত্ব বা ভূমিকা ছিল না। উলেমাদের নির্দেশ অনুযায়ী সুলতানরা চলতেন না। বরং অনেক সময়ে তাঁরা সুলতানদের ইচ্ছানুযায়ী চলতে বাধ্য হতেন। এমনকি শরিয়তের ব্যাখ্যাকেও পরিবর্তন করে নিতেন।
- স্বতন্ত্র রাজতন্ত্র : কোরানে বর্ণিত ইসলামীয় ধর্মরাজ্যের সঙ্গে ভারতে প্রতিষ্ঠিত সুলতানি রাষ্ট্রের সে অর্থে কোনো মিল নেই বলেই অনেকে মনে করেন। অর্থাৎ দিল্লির সুলতানরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে এদেশে রাজতন্ত্র গড়ে তুলেছিলেন।
মূল্যায়ন
দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী নাকি ধর্মনিরপেক্ষ ছিল- এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো বেশ কঠিন। কারণ উভয়পক্ষের ঐতিহাসিকদের বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্টই যুক্তি রয়েছে। তবে এ কথা সত্য যে, কোরানে বর্ণিত ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতে প্রতিষ্ঠিত সুলতানি রাষ্ট্রের সে অর্থে মিল ছিল না। আবার একে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষও বলা যায় না। আসলে শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও অভিজাত শ্রেণির ওপর সুলতানি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অনেকাংশেই নির্ভরশীল ছিল। তাই ড. সতীশচন্দ্র সহ অনেকেই সুলতানি রাষ্ট্রকে সামরিক ও অভিজাততান্ত্রিক বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর