ডাইনি হত্যার মতো নৃশংস ঘটনার পিছনে কী কী কারণ দায়ী বলে তোমার মনে হয়
অথবা, ডাইনি-নিধনের কারণগুলি উল্লেখ করো

প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ -সারা বিশ্ব জুড়ে অনেক সংস্কৃতিতেই ডাইনি-নিধন একটি পরিচিত ঘটনা। যুগ যুগ ধরে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ ডাইনিদের হত্যা করে চলেছে। ডাইনি-নিধন এত ব্যাপক হয়ে উঠেছিল কেন? কেনই বা প্রধানত মেয়েদেরই বেছে নেওয়া হত? -এই সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষকরা বিভিন্ন কারণ অনুসন্ধান করেছেন।
ডাইনি-নিধনের বিভিন্ন কারণসমূহ
আলোচ্য পর্বে ইউরোপে Witch-Hunt বা ডাইনি-নিধন বিষয়ে যে গণ উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল, তার পিছনে গভীর আর্থসামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণ সক্রিয় ছিল।
(1) ধর্মীয় কারণ: ডাইনি-নিধনের পিছনে সম্ভবত যে কারণটি সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল ছিল তা হল তীব্র ধর্মীয় ভাবাবেগ। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করত, ডাইনিরা ঈশ্বরবিরোধী ও শয়তানের উপাসক। তারা শয়তানের কাছ থেকে নানা গুপ্তবিদ্যা রপ্ত করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে। আসলে যাদের ডাইনি অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, তারা ছিল ইউরোপের প্রাচীন প্যাগান সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। প্যাগানদের ধর্মীয় রীতিনীতি ও উপাসনাপদ্ধতি খ্রিস্টান ধর্মের থেকে আলাদা ছিল। খ্রিস্টানরা প্যাগানদের মন্ত্রতন্ত্র ও তুকতাককে খ্রিস্ট ধর্মবিরোধী কুসংস্কার বলে মনে করত। তাই তারা ডাইনিদের নিশ্চিহ্ন করতে সচেষ্ট হয়েছিল।
(2) নারী বিদ্বেষ: খ্রিস্টান ধর্ম ছিল পুরুষতান্ত্রিক। মধ্যযুগের ইউরোপের খ্রিস্ট ধর্মের কর্তাব্যক্তিরা ছিলেন তীব্র নারী বিদ্বেষী। তাঁদের কাছে সৌন্দর্য হল অশুভ ও সুখশান্তি হল পাপ, যৌনতা অন্যায় ও জন্মদান বিরক্তিকর। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, নারীরা পুরুষকে পাপের পথে নিয়ে যায়। সমাজকে কলুষিত করে। এমনকি কিছু নারীর ভেষজবিদ্যা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান ও ক্ষমতাও নারী বিদ্বেষের অন্যতম কারণ ছিল। তাই খ্রিস্টানরা ডাইনি অপবাদে ১৪৮০ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লক্ষাধিক নারীকে হত্যা করে। কিছু ক্ষেত্রে পুরুষরা মারা গেলেও নারীদের সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক। যে কারণে অনেকেই ডাইনি-নিধনকে genderized mass murder বলে অভিহিত করেছেন।
(3) অর্থনৈতিক কারণ: খ্রিস্টানদের ডাইনি হত্যার পিছনে অর্থনৈতিক কারণও বিদ্যমান ছিল। কোনও ব্যক্তি অপর কোনও ব্যক্তিকে ডাইনি বলে যাজকদের কাছে অভিযোগ জানাত। অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার এবং বিচারে মৃত্যুদণ্ড-সহ বিভিন্ন শাস্তির বিধান দেওয়া হত। এরপর অভিযোগকারী ও বিচারক অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নিয়ে নিত। এইভাবে ডাইনি হত্যা ইউরোপে এক লাভজনক ব্যাবসায় পরিণত হয়। একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য ফাঁসুড়ে পেত ২০ সিলিং। ডাইনিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারলে আরও বেশি অর্থলাভ হত।
(4) সামাজিক কারণ: ডাইনি বিচার সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত উভয়পক্ষই পরস্পরের পরিচিত। তাদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে ঝগড়া-বিবাদ রয়েছে, একে অন্যকে হেনস্থা করার জন্যই ডাইনির অভিযোগ আনছে। ফ্রান্স ও সুইটজারল্যান্ডের মতো দেশে ভিক্ষুকরা গৃহস্থের কাছে ভিক্ষা না পাওয়ার জন্য গৃহস্থের বিরুদ্ধে ডাইনির অভিযোগ এনেছে এমন ঘটনার কথাও জানা যায়। অর্থাৎ স্থানীয় বিবাদ বা ব্যক্তিগত শত্রুতাও ডাইনি-নিধনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। এমনকি পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের ইউরোপে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে ডাইনিদের দায়ী করা হত।
(5) রাজনৈতিক কারণ (অভিজাত শ্রেণি ও চার্চের দুরভিসন্ধি): ইউরোপে অভিজাত ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ধনবৈষম্য ছিল। সেই সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলের গরিব আঞ্চলিক নেতারা প্রচার করতেন যে, ঈশ্বর গরিবদের ভালোবাসেন। শীঘ্রই তিনি আবির্ভূত হয়ে অভিজাতদের ধ্বংস করে পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। ফলে অভিজাত শ্রেণি ও চার্চের সঙ্গে তাদের সংঘাত বাধে। এই পরিস্থিতিতে চার্চ ও অভিজাতরা ডাইনি ভীতির হিড়িক তুলে বোঝাতে চায় যে, তাদের আসল সমস্যা হল পাশের বাড়ির ডাইনি। তাদের অশুভ ইচ্ছার জন্যই সাধারণ মানুষের সর্বনাশ হচ্ছে।
এক্ষেত্রে চার্চ ও অভিজাতদের দুরভিসন্ধি সাফল্য লাভ করেছিল। মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ মার্ভিন হ্যারিস (Marvin Harris)-ও দেখিয়েছেন যে, ত্রয়োদশ শতক থেকেই ক্ষমতাভোগী চার্চ ও অভিজাতদের শোষণ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। এমতাবস্থায় চার্চ ও অভিজাতরা ডাইনি-নিধনের মতো ধূর্ত চালে মূল লক্ষ্যকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল।
(6) মানসিকতা: ইউরোপে সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার অভাব ও কুসংস্কার ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। ফলে অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা ঘটলেই মানুষ সহজেই ডাইনিদের দায়ী করত। এমনকি ডাইনি-নিধনের সময় গণ উন্মাদনা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ত, যাতে নির্দোষ মানুষকে বিশেষত নারীকে ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত করে, তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত।
মূল্যায়ন
Witch-Hunting প্রসঙ্গে ডাইনি গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, মানুষের অদৃষ্ট শক্তির প্রতি বিশ্বাস, জাদুর দৃষ্টিতে জগতকে দেখার পিছনেই আসল কারণ লুকিয়ে আছে। বাস্তব জগতের এই কারণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ব্যক্তিগত শত্রুতা, অর্থলোভ, সম্পত্তি দখলের ইচ্ছা, অমঙ্গলের দায় অন্য কারোর উপর চাপিয়ে মানসিক শান্তিলাভ, জোটবদ্ধভাবে কাউকে অপরাধী বানিয়ে জীবনের একঘেয়েমি কাটানো, মানসিক রোগীর অদ্ভুত আচরণকে শয়তানের ভর বলে ব্যাখ্যা করা ইত্যাদি। তাছাড়া দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অনগ্রসরতারও একটি বড়ো ভূমিকা রয়েছে।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর