সমাবর্তন বলতে কী বোঝো? বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্যগুলি লেখো

সমাবর্তন বলতে কী বোঝো? বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্যগুলি লেখো

সমাবর্তন বলতে কী বোঝো? বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্যগুলি লেখো
সমাবর্তন বলতে কী বোঝো? বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্যগুলি লেখো

সমাবর্তন

বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় সমাবর্তন উৎসবের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার সমাপ্তি ঘোষণা করা হত। সমাবর্তন উৎসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্নাতক হিসেবে পরিগণিত হতেন। স্নাতক ও ধরনের-  বিদ্যাস্নাতক, ব্রতস্নাতক, বিদ্যাব্রত স্নাতক। এই তিন ধরনের উপাধি দিয়ে শিক্ষার্থীদের সমাবর্তন উপাধির সমাপ্তি ঘোষণা করা হত।

বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্যসমূহ

এই শিক্ষার লক্ষ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল-

(1) মুক্তি লাভ: ধর্মভিত্তিক বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল জগতের সর্বপ্রকার মোহ থেকে মুক্ত হয়ে মোক্ষলাভ করা। চতুরাশ্রমে এই মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে যে স্তরগুলি ছিল সেগুলি হল ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস।

(2) পরমসত্তাকে উপলব্ধি: মানুষের আত্মা পরমাত্মার অংশ। জ্ঞানের বিকাশের মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের পরমসত্তাকে উপলব্ধিতে সহায়তা করাই ছিল প্রাচীন বৈদিক শিক্ষার চরম লক্ষ্য।

(3) আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধি: প্রাচীন ভারতীয় ঋষিগণ জাগতিক সুখকে চরম লক্ষ্য বলে মনে করেননি। তাঁদের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হল নিজেকে জানা এবং সত্যকে উপলব্ধি করা। তাই বৈদিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হল আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধি। এইজন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে সততা, আদর্শপরায়ণতা, কর্মদক্ষতা প্রভৃতি দিকের বিকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত।

(4) পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যার অনুশীলন: শিক্ষার লক্ষ্য হল জীবনের মুক্তি লাভ। তাই পরাবিদ্যা এবং অপরাবিদ্যার অনুশীলন প্রয়োজন। পরাবিদ্যা হল পরমজ্ঞান লাভের বিদ্যা। অপরাবিদ্যা হল পার্থিব জ্ঞান লাভের বিদ্যা। উপনিষদে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র পরাবিদ্যার অনুশীলন মানুষকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য অপরাবিদ্যা অর্থাৎ ব্যাবহারিক বিদ্যার অনুশীলন প্রয়োজন। তাই বৈদিক শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে গিয়ে পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যার সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে।

(5) দেহ ও মানর বিকাশ: বৈদিক শিক্ষার লক্ষ্য হল বিভিন্ন ব্যাবহারিক কাজকর্মের মধ্য দিয়ে শারীরিক বিকাশ ঘটানো এবং মনকে সৎ চিন্তাভাবনার অধিকারী করে তোলা।

(6) আত্মনিয়ন্ত্রণের শিল্ডা: সংযমী জীবনযাপনের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ ছিল বৈদিক শিক্ষার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য। আচার্য তাঁর শিষ্যদের এই শিক্ষা দিতেন।

(7) শৃঙ্খলাপরায়ণতা : এই শিক্ষাব্যবস্থা নির্দিষ্ট নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ ছিল। গুরুগৃহে প্রত্যেক শিষ্যকে কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে হত, যা তাদের মধ্যে গভীর আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি করত। এক্ষেত্রে প্রত্যেক শিষ্যকে কঠোর কৃচ্ছসাধন করতে হত। এইভাবে তারা শিখত শৃঙ্খলাপরায়ণতা।

(8) বিশ্লেষণী ক্ষমতা : শিষ্যের মধ্যে গভীর বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে গুরু শিষ্যকে উৎসাহিত করতেন বিভিন্ন তর্ক, বিতর্কমূলক সভায় অংশগ্রহণ করার জন্য। এর ফলে শিষ্যদের মধ্যে বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত।

(9) সামাজিক বিকাশ বা নৈতিক বিকাশ: গুরুরা শিষ্যদেরকে শিক্ষাদানের পাশাপাশি ন্যায়, নীতি, ধৈর্য, সততা, মূল্যবোধ প্রভৃতি গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করতেন।

(10)  আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ: শিক্ষার্থীর বিশ্বব্র্যান্ডের পরমসত্তাকে জানার জন্য ও নিজেকে অভিন্ন সত্তায় উপলব্ধি করতে আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ঘটানো এই শিক্ষার লক্ষ্য ছিল।

(11) ব্যক্তিত্বের বিকাশসাধন: প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব পরস্পরের থেকে পৃথক। তাই ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো ছিল এই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।

(12) সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা: দেশের এবং সমাজের প্রয়োজনের কথা ভেবে বৈদিক শিক্ষার পাঠক্রমে পরাবিদ্যার পাশাপাশি অপরাবিদ্যাকে শিক্ষাব্যবস্থায় স্থান দেওয়া হয়েছিল, কারণ প্রাচীন ঋষিরা কখনোই চাইতেন না যে সবাই নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী হয়ে সমাজ ও সংসার ভুলে থাকুক। সমাজে সৎ, দায়িত্ববান সুনাগরিকের সংখ্যা বৃদ্ধি হোক এটা সকলেই মনে-প্রাণে চাইতেন।

(13)  শিষ্যের চরিত্রগঠান সহায়তা: বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থার অপর একটি লক্ষ্য ছিল শিষ্যের চরিত্রগঠনে সহায়তা করা। বৈদিক শিক্ষায় গুরুমহাশয় কেবলমাত্র পাঠদানই করতেন না, শিক্ষার্থীর চারিত্রিক বিকাশেও সমানভাবে গুরুত্ব দিতেন। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, ধৈর্য, সদাচার, সু-অভ্যাস গঠন ইত্যাদি বিষয়েও শিক্ষার্থীদের অবহিত করা হত। আশ্রমের বিভিন্ন কার্যাবলির মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সু-অভ্যাস, সদাচার, সত্যবাদিতা ইত্যাদি গুণের বিকাশ ঘটত।

আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment