শিক্ষাক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো

শিক্ষাক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো

অথবা, ভারতবর্ষে রামমোহন রায় আধুনিক শিক্ষার অগ্রদূত আলোচনা করো

অথবা, শিক্ষাসংস্কারে রামমোহনের অবদান আলোচনা করো

শিক্ষাক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।
শিক্ষাক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।

উনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে বাংলায় যে নবজাগরণের সূচনা হয়, সেই যুগসন্ধিক্ষণে রামমোহনের আবির্ভাব। ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে তিনি ছিলেন নবজাগরণের অন্যতম চিন্তানায়ক। রাজা রামমোহন রায় (1772-1833 সাল) ছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত। তাঁকে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ, আধুনিক ভারতের জনক প্রভৃতি নানা অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ভারত পথিক বলে সম্মান জানিয়েছেন। তাঁর মতে রামমোহন রায় ভারতবর্ষে আধুনিক যুগের সূচনা করেন। যেসব কঠিন বাধা প্রতি পদক্ষেপে আমাদের অগ্রগতি রোধ করত, তিনি পথপ্রদর্শক রূপে সেগুলি দূর করেন। জওহরলাল নেহরুর মতে, রামমোহন রায় হলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক। আজ আমাদের সাহিত্য, ধর্ম, শিক্ষা, বিজ্ঞান, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি যাকেই আমরা আধুনিক বলি-না-কেন, রামমোহন হলেন তারই অগ্রদূত।

(1) শিক্ষার লক্ষ্য: রামমোহন রায়ের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হবে জাগতিক ও সমাজকল্যাণ শিক্ষার মাধ্যমে একটি পরিশীলিত ও যুক্তিবাদী মনের জন্ম হোক। তিনি মনে করতেন শিক্ষার লক্ষ্য হবে বুদ্ধির জড়তা ও মনের অন্ধকার দূর করার জন্য জ্ঞান বৃদ্ধি করা।

(2) শিক্ষার মাধ্যম: রাজা রামমোহন রায় ভাষা নিয়ে বহু পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে সমস্ত কিছু বিচারবিবেচনা করে তিনি মাতৃভাষাকেই শিক্ষার মাধ্যম বা বাহনরূপে গণ্য করার পক্ষাপাতী ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন বিষয় বিচারবিশ্লেষণে উচ্চতর চিন্তার বাহন হিসেবে বাংলা গদ্যসাহিত্যকে ব্যবহার করে বাংলা ভাষাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। 

(3) পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে অবদান : রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের জন্য কলকাতায় 1828 সালে একটি ইংরেজি শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ওই স্কুল সিটি কলেজ নামে পরিচিত হয়। এ ছাড়া পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সপক্ষে সরকারি মনোভাব গঠনে ও হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তিনি ডেভিড হেয়ারকে স্কুল সোসাইটি ও স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছিলেন। ভারতবর্ষের সর্বক্ষেত্রের উন্নতির জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের চেষ্টা করলেও দেশীয় শিক্ষাকে কিন্তু অবহেলা করেননি তিনি।

(4) অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল ও বেদান্ত কলেজ স্থাপন: রামমোহন রায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সভ্যতার সমন্বয়সাধনের উদ্দেশ্যে 1882 সালে অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল স্থাপন করেন। পাশাপাশি প্রাচ্য ভাষাচর্চার উদ্দেশ্যে 1826 সালে মানিকতলায় বেদান্ত কলেজ স্থাপন করেন।

(5) পত্রপত্রিকা প্রকাশ: 1815 সাল থেকে 1830 সালের মধ্যে রামমোহন রায় প্রায় 30টি পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করেছেন। বাংলা ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় লেখা বই, প্রচার পুস্তিকার সংখ্যাও ছিল প্রচুর। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় 1821 সালে সম্বাদ কৌমুদী নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। 1822 সালে প্রকাশ করেন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা মিরাৎ-উল-আখবর’ যার অর্থ সংবাদ দর্পণ।

(6) ভারতীয়দের বিজ্ঞান শিক্ষা: রামমোহন রায়ের মতে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার লাভ হলে কুসংস্কার দূর হবে। এজন্যই তিনি গণিত, দর্শন, রসায়ন, অস্থিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা পড়ানোর জন্য ইউরোপীয় শিক্ষক নিয়োগ করার কথাও বলেছিলেন।

(7) নারীশিক্ষা বিস্তার: সে যুগে স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে হিন্দু সমাজের তেমন সমর্থন ছিল না বললেই চলে। রামমোহন প্রাচীন শাস্ত্রের দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রমাণ করেন যে, বৈদিক যুগে নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। তিনি নারীশিক্ষাকে প্রতিটি স্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি সমাজের মেয়েদের ও পুরুষদের সমান মর্যাদাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। বাংলায় সম্বাদ কৌমুদী (1821 সাল) এবং ফারসিতে মিরাৎ-উল-আখবর (1822 সাল)-তে মহিলাদের আইনানুগ নানান আবিষ্কার ও তাদের শিক্ষাদানের জন্য দাবি করা হয়।

(৪) জনশিক্ষার বিস্তার: সাধারণ মানুষ যাতে নিজেরাই সমাজ ও ধর্ম সম্পর্কে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে আর এ কাজ যে একমাত্র শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমেই সম্ভব, তা তিনি অনুভব করেছিলেন। তাঁর সমাজসংস্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষকে কুসংস্কারমুক্ত ও অভিজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের পথেও সত্যের পথে আনা। গণশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং তাঁর সংবাদপত্রের মাধ্যমেও তিনি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা করেন। 

(9) ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রসার: ইংরেজি ভাষা ছাড়া যে পাশ্চাত্য সাহিত্য ও জ্ঞান- বিজ্ঞানকে আয়ত্ত করা সম্ভব নয় এ কথা রাজা রামমোহন রায় উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি ভারতীয় হয়েও সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন।

(10) ভারতীয় সংস্কৃতির উন্নয়ন: ভারতপথিক বুঝেছিলেন ভারতের বিকাশ ঘটাতে হলে ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতির উন্নয়ন ও জাগরণ দরকার। পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে থেকে ভারতীয় সমাজ-শিক্ষা-নীতির নবজন্ম দরকার।

(11) বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শিতা : রামমোহন বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। বিশেষত সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, লাতিন, ফরাসি, গ্রিক, হিব্রু ও পরবর্তীকালে ইংরেজি এই আটটি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তাঁর এই গভীর ও ব্যাপক অধ্যয়নের ফলেই বিভিন্ন বিষয় সৃষ্টির এক অপূর্ব সমন্বয়সাধন হয়েছিল ।

(12) বাংলা সাহিত্যের বিকাশ: রামমোহন সংস্কৃত ভাষায় তৎসম-তদ্ভব শব্দের বেড়াজাল হতে মুক্ত করে আধুনিক বাংলা গদ্য-পদ্যের জনক হন। পাশাপাশি হিন্দি-ফারসি ভাষা থেকে বাংলা গ্রন্থ রচনা করতেন। শাস্ত্রের বিচার, ব্যাকরণ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কিত পুস্তক বাংলা ভাষায় রচনা করে বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। তিনি ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ ও ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ প্রকাশ করেন যথাক্রমে 1815 এবং 1833 সালে। পাশাপাশি তিনি আধুনিক শিক্ষার জন্য ভারতীয় ভাষার উপর জোর দেন। তাঁকে আধুনিক সাহিত্যে বাংলা গদ্যের জনক (Father of Modern Literacy Bengali Prose) বলা হয়। 

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment