হান্টার কমিশন বা প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন (1882 সাল)- এর সুপারিশসমূহ বর্ণনা করো

1882 সালের ও ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ভারতীয় বড়োলাট লর্ড রিপন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতিকল্পে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন, যা প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন বলে পরিচিতি লাভ করে। যার সভাপতি ছিলেন স্যার উইলিয়ম হান্টার। কমিশনের সদস্যরা সমগ্র ভারত জুড়ে সমীক্ষার পর 1883 সালে 600 পৃষ্ঠার 222টি প্রস্তাব সম্বলিত সুবৃহৎ একটি রিপোর্ট পেশ করেন। এই কমিশনটি ‘হান্টার কমিশন’ নামেও খ্যাত।
সুপারিশসমূহ
(1) দেশজ শিক্ষা: কমিশন ভারতীয়দের প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে দেশজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এই ধরনের বিদ্যালয়গুলির অনুমোদন সম্প্রসারণ, শিক্ষক-শিক্ষণ ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রবর্তন ইত্যাদি কার্যাবলির উপর গুরুত্ব প্রদান করে কমিশন।
(2) প্রাথমিক শিক্ষা: কমিশনের মতে, প্রাথমিক শিক্ষা হল- জনশিক্ষা প্রসারের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এই সম্পর্কে কমিশনের সুপারিশগুলি হল-
শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। দেশের জনগণের জন্য ন্যূনতম শিক্ষার ব্যবস্থা করা। পাঠক্রমে থাকবে দেশজ গণিত, বিজ্ঞান, কৃষিকাজ ইত্যাদি। অনুন্নত অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং বিদ্যালয় পরিদর্শক (SI) নিয়োগ করতে হবে।
(3) মাধ্যমিক শিক্ষা: মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কিত কমিশনের সুপারিশগুলি হল-
শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করতে হবে। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিতে সমান সুযোগ প্রদান এবং প্রতি জেলায় মডেল হিসেবে একটি করে সরকারি বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা ও ইংরেজি ভাষা। শিক্ষার প্রথম স্তরে থাকবে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ পাঠক্রম এবং পরবর্তী স্তর বা মাধ্যমিক স্তরে দুই ধরনের পাঠক্রম থাকবে। যথা- A কোর্স – গতানুগতিক তত্ত্বমূলক বিষয়। B কোর্স- বৃত্তিমূলক বিষয়।
(4) উচ্চশিক্ষা: উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে হান্টার কমিশনকে কোনো সুপারিশ করার দায়িত্ব না দিলেও যেহেতু মাধ্যমিকের পরবর্তী স্তর হল কলেজীয় স্তর, সেহেতু কমিশন এই স্তরের কিছু মূল্যবান সুপারিশ উল্লেখ করে, তা হল- কলেজীয় স্তর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করা। বেসরকারি কলেজগুলিকে উপযুক্ত পরিমাণে অনুদান দেওয়া। আদর্শ কয়েকটি সরকারি কলেজ স্থাপন করা, যেগুলি বেসরকারি কলেজগুলির কাছে মডেল হয়ে উঠবে। মেধাবি শিক্ষার্থীদের বৃত্তিদান করা। কৃতী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দিতে ব্যবস্থা করা।
(5) শিক্ষক-শিক্ষণ: শিক্ষকদের যথাযথভাবে পরিদর্শন ও শিক্ষণের এর পাশাপাশি ব্যাবহারিক শিক্ষণ ও শিক্ষানীতি সুপারিশ করা হয়। সম্পর্কে গুরুত্ব দিতে বলে কমিশন।
(6) ধর্মশিক্ষা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ না করলে তাদের কোনোপ্রকার সরকারি অনুদান দেওয়া হবে না বলা হয়। প্রত্যেক ধর্মের মূলনীতির উপর ভিত্তি করে পাঠ্যপুস্তক তৈরির কথা বলা হয়।
(7) নারীশিক্ষা: নারীশিক্ষার উন্নতিকল্পে পৃথক স্কুল নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। বিদ্যালয়গুলিতে মেয়েদের পড়ানোর জন্য মহিলা শিক্ষিকারা অগ্রাধিকার পাবে বলা হয়। অনগ্রসর অঞ্চলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য বেশ কিছু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।
(8) মুসলিম শিক্ষা : মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, বৃত্তিদানের ব্যবস্থা, কলেজ ও নর্ম্যাল স্কুল গঠনের জন্য সুপারিশ করা হয়। মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলিতে মুসলিম ছাত্রদের জন্য পৃথক পাঠ্যসূচি অবলম্বনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। সুতরাং, আমরা বলতে পারি ভারতীয় শিক্ষার উন্নয়নে হান্টার কমিশন তথা প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের অবদান বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাতেও প্রতীয়মান।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর