আধুনিক যুগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডাইনিবিদ্যার চর্চার উপর আলোকপাত করো

পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে আধুনিক যুগের সূচনা হয়। এই সময় বহুক্ষেত্রে ইউরোপীয়রা প্রগতিশীলতার নজির রাখলেও ডাইনিপ্রথার ক্ষেত্রে তাদের ধারণার বিশেষ কোনও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালি, ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশে মধ্যযুগের ন্যায় আধুনিক যুগেও ডাইনি বিদ্যাচর্চা অব্যাহত ছিল।
আধুনিক যুগের ইউরোপে ডাইনি বিদ্যাচর্চা
(1) জার্মানি: সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মানিতে যে বংশানুক্রমিক আচার ও ব্যাভিচারের প্রচলন ছিল, তাকে শয়তান ঐতিহ্য (Satanic Tradition) বলা হত। আধুনিক জার্মানিতে ডাইনি বিদ্যাচর্চা প্রসারলাভ করেছিল এদের মাধ্যমেই।
- উইচেস স্যাবাথ: জার্মান ডাইনিরা রাত্রিবেলা সমাধিক্ষেত্রে মশাল জ্বালিয়ে নারকীয় দুষ্টাচার ও নৈশভোজের উৎসব করত, যা উইচেস স্যাবাথ (Witches’ Sabbath) নামে পরিচিত। তারা খ্রিস্টীয় চার্চে অগ্নিসংযোগ, সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীদের উপর অকথ্য অত্যাচার, তাদের আসবাব পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি জঘন্য কাজে লিপ্ত ছিল।
- লিওপোল্ড-কে হত্যা: শয়তানের উপাসকরা জার্মানিতে যে অরাজকতা ও সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি করেছিল, জার্মান প্রশাসন তা দমন করতে তৎপর হয়। শেষপর্যন্ত তাদের দলনেতা লিওপোল্ড লিইয়ার্ক-কে হত্যা করে ডাইনিদের দমন করার চেষ্টা করা হয়।
- ব্ল্যাক ম্যাজিক বাইবেল: তবে এর পরেও তাদের দুষ্ট আচার-আচরণ সমানে চলতে থাকে। জার্মান স্যাটানিস্টদের হাতে বাইবেলের অনুকরণে প্রথম রচিত হয় ব্ল্যাক ম্যাজিক বাইবেল (Black Magic Bible), যা ছিল স্যাটানিস্টদের প্রথম ধর্মগ্রন্থ।
(2) ফ্রান্স: আধুনিক যুগে ফ্রান্সেও ডাইনিবিদ্যার চর্চা অব্যাহত ছিল। এই প্রসঙ্গে ফরাসি রাজপরিবারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
- ক্যাথরিন দ্য মেডিচি: ফরাসি সম্রাট দ্বিতীয় হেনরি (Henry II)-এর রানি ক্যাথরিন দ্য মেডিচি (Catherine de’ Medici) ছিলেন দুষ্ট জাদুকর লরেঞ্জো দ্য মেডিচি (Lorenzo de’ Medici)-র কন্যা। তাই বাল্যকাল থেকেই তিনি কালো জাদুচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জিশুখ্রিস্টের পবিত্র নৈশভোজের উৎসব খ্রিস্ট মাস (Christ Mass) অনুষ্ঠানকে ব্যঙ্গ করে রানি ক্যাথরিন ফ্রান্সে ব্ল্যাক মাস (Black Mass) উৎসবের সূচনা করেন। এই ব্ল্যাক মাস অনুষ্ঠানে শিশুবলি প্রথা চালু হয়। ফ্রান্সে তখন শয়তানের নামে হাজার হাজার শিশুকে বলি দেওয়া হত।
- সম্রাট তৃতীয় হেনরি: দ্বিতীয় হেনরি ও রানি ক্যাথরিনের চতুর্থ পুত্র তৃতীয় হেনরি (Henry III)-ও তাঁর মায়ের মতোই জাদুবিদ্যা চর্চায় উৎসাহী ছিলেন। ইউরোপে তিনি পরিচিত হন দুষ্ট জাদুসম্রাট হিসেবে। হেনরির জীবনের পরম ধর্মই ছিল দুষ্ট শক্তির উপাসনা। শেষপর্যন্ত নিজ প্রাসাদে একজন শয়তান জাদুকরের হাতেই নিহত হন তিনি।
- সম্রাট ত্রয়োদশ লুই: সম্রাট ত্রয়োদশ লুই (Louis XIII)-এর আমলে ফরাসি রাজপরিবারের মধ্যেও ডাইনি বিদ্যাচর্চার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সময় মঠবাসী অনেক খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীর মধ্যেও ডাইনি বিদ্যাচর্চার প্রবণতা বেড়েছিল।
- ফরাসি বিপ্লবের সময়কাল: ফরাসি বিপ্লবের সময় হঠাৎ করেই ফ্রান্সে ডাইনিবিদ্যার চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বিপ্লবের পরে আবার ডাইনি সংক্রান্ত ঘটনা ঘটতে থাকে। অনেকে বলেন, ডাইনিরাও দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাময়িকভাবে ডাইনিবিদ্যার চর্চা বন্ধ রেখেছিল। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই (Louis XVI)-এর মুন্ডচ্ছেদের পর সেই রাতেই ডাইনিরা একটি শয়তান সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে জানা যায়।
- সম্রাট সপ্তদশ লুই: ফরাসি সম্রাট সপ্তদশ লুই (Louis XVII)-এর ব্ল্যাক ম্যাজিক বা ডাইনি বিদ্যাচর্চার নেশা ছিল। তিনি মাত্র ২ বছর (১৭৯৩-১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্ব করেন। সপ্তদশ লুই খ্রিস্টান যাজিকা সিস্টার ফ্রাংকজি এনড্রির সঙ্গে আঁতাত করে একটি ডাইনি বিদ্যাচর্চার দল গঠন করেন। খ্রিস্টান চার্চ কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য এই দলের নাম রাখেন সেভিয়্যারস (Saviors)। কিন্তু মহামান্য পোপ এর আসল উদ্দেশ্য জানতে পেরে রোমের ভ্যাটিক্যান চার্চ থেকে ঘোষণা করেন যে, সম্রাট সপ্তদশ লুইয়ের গঠিত সেভিয়্যারস (পরিত্রাতা) দলটি আসলে ডাইনি বিদ্যাচর্চার দল। তারপর এই দল ভেঙে যায়।
(3) ইটালি: ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে ইটালিতে ডাইনি বিদ্যাচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে। ইতালীয়রা বিশ্বাস করত যে, সমস্ত রকমের রোগ-ব্যাধি, দুর্ভোগ, দুর্ঘটনার জন্য ডাইনিরা দায়ী। ১৬২৯-৩১ খ্রিস্টাব্দে মিলান (Milan) শহরে ভয়ংকর প্লেগ-মহামারির জন্য ডাইনিদের অভিযুক্ত করা হয়। এর ফলে ডাইনি সন্দেহে অনেক নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
- ন্যাপোলি ও লম্বার্ডি: দক্ষিণ ইটালির ন্যাপোলি (Napoli) ডাইনি নৈশভোজ উৎসবের (Black Mass) পীঠস্থানে পরিণত হয়। উত্তর ইটালির লম্বার্ডি (Lombardy) ছিল ডাইনি বিদ্যাচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।
- বিনানডান্টি: ইটালিতে বিনানডান্টি (Benandanti, Good Walkers) নামে এক শ্রেণির ভবঘুরের কথা জানা যায়, যারা ডাইনিদের (Malandanti) আক্রোশ থেকে মানুষকে রক্ষা করত। পরবর্তীকালে খ্রিস্টান যাজকীয় বিচারালয়ের (ইনকুইজিশন, Inquisition) বিচারকরা বিনানডান্টিদেরও ডাইনি বলে চিহ্নিত করেন। বিচারকদের যুক্তি ছিল ডাইনিদের কোপে পড়া মানুষকে সুস্থ করার ক্ষমতা যাদের আছে, তারাও ডাইনি। শাস্তির বিধান দেওয়া হয় তাদেরও। ফলে একদা ডাইনি-বিরোধী বিনানডান্টিরা ডাইনিদের সঙ্গে মিশে এক হয়ে যায় এবং খ্রিস্টানদের প্রতি আরও বেশি হিংস্র ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে।
(4) ইংল্যান্ড: ইটালির মতো আধুনিক ইংল্যান্ডেও ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ডাইনি বিদ্যাচর্চায় বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই সময়ে শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী-পুরুষরা ডাইনি বিদ্যাচর্চার প্রতি আকৃষ্ট হন।
- ডাইনিবিদ্যার প্রচারে কবি ও সাহিত্যিকগণ: অষ্টাদশ শতকে যুক্তিবাদী কবি-সাহিত্যিকগণও ডাইনিদের অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন। কবি ও প্রাবন্ধিক জোসেফ এডিসন (Joseph Addison) প্রকাশ্যে ডাইনিবিদ্যায় আস্থা জ্ঞাপন করেন। ইংল্যান্ডের প্রথিতযশা আইনবিশারদ স্যার উইলিয়ম ব্ল্যাকস্টোন। (William Blackstone) বলেছিলেন যে, ডাইনিবিদ্যার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার অর্থ হল ঈশ্বরের জগতকে অস্বীকার করা। ডাইনিবিদ্যার অস্তিত্ব যে আছে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশই তার সাক্ষ্যপ্রমাণ বহন করে চলেছে।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর