শিক্ষার ক্ষেত্রে আকবরের অবদান লেখো

শিক্ষার ক্ষেত্রে আকবরের অবদান লেখো

শিক্ষার ক্ষেত্রে আকবরের অবদান লেখো
শিক্ষার ক্ষেত্রে আকবরের অবদান লেখো

শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্রাট আকবরের অবদান

দিল্লির মসনদে আকবর 1556 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1605 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। জাতি- ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জ্ঞানীগুণী ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের সম্রাট আকবর যথোচিত সম্মান প্রর্দশন করেন। এ থেকে শিক্ষাবিস্তারে তাঁর উৎসাহী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।

(1) গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা: আকবর ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতি আলোচনার জন্য ফতেপুর সিক্রির ইবাদৎখানায় বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক বিশাল গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। সুবিশাল গ্রন্থাগারকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনি তার সমগ্র গ্রন্থভাণ্ডারকে বিজ্ঞান ও ইতিহাস এই দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। তিনি ইবাদৎখানায় বসে যেসব আলোচনা করতেন ও শুনতেন তা ছিল অনন্যসাধারণ।

(2) শিক্ষানীতি: আকবরের নির্দেশ ছিল ছেলেরা প্রথমে ফারসি বর্ণমালা ও উচ্চারণ শিখবে এবং ছেদচিহ্ন কোথায় পড়বে তা লিখবে। এগুলি শেখা হয়ে গেলে যুক্তবর্ণ লিখবে। তারপর ছোটো ছোটো নীতিকথা বা ধর্ম সম্পর্কীয় পদ ও গদ্যরচনা পড়তে চেষ্টা করবে। অপেক্ষাকৃত সহজতম পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

(3) শিক্ষক: আকবরের উদারতা শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। শিক্ষক নির্বাচনে তিনি হিন্দু ও মুসলিম বৈষম্য প্রদর্শন করেননি। তিনি বলেন, শিক্ষক সাহায্য করবেন যতটা সম্ভব কম। শিক্ষকদের কয়েকটি বিষয়ের উপর নজর রাখতে হবে। যেমন- বর্ণমালা, শব্দার্থ, যুক্তবর্ণ, নতুন অর্ধশ্লোক শিক্ষা।

(4)  উদার ও কর্মভিত্তিক পাঠক্রম: মুঘল সম্রাট আকবর শিক্ষার পাঠক্রমকে জীবনমুখী করে তোলেন এবং শিক্ষণ পদ্ধতির সংস্কারসাধন করেন। পাঠক্রমের মধ্যে ছিল গণিত, জ্যামিতি, কৃষি, জমির জরিপ, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ইতিহাস, প্রকৃতিবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দেহ বিজ্ঞান, ঈশ্বরতত্ত্ব ইত্যাদি। এ ছাড়াও সংস্কৃত শিখতে হলে ছাত্রদের ব্যাকরণ, ন্যায়, বেদান্ত, পতঞ্জলি ইত্যাদি শিখতে হত। তাঁর শাসনকালে হিন্দু ও মুসলিম ছাত্ররা একই মাদ্রাসায় বিদ্যাভ্যাস করতে পারত।

(5)  আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতি: আকবরের আমলে প্রবর্তিত শিক্ষণ পদ্ধতি অক্ষর জ্ঞান, শব্দার্থ অনুধাবন, অর্ধশ্লোক, কবিতা ও স্তোত্র পাঠ এবং পুরোনো পাঠের পুনরাবৃত্তিকরণ প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত ছিল। এইভাবে কয়েক মাস ধরে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া হত। তিনি চেয়েছিলেন যান্ত্রিক শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তে একটি গতিশীল শিক্ষাপদ্ধতির প্রবর্তন করতে, যাতে শিক্ষার্থীরা অল্প সময়ে লেখাপড়া শিখতে পারে। ছাত্ররা যতটা সম্ভব নিজেরাই শিখবে এই নির্দেশের মধ্যে তাঁর আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। তিনি চেয়েছিলেন ছেলেরা যাতে না বুঝে মুখস্থ করার যন্ত্রে পরিণত না হয়।

(6) শিল্প ও সংগীতের সূচনা: আকবর শিল্প ও সংগীতের গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনি কেবল পুঁথি বা ধর্মপুস্তক বা ধর্মশিক্ষার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। তাঁর আমলে চিত্রকলা, চারুকলা, স্থাপত্য চর্চা, হস্তশিল্প, সংগীতকলা ইত্যাদি বিষয়গুলি উপযুক্ত মর্যাদা পেত। তানসেন, হরিসেন প্রভৃতি শিল্পী ও গুণীজনেরা তাঁর সভা অলংকৃত করে ভারতীয় সংগীতের নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন।

(7)  সংস্কৃতির সমন্বয়: শিক্ষাক্ষেত্রে আকবরের উল্লেখযোগ্য অবদান হল সংস্কৃতির সমন্বয়। হিন্দু ও মুসলমানদের যৌথ প্রয়াসে জাতীয় রাষ্ট্রগঠনের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তা পূরণ হয়েছিল তাঁর শিক্ষণ সমন্বয় প্রচেষ্টায়। ইবাদৎখানায় তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও উলেমাদের সঙ্গে বসে ধর্ম ও অন্যান্য আলোচনায় অংশ নিতেন। তিনি হিন্দুদের যেমন মাদ্রাসার শিক্ষায় উৎসাহিত করেছেন, তেমনই মাদ্রাসায় হিন্দু শাস্ত্রাদি অধ্যয়নের ব্যবস্থাও করেছেন। তাঁর আদেশে রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ করা হয়। সংস্কৃত সাহিত্যের সম্পদ ফারসি ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থাও করেছেন। তাঁর আমলে ফৈজি লীলাবতী গণিতের অনুবাদ করেছিলেন। আকবরের আমলে দোঁহা, ভজন, গজল প্রভৃতি বিখ্যাত রচনাগুলি হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির মহামিলনের প্রতীক। ধর্মীয় দিক থেকে দীন-ই-ইলাহি ধর্মমত প্রচারের মাধ্যমে সম্রাট আকবর সমন্বয়বাদী আদর্শ প্রচার করতে চেয়েছিলেন।

উদারতা এবং পরধর্মসহিমুতার কারণে সম্রাট আকবরকে Akbar The Great বা মহান আকবর হিসেবে অভিহিত করা হয়। শিক্ষাক্ষেত্রেও সম্রাট আকবর অনেক মহৎ কীর্তি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের জনগণকে একত্রিত করে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করা। গণশিক্ষা ও শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক অচলাবস্থাকে কাটিয়ে এক নতুন যুগের সূত্রপাত ঘটান। তবে রাজশক্তির সহায়ক মুসলিম শিক্ষা সমাজের সর্বস্তরের রক্ষণশীলতার জন্য এদেশের মাটিতে দৃঢ়বদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।

আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment