প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডাইনি বিদ্যাচর্চার উপর আলোকপাত করো

প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডাইনি বিদ্যাচর্চার উপর আলোকপাত করো

প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডাইনি বিদ্যাচর্চার উপর আলোকপাত করো
প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডাইনি বিদ্যাচর্চার উপর আলোকপাত করো

ইউরোপের ক্ষেত্রে ডাইনি বিদ্যাচর্চার ইতিহাস সুপ্রাচীন। নৃতত্ত্ববিদগণ আফ্রিকাকে ডাইনি বিদ্যাচর্চা গবেষণার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে মনে করলেও, ইউরোপও কোনও অংশে কম ছিল না। মোটামুটিভাবে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইউরোপে মধ্যযুগের সূচনা হলে ডাইনি বিদ্যাচর্চা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পাশাপাশি দেখা যায় ডাইনি-নিধন বা Witch-Hunt-এর নামে নৃশংসতার এক নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ। জাতী

প্রাচীন ইউরোপে ডাইনি বিদ্যাচর্চা

(1) গ্রিস: দক্ষিণ ইউরোপের গ্রিসে বসবাসকারী আদিম জাতিদের মধ্যে প্রাচীন ডাইনি বিদ্যাচর্চার নিদর্শন পাওয়া গেছে। তারা বিভিন্ন জাদু, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি পালন করত।

  • পিথিয়া: গ্রিসে জাদু বা ডাইনিচর্চায় নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পিথিয়া। (Pythia) নামে এক শ্রেণির নারী পুরোহিত খুব প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাদের মানুষ ও দেবতাদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম (Oracle) হিসেবে গণ্য করা হত। এই নারী পুরোহিতরা দুর্বোধ্য মন্ত্রের সাহায্যে রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের ক্ষমতার অধিকারিণী ছিলেন, করতেন ভবিষ্যদ্বাণীও। তাদের এইসব মন্ত্রতন্ত্র এবং আচার-অনুষ্ঠানই হল ডাইনিবিদ্যার প্রাচীন রূপ। অর্থাৎ গ্রিসের আদিম জাদুকর-পুরোহিতরাই ছিলেন ডাইনিবিদ্যার প্রধান সাধিকা।
  • হেক্যাটি ও মিডিয়া: খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের পরবর্তীকালে গ্রিক জাদুকরদের আরাধ্যাদেবী ছিলেন হেক্যাটি (Hecate)। পরে মিডিয়াও (Medea) জাদুকরদের দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। দেবী হেক্যাটির বাহন ছিল হিংস্র কালো কুকুর। হেক্যাটি ও মিডিয়ার অনুগামী জাদুকররাই ডাইনি বিদ্যাচর্চায় ব্রতী হয়। এরা তীব্র ওষুধ ও পানীয় তৈরি করতে জানত। গোপনে অনেক অশুভ ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা। হেক্যাটির ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ছিল ঈশ্বরবিরোধী এবং নারকীয়।

(2) রোম: গ্রিসের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষ ডাইনি বিদ্যাচর্চার প্রতি আকৃষ্ট হয়। রোমানদের উপরও গ্রিসের অতিপ্রাকৃত চর্চার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল।

  • হারুসাপক্স: রোমের এটুস্ক্যান (Etruscan) ধর্মাচরণের যুগে এক শ্রেণির মানুষ ভবিষ্যৎ কথনকে তাদের লাভজনক পেশায় পরিণত করেছিল। এই গণৎকারদের ডাইনিতন্ত্রে হারুসপেক্স (Haruspex) বলা হত। এরা বলি দেওয়া পশুর নাড়িভুড়ি পরীক্ষা করে ভাগ্য গণনা করত। এই গুপ্তবিদ্যা থেকেই কালক্রমে রোমের ডাইনিবিদ্যার উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করা হয়।
  • রোমান ডাইনিদের আচার-অনুষ্ঠান: রোমান ডাইনিরা জিনি, ভূত, প্রেতাত্মা ও দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য নানান আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, নরকের দুষ্ট শক্তিকে জাগিয়ে তুলে তার সাহায্যে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব। রোমান দেবতা বা অপদেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য শিশুদের অপহরণ করে বলি দেওয়ার মতো নৃশংস কাজেও লিপ্ত ছিল ডাইনিরা। এর পাশাপাশি খ্রিস্ট ধর্মের বিলুপ্তিসাধনের জন্য তারা তৎপর হয়েছিল।
  • টুয়েলভ টেবিলস: খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত রোমান সম্রাটরাও ডাইনিদের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতেন। ডাইনিদের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য টুয়েলভ টেবিলস (Twelve Tables) নামক আইনে জাদুবিদ্যা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি এই আইন অনুসারে পৌত্তলিকদের শাস্তির বিধানও দেওয়া হয়। সম্রাট কনস্ট্যানটিয়াস (Constantius) ডাইনিদের দমন করার জন্য এশিয়া মাইনরের অসংখ্য নিরপরাধ পৌত্তলিককে নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন। তিনি আইন জারি করে ভবিষ্যৎ কথনও নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন।

মধ্যযুগের ইউরোপে ডাইনি বিদ্যাচর্চা

(1) খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে বিরোধ: ডাইনিবিদ্যা প্রাচীন প্যাগান ধর্মের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সামগ্রিকভাবে ডাইনিবিদ্যা বা Witchcraft খ্রিস্ট ধর্মের মূল ধারণার বিরোধী ছিল। খ্রিস্টান চার্চ মনে করত, ডাইনিরা সবাই শয়তানের উপাসক এবং তারা শয়তানের কাছ থেকেই তাদের সকল গুপ্তবিদ্যা আয়ত্ত করে। এমনকি ভেষজ ওষুধ দিয়ে যেসকল ডাইনিরা প্রাণ বাঁচাত, তাদেরও ভাবা হত চার্চের শত্রু।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডাইনিবিদ্যার প্রসার

স্পেন, ইটালি, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডাইনি বিদ্যাচর্চার প্রসার লক্ষণীয়।

স্পেন :

  • মুরদের অপরসায়নচর্চা: মধ্যযুগে স্পেনে ডাইনি বিদ্যাচর্চার বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল সেখানকার মুর (Moor) নামে পরিচিত মুসলমান অধিবাসীরা। এরা নবম-দশম শতাব্দী নাগাদ আরব থেকে স্পেনে এসে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। মুরদের মধ্যে অনেকেই অ্যালকেমি বা অপরসায়নচর্চার জন্য বিখ্যাত ছিল।
  • ডাইনি গুপ্তসমিতি: খ্রিস্টীয় চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে স্পেনে ডাইনি বিদ্যাচর্চা দ্রুতগতিতে প্রসার লাভ করে। বাল্ক প্রদেশ, ডালফিনি, গ্যাসকনি ইত্যাদি শহর ডাইনি আখড়ায় ছেয়ে গিয়েছিল। ডাইনিদের গুপ্তসমিতিতে দুষ্ট ভ্রাতৃত্ব-এর সম্পর্ক গড়ে উঠত। ফলে স্পেনে খ্রিস্টান যাজকগোষ্ঠী আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।
  • ইটালি: খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে ইটালির ভ্যাটিকান চার্চও কয়েকজন পোপের কার্যকলাপে কলুষিত হয় বলে জানা যায়। এই সময়ে সিলভেস্টর নামে এক গণিতবিদ পোপের পদ লাভ করেন। তাঁর নাম হয় দ্বিতীয় সিলভেস্টর (Pope Sylvester II) IF নিজের অন্তিমশয্যায় এই পোপ জানিয়েছিলেন যে, এক দুষ্ট আত্মার সঙ্গে চুক্তি করে তিনি পোপের পদ লাভ করেছেন। এইভাবে ইটালির যাজক সম্প্রদায়ের অনেকেই ডাইনিবিদ্যায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন।
  • ফ্রান্স: ফ্রান্সের গল জাতি তাদের জাদুবিদ্যা, মায়াবিদ্যার জন্য কুখ্যাত ছিল। আনুমানিক ৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে গলদের পরাজিত করে ফ্রাঙ্করা তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ওই সময় ফ্রিডিনোন্ডা নামে এক রাজমহিষী ভয়ংকর ডাইনি ছিলেন বলে জানা যায়। ফলে রাজপরিবার ও জনগণের মধ্যে ডাইনিচর্চা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
  • স্যালিক ল: এমতাবস্থায় ফ্রাঙ্কদের প্রথম রাজা ক্লোভিস (Clovis I) আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টাব্দে স্যালিক ল (Salic Law) F জারি করে ডাইনিদের উপর নানান বিধিনিষেধ ও জরিমানা ধার্যের বিধান দেন।
  •  পরিষদ গঠন: ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে অর্লিয়েন্স শহরে একটি পরিষদ গঠন করে ডাইনি বিদ্যাচর্চার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ভবিষ্যৎ কথন ও শাকুনবিদ্যা (পশুপাখির রব অনুসারে মানুষের শুভ-অশুভ বিচার) নিষিদ্ধ হয়। ডাইনিদের ধরপাকড় করে ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসী হিসেবে বেত্রাঘাত ও বিক্রয় করার এমনকি নিধনের কথাও বলা হয়।
  • ডাইনিদের প্রভাব: ফ্রান্সে পরবর্তীকালেও ডাইনিদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে ফ্রান্সে ডাইনিদের ছড়িয়ে দেওয়া বিষে গৃহপালিত পশু ও ফসলের ক্ষতি হয়। ডাইনিরা নাকি ইচ্ছেমতো ঝড় তুলতে ও রূপ বদল করতে এবং ভাগ্য গণনায় দক্ষ ছিল। সাধারণ মানুষ তাদের ভয় পেত।
  • জার্মানি: জার্মান উপজাতিরা ছিল বর্বর। তাদের পৌত্তলিক দেবদেবীরা ছিলেন রহস্যময় এবং ভয়ংকর। জার্মান ডাইনিরা সেইসব দেবদেবীর আরাধনা করে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে জার্মানি শয়তানের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল।
  • যাজকীয় বিধান: এই সময় জার্মানিতে যাজকীয় বিধান দেওয়া হয় যে, প্রতিটি চার্চ, ক্যাথিড্রালের সাধুসন্তদের ব্যবহৃত সামগ্রী এবং ভাঙা দাঁত, নখ, চুল, জুতো, ছাতা, লাঠি ইত্যাদি ফেলে দেওয়া যাবে না- মজুত করে রাখতে হবে। কারণ, এই সময় অনেক সাধুসন্ত ডাইনিদের শিকার হয়েছিলেন।
  • ইংল্যান্ড:
  •  ইংল্যান্ডে অ্যাংলো-স্যাক্সন রাজাদের সময়কাল থেকেই ডাইনি বিদ্যাচর্চার প্রচলন ছিল। তবে তা মূলত ভেষজ ওষুধের মাধ্যমে রোগ নিরাময়, কবজ, তাবিজ -এগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডে খ্রিস্ট ধর্মের প্রসার ঘটলে অবস্থার পরিবর্তন হয়।
  •  ইংল্যান্ডে একাদশ শতাব্দীতে ডাইনি বিদ্যাচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল, যা দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে আরও বৃদ্ধি পায়। উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন অভিজাত ব্যক্তিরাও ডাইনিবিদ্যার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন।
  • অন্যান্য দেশ: এ ছাড়া রুমানিয়া, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড ইত্যাদি অঞ্চলেও ডাইনিবিদ্যার প্রকোপ লক্ষণীয়। উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপীয় সমাজ-সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে ডাইনি বিদ্যাচর্চা পরিলক্ষিত হয়। মধ্যযুগে যা অতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে, আধুনিক যুগেও তার বিশেষ কোনও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment