ভারতীয় সমাজ-সংস্কারক হিসেবে রাজা-রামমোহনের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো

ভারতীয় সমাজ-সংস্কারক হিসেবে রাজা-রামমোহনের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো

ভারতীয় সমাজ-সংস্কারক হিসেবে রাজা-রামমোহনের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো
ভারতীয় সমাজ-সংস্কারক হিসেবে রাজা-রামমোহনের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো

অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন ভারতবাসীর অন্ধত্ব দূর করে সমাজ সচেতন, দেশপ্রেমিক, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শিক্ষার সমন্বয়সাধনকারী রাজা রামমোহন কুসংস্কারমুক্ত ভারত গড়ার জন্য ব্রতী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের সমন্বয় ধারায় নতুনত্ব আসবে। বিজ্ঞানমুখী চিন্তায় ভারতে অজ্ঞতা, কুসংস্কার দূর হবে। তাই সমাজসংস্কারক রামমোহনকে ভারতীয় সংস্কৃতির দূত বা Morning star of India বলা হয়। রাজা রামমোহনের সংস্কারবাদী চিন্তা ও চেতনাসমূহ নীচে আলোচনা করা হল-

(1) সতীদাহ প্রথা নিবারণ

স্বামীর মৃত্যুর পর জ্বলন্ত চিতায় তুলে দিয়ে সহমরণে বাধ্য করার বিরুদ্ধে রাজা রামমোহনের প্রতিবাদ আন্দোলনের ফলস্বরূপ 1829 সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক আইন করে সতীদাহ প্রথা নিবারণ করেন।

(2) কুসংস্কার দূরীকরণ 

রামমোহনের সংস্কারমুক্ত যুক্তিবাদী মন হিন্দুসমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কন্যাপণ, কৌলীন্য প্রথা, জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি বহুবিধ সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এইগুলি নিবারণের জন্য তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রতিবাদে সোচ্চার হন।

(3) নারীদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা

শুধু নারীর জীবন রক্ষাই নয়, মর্যাদা সহকারে তিনি তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। তিনি নারী-পুরুষ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, বিধবাবিবাহ প্রচলন, স্ত্রীশিক্ষাবিস্তার এবং বাল্যবিবাহ ও পুরুষের বহুবিবাহ রদ করা প্রভৃতি ব্যাপারেও উদ্যোগী হন। হিন্দুনারীর অধিকার সম্পর্কে তিনিই প্রথম মতামত ব্যক্ত করেন।

(4) জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা

রামমোহন রায় সমাজের জাতিভেদ প্রথার তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, জাতিভেদ প্রথা সমাজে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ গড়ে তোলে। তাই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে লেখা মহাযান বৌদ্ধগ্রন্থ ‘বজ্রসূচির’ অনুবাদও প্রকাশ করেন।

(5) নারীশিক্ষা

সমাজের বিশেষ অগ্রগতি ঘটাতে হলে নারীশিক্ষা দরকার। নারীশিক্ষা ছাড়া সুস্থ সমাজ গড়ে উঠবে না। সর্বস্তরে নারীমুক্তির আন্দোলনের তিনিই যুগপুরুষ।

(6) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা

ইংরেজ শাসিত ভারতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। নবজাগরণের কান্ডারী রামমোহন সেই সরকারি নীতির বিরুদ্ধে প্রথমে সুপ্রিমকোর্টে ও পরে Privy Council-এ প্রতিবাদ করেন।

(7) একেশ্বরবাদের প্রচার

সমাজ-সংস্কারক রামমোহন মানুষকে কুসংস্কার ও ধর্মের গোঁড়ামি ও কুফল সম্বন্ধে অবহিত করতে 1830 সালে ব্রাহ্মসমাজ গড়ে তোলেন। যেখানে একেশ্বরবাদের প্রচার করা হয়েছিল। এখানে একেশ্বরবাদ সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাস হল ছায়াহীন, কায়াহীন পরমব্রত্মের প্রচার, সর্বশক্তিতে তিনি বিরাজমান- তিনি সমাজকে কালিমামুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

(৪) সামাজিক শাসনব্যবস্থার সংস্কার

রামমোহন রায় কোম্পানির বিচারব্যবস্থা ও শাসনব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত করার উদ্দেশ্যে শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া ফৌজদারি আইনগুলিকে বিধিবদ্ধ করারও পরামর্শ দেন। পঞ্চায়েত প্রথার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে তিনি জুরি প্রথার প্রবর্তনের ব্যাপারে সচেষ্ট হন।

(9) স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশে গুরুত্ব ‘দান

রামমোহন রায় রুশোর দর্শনের দ্বারা। প্রভাবিত হয়ে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলির বহিঃপ্রকাশের উপর জোর দিয়েছেন। সমগ্র দেশবাসী যাতে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা লাভ করতে পারে সে বিষয়ে তিনি বার বার সোচ্চার হয়েছেন।

(10) সম্পত্তিতে নারীর অধিকার

অবলা নারীকে পারিবারিক বিষয়সম্পত্তিতে সঠিক অধিকার দেবার জন্য রামমোহন আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। পরবর্তীকালে আইন সংশোধন এবং সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। কাপড়ী গিয়ে চালনামায় বিভী।

(11) চাকরিতে বৈষম্য বিরোধিতা

ইংরেজ শাসিত ভারতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয়রা যোগ্য পদে কাজ করতে পারতেন না, এই নীতির বিরুদ্ধে জনমত সংগঠনে ও ইংরেজদের বিচার করার দায়িত্ব ভারতীয়দেরও থাকা উচিৎ এই দাবীর সমর্থনে তিনি আন্দোলন করেছিলেন।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment