শিশুর বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা  করো

শিশুর বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা  করো

ব্যক্তিগত বৈষম্যের ক্ষেত্রে মূল দুটি কারণ হল বংশগতি ও পরিবেশ। মানবজীবনের উপর এই দুটি উপাদানের অপরিসীম প্রভাব রয়েছে। বিশেষভাবে শিশুর শিক্ষা বংশগতি ও পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। বংশগতি সূত্রে প্রাপ্ত গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশ তখনই সম্ভব হবে, যদি পরিবেশ সহায়ক হয় অর্থাৎ বংশগতির জন্য প্রাপ্ত শক্তিগুলির কোনো মূল্যই নেই, যদি সেগুলির প্রকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করা সম্ভব না হয়। আবার শিশুকে ভালো পরিবেশ প্রদান করা গেল, অথচ সে বংশগতিজনিত কোনও গুণই নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি, তাহলেও তার সার্থক জীবনবিকাশ সম্ভব হবে না। স্যান্ডিফোর্ড (Sandiford) বলেছেন যে, বংশগতি ও পরিবেশ হল দুটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত উপাদান। ব্যক্তির জীবনবিকাশ বংশগতি ও পরিবেশের. পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে নির্ধারিত হয়। মনোবিদ অলপোর্টও (Allport) এই মতবাদ স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন যে, বংশগতি ও পরিবেশের গুণফলের উপর ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা নির্ভর করে। তিনি তাঁর এই ধারণাটিকে গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে প্রকাশ করেন। সমীকরণটি হল P = f(HxE), যেখানে P = ব্যক্তিত্ব, H = বংশগতি এবং E = পরিবেশ। অর্থাৎ ব্যক্তিত্ব হল বংশগতি ও পারিবেশের গুণফলের অপেক্ষক (function)।

শিশুর বিকাশ বংশগতি ও পরিবেশের পারস্পরিক ক্রিয়ার ফল

(1) ব্যক্তিসত্তার বিকাশ : ব্যক্তিসত্তার বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম। বংশগতি অনুযায়ী, সম্ভাবনা নির্ধারিত করে পরিবেশ তাকে রূপায়িত করে।

(2) দৈহিক ও মানসিক শক্তিলাভ: শিশু কতগুলি দৈহিক ও মানসিক শক্তি লাভ করে বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাবে।

(3) পূর্বনির্ধারিত প্রকৃতির বিকাশ : বংশগতি ও পরিবেশের সম্পর্ক নিছক গাণিতিক যোগের সম্পর্ক নয়। প্রত্যেক জীব বংশগতি ও পরিবেশের গুণফলের সমষ্টি অর্থাৎ ব্যক্তিত্ব = বংশগতি পরিবেশ।

(4) অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গুণের বিকাশ: বংশগতি প্রভাব বিস্তার করে দেহ, বুদ্ধি, মানব প্রকৃতি, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ গুণের উপর। কিন্তু শিশুর নৈতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলির উপর পরিবেশের প্রভাবই বেশি।

(5) শক্তিসঞ্চয়: বংশগতি এবং পরিবেশের প্রভাবে ব্যক্তি, শিশু বিবিধ দৈহিক ও মানসিক শক্তি লাভ করে।

(6) অভ্যাস গঠন: শিশুর অভ্যাস গঠনে বংশগতি এবং পরিবেশের যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান।

(7) প্রাক্ষোভিক বিকাশ: শৈশবকালে শিশুর প্রক্ষোভগুলি থাকে অনিয়ন্ত্রিত। বংশগতি এবং সামাজিক পরিবেশ শিশুর এই অনিয়ন্ত্রিত প্রক্ষোভগুলি নিয়ন্ত্রিত করতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, শিশুর প্রাক্ষোভিক বিকাশ সমাজ পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়।

(৪) ভাষাবিকাশ: শিশুর ভাষাবিকাশে বংশগতি এবং পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ শিশু যে সমাজে জন্মগ্রহণ করে বা লালিতপালিত হয়, সেই সমাজের ভাষা সে আয়ত্ত করে। যেমন- ভারতীয় বংশোদ্ভূত কোনো সদ্যজাতকে যদি ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়, তাহলে সে বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকেই রপ্ত করবে।

(9) শৃঙ্খলাবোধের বিকাশ : বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাবে ব্যক্তির মধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলাবোধের বিকাশ ঘটে, যার ফলে ‘ব্যক্তির মধ্যে সামাজিকতাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ জাগ্রত হয়।

(10) সৃজনধর্মী ক্ষমতার বিকাশ : সৃজনধর্মী ক্ষমতার বিকাশও ঘটে থাকে বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাবে, যা শিশুকে নতুন নতুন বিষয় তৈরিতে প্রেরণা জোগায়।

(11) সুস্বাস্থ্যের অধিকারী: বংশগতি এবং পরিবেশগত উপাদানগুলির সুপ্রভাব শিক্ষার্থীকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সুতরাং জীবনপরিবেশের বিকাশ কোনো একটি উপাদানের উপর নির্ভরশীল নয়, জীবনপরিবেশ পরিবর্তনশীল, তাই বিকাশের দুটি উপাদানের একটি পরিবর্তনশীল হওয়ায় ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা বা বিকাশও পরিবর্তনশীল। তাই শিশুর বিকাশে বংশগতি বড়ো না পরিবেশ বড়ো এই প্রশ্ন নিরর্থক।

আরও পড়ুন – মনোবিজ্ঞানে অনুসন্ধানের পদ্ধতিসমূহ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment