মৌলিক অধিকার ও কর্তব্যসমূহ প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE

মৌলিক অধিকার ও কর্তব্যসমূহ প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE

মৌলিক অধিকার ও কর্তব্যসমূহ প্রশ্ন উত্তর
মৌলিক অধিকার ও কর্তব্যসমূহ প্রশ্ন উত্তর

১। নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে পরস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা করো। 

অথবা, অধিকারের মধ্যে কর্তব্য নিহিত-উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।

অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক

[1] অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত: অধিকার ও কর্তব্যের ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির আলোচনা সম্ভব নয়। অধিকার ও কর্তব্য উভয়ই সৃষ্টি হয়েছে মানুষের সমাজবোধ থেকে। সমাজের বাইরে এদের কোনো অস্তিত্ব নেই। সমাজের বিভিন্ন দাবিগুলিকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিলে তা অধিকারে রূপান্তরিত হয়। এই অধিকারগুলি নাগরিকদের কাছ থেকে কিছু দায়িত্বপালন আশা করে, যেগুলি কর্তব্য নামে পরিচিত।

সূচিপত্র

[2] কর্তব্য পালনের উপর অধিকার নির্ভরশীল: অধ্যাপক ল্যাস্কি-র মতে, যে ব্যক্তি কর্তব্য পালন করবে না, সে অধিকার ভোগ করতে পারবে না। তাছাড়া একজনের অধিকারভোগ অন্যদের কর্তব্য পালনের উপর নির্ভরশীল।

[3] অধিকারের ভিত্তি হিসেবে সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য: সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনকে অধিকারের ভিত্তি হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে বেন ও পিটার্স বলেন যে, কর্তব্য পালনের উপর অধিকারভোগ নির্ভরশীল। হবহাউস-এর বক্তব্য হল, অধিকারভোগ সামাজিক দায়িত্ব পালনের শর্তসাপেক্ষ। সমাজ ব্যক্তিকে অধিকার দান করে, যাতে সে তার ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের মাধ্যমে নিজেকে সমাজকল্যাণে নিয়োজিত করতে পারে।

[4] রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালনের মাধ্যমে অধিকারবোধ: অধিকারের উৎস হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে তার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। এটি হল রাষ্ট্রের কর্তব্য। একইভাবে নাগরিকদের রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য রয়েছে। যেমন-নিয়মিত কর দান, রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন মান্য করা প্রভৃতি। নাগরিকরা এই কর্তব্যগুলি মেনে চললে রাষ্ট্র অচল হয়ে পড়ে না। আবার রাষ্ট্র তার কর্তব্য পালন না করে নাগরিকদের কাছ থেকে আনুগত্য আশা করতে পারে না। রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে নাগরিকরা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রদর্শন করতে পারে।

[5] অধিকার নিয়ন্ত্রিত : অধিকার অবাধ হয় না। সীমাহীন অধিকার স্বেচ্ছাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। অধিকার অবাধ হলে দুর্বলশ্রেণি সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তাই অধিকারের পরিধি কর্তব্যবোধ দ্বারা সীমিত।

[6] নৈতিক ক্ষেত্রে  ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক : নৈতিক অধিকার ও নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। পিতার যেমন নৈতিক অধিকার আছে বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ, আদর-যত্ন পাওয়ার, সেরূপ যথার্থ দায়িত্বপালন, শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের দ্বারা সন্তানকে মানুষ করে তোলা পিতার নৈতিক কর্তব্য। অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে এই সম্পর্ক উদারনৈতিক ও সমাজতান্ত্রিক সমস্ত রাষ্ট্রদর্শনে স্বীকৃত।

[7] ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের সমন্বয়: অধিকার এমনভাবে ভোগ করতে হয়, যাতে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে একটা সমন্বয়সাধন সম্ভব হয়। প্রত্যেকটি অধিকারের সঙ্গে ব্যক্তিগত কল্যাণ ও সামাজিক কল্যাণের সমন্বয়সূচক ধারণা জড়িত।

২। অধিকার সম্পর্কিত তত্ত্বের মধ্যে স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব এবং আইনগত তত্ত্ব বিশ্লেষণ করো।

স্বাভাবিক অধিকার বিষয়ক তত্ত্ব

স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বটি একটি প্রাচীন তত্ত্ব। প্রাচীন গ্রিসের স্টোয়িক দর্শনে এবং রোমান আইনবিদদের লেখায় স্বাভাবিক অধিকারের ধারণার প্রথম সন্ধান পাওয়া যায়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস হবস্, জন লক্ এবং জ্যাঁ জ্যাক রুশোর রচনায় স্বাভাবিক অধিকার সম্পর্কিত তত্ত্বের বিকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে স্পেনসার, গিডিংস, ব্যোম, গ্রিন ও ল্যাস্কির লেখাতেও এই তত্ত্বটি সমর্থিত হয়।

  • মূল বক্তব্য: যেসব অধিকার মানুষের সহজাত, যে অধিকারগুলি মানুষ জন্মসূত্রে লাভ করে, সেগুলিকে স্বাভাবিক অধিকার বলে। এই অধিকারগুলি সর্বজনীন ও চিরন্তন। সমাজ বা রাষ্ট্র স্বাভাবিক অধিকারের উপর কোনোরকম বিধিনিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। সাধারণত জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার এবং সম্পত্তি ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের অধিকারকে স্বাভাবিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
  • সমালোচনা: সমালোচকদের মতে, স্বাভাবিক অধিকার শব্দটির কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা না থাকায় কোনটি স্বাভাবিক অধিকার এবং কোনটি নয়, সে সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেননি। তাছাড়া রাষ্ট্র ও সমাজনিরপেক্ষ স্বাভাবিক অধিকারের ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব কল্পনা।

আইনগত তত্ত্ব

স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে আইনগত অধিকার তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। অনেকে মনে করেন, সার্বভৌমিকতার একাত্ববাদী ধ্যানধারণা থেকে এই তত্ত্বের সৃষ্টি। বেথাম, অস্টিন, সলমন্ড, রিচি প্রমুখ হলেন অধিকারের আইনগত তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা।

  • মূল বক্তব্য: অধিকারের আইনগত তত্ত্ব অনুযায়ী ব্যক্তির যাবতীয় অধিকারের উৎস হল রাষ্ট্র, রাষ্ট্রবহির্ভূত কোনোরকম অধিকারের অস্তিত্ব বাস্তবে থাকতে পারে না। বাস্তবে প্রচলিত আইনই হল অধিকারের প্রকৃত ভিত্তি। আইনের মাধ্যমে অধিকারের সৃষ্টি হয় বলে আইনের রদবদলের সঙ্গে অধিকারেরও রদবদল ঘটে। অধিকারের আইনগত তত্ত্বের প্রবক্তাদের বক্তব্য হল, অধিকার ভোগের জন্য নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি আনুগত্য দেখানো বাধ্যতামূলক।
  • সমালোচনা: অধিকারের আইনগত তত্ত্বের সমালোচনা করে ল্যাস্কি বলেন, অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট হয় না। রাষ্ট্র শুধুমাত্র অধিকারের স্বীকৃতি দেয় এবং তাকে সংরক্ষণ করে। মার্কসবাদী সমালোচকদের মতে, রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় আইন কখনোই শ্রেণিস্বার্থমুক্ত হতে পারে না।

মূল্যায়ন

অধিকার সম্পর্কিত তত্ত্বগুলি আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, অধিকারের প্রকৃতি উন্মোচনে তত্ত্বগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। সামন্তসমাজের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে স্বাভাবিক অধিকারের মতবাদ অতীতে সামগ্রিক প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি বর্তমানেও জীবনের অধিকার ও স্বাধীনতার অধিকারকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।

অধিকারের আইনগত মতবাদের মূল্যও অপরিসীম। আধুনিক সার্বভৌম জাতীয় রাষ্ট্রে এই মতবাদের বক্তব্য স্বীকৃতি অর্জন করেছে। একথা অনস্বীকার্য যে আইন হল অধিকারের প্রধান উৎস। আইন কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত না হলে নাগরিকরা কোনো অধিকার ভোগ করতে পারে না।

৩। অধিকার সম্পর্কিত তত্ত্বের মধ্যে আদর্শবাদী তত্ত্ব ও মার্কসীয় তত্ত্ব লেখো।

আদর্শবাদী তত্ত্ব

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান আদর্শবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্তার পূর্ণ বিকাশের জন্য যে তত্ত্বের অবতারণা করেন, তা থেকেই অধিকারের আদর্শবাদী তত্ত্বের জন্ম হয়।

মূল বক্তব্য: অধিকারের আদর্শবাদী তত্ত্বের মূল বক্তব্য অনুসারে, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য বাহ্যিক শর্তগুলি হল অধিকার। জার্মান আদর্শবাদী দার্শনিক কান্ট এবং ইংরেজ দার্শনিক গ্রিন এই মতবাদের অবতারণা করেছেন।*। আদর্শবাদী দার্শনিকরা অধিকার ভোগ করার সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যপালনের বিষয়টিকেও যুক্ত করতে চেয়েছেন।

সমালোচনা: সমালোচকদের মতে, অধিকারের আদর্শবাদী তত্ত্বে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রের বেদীমূলে বলি দেওয়া হয়েছে। এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হেগেল যে সর্বাত্মক বা সর্বশক্তিমান আত্মসচেতন নৈতিক সত্তাবিশিষ্ট রাষ্ট্রের কথা বলেছেন, তা আসলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তির অধিকারের পরিপন্থী।

মার্কসীয় তত্ত্ব

অধিকার সম্পর্কে মার্কসীয় মতবাদ গতানুগতিক ও প্রচলিত দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকৃতির। রাষ্ট্র এবং আইন নিয়ে যে ব্যাখ্যা মার্কস দিয়েছিলেন, তা থেকেই অধিকার সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বের উৎপত্তি।

মূল বক্তব্য: অধিকারের মার্কসীয় তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল, প্রতিটি সমাজে অধিকারের ধারণা সেই সমাজের অর্থনৈতিক বিন্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে ওঠে। উৎপাদন ব্যবস্থা হল সমাজের মূল ভিত্তি। রাষ্ট্র, আইন, অধিকার প্রভৃতি উপরিকাঠামো অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর নির্ভরশীল। *2 মার্কসীয় অধিকার তত্ত্বের মূল ভিত্তি হল অর্থনৈতিক অধিকার। এই তত্ত্ব অনুসারে, অর্থনৈতিক অধিকার হল অন্যান্য অধিকারের নির্ধারক। সমাজতান্ত্রিক সমাজে অর্থনৈতিক অধিকারের গুরুত্ব স্বীকার করে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তার ফলে সব মানুষ সব অধিকার সমানভাবে ভোগ করার সুযোগ পায়।

  • সমালোচনা: অধিকারের মার্কসীয় তত্ত্ব ত্রুটিমুক্ত নয়। সমালোচকদের মতে, মার্কসীয় তত্ত্বে অধিকারের প্রকৃতি বিশ্লেষণে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিষয়ের উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া মার্কসীয় তত্ত্বে রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। বস্তুত, এই তত্ত্বে ব্যক্তির চেয়ে সমাজের সমস্যা ও শ্রেণিগত সমস্যাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতা অবহেলিত হয়েছে।

মূল্যায়ন

অধিকার সম্পর্কিত আদর্শবাদী তত্ত্বের গুরুত্ব উপেক্ষণীয় নয়। এই তত্ত্বে অধিকারের নৈতিক দিকের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে আদর্শবাদীরা সমাজকে নৈতিক অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।

অধিকারের মার্কসীয় তত্ত্বের স্বতন্ত্র তাৎপর্য রয়েছে। সমাজব্যবস্থার বদলের সঙ্গে অধিকারের রূপ ও প্রকৃতিরও বদল ঘটে এই সত্যতা মার্কসীয় তত্ত্বে তুলে ধরা হয়েছে এবং দাস সমাজব্যবস্থা থেকে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অধিকারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এটা দেখানো হয়েছে। তাছাড়া শ্রেণিবৈষম্যমূলক সমাজে অধিকার যে কখনোই সর্বজনীন হতে পারে না তাও মার্কসীয় তত্ত্বে প্রমাণিত হয়েছে।

৪। ভারতের সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করো। ইতিবাচক ও নেতিবাচক মৌলিক অধিকার কাকে বলে?

মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন এবং ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ কখনোই অধিকার ছাড়া সম্ভব নয়। তবে এই অধিকারের অনেকগুলিই আপেক্ষিক এবং কালভেদে পরিবর্তনশীল। কিন্তু এমন কতকগুলি অধিকার আছে যাদের মূল্য চিরন্তন। মানুষের সামাজিক অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য যেগুলি একান্তভাবেই প্রাথমিক এবং অপরিহার্য, সেই অধিকারগুলিই মানুষের মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights) রূপে পরিচিত। সংবিধান-বিশেষজ্ঞ দূর্গাদাস বসুর মতানুসারে বলা যায়, মৌলিক অধিকার হল সেইসকল অধিকার যা দেশের লিখিত সংবিধান দ্বারা সংরক্ষিত ও সুনিশ্চিত, ভারতের সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলি সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে ১২-৩৫ নং ধারায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।

ইতিবাচক ও নেতিবাচক মৌলিক অধিকার

ভারতের সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল-ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়প্রকার অধিকারের সংযোজন। নিম্নে মৌলিক অধিকারের এই রূপগুলিকে বিশ্লেষণ করা হল-

  • ইতিবাচক মৌলিক অধিকার: যেসকল মৌলিক অধিকারের মাধ্যমে নাগরিকগণ প্রত্যক্ষভাবে ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের জন্য কতকগুলি সুযোগসুবিধা ভোগ করে, তাকে ইতিবাচক মৌলিক অধিকার বলে। এইরূপ মৌলিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ১৯ নং ধারায় বর্ণিত ব্যক্তির মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং তার জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার, ২৫ নং ধারায় বর্ণিত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার থেকে ও ২৯-৩০ নং ধারায় বর্ণিত শিক্ষা ও সংস্কৃতি পালনের অধিকার থেকে কোনোভাবেই কাউকে যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিরেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
  • নেতিবাচক মৌলিক অধিকার: যেসকল অধিকারের প্রতি রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞামূলক ব্যবস্থা আরোপ করেছে তাকে নেতিবাচক মৌলিক অধিকার বলে। যেমন-ভারতে সাম্যের অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র কোনো নাগরিককে বা ব্যক্তিকে সমভাবে বিবেচিত হওয়ার বা আইনের দ্বারা সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না।

৫। ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো।

ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ

ভারতে নাগরিকদের জন্য লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

[1] বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও তত্ত্বের প্রভাব: ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতাগণ মৌলিক অধিকার সংযোজনের সময় ইংল্যান্ডের ডাইসির আইনের অনুশাসন তত্ত্ব, ফরাসি সংবিধানে লিপিবদ্ধ সাম্য, মৈত্রী এবং স্বাধীনতার আদর্শ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অধিকারের সনদ বা বিল অব রাইট্স, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য ও নীতি এবং জাতির জনক মহাত্মা গান্ধির রাজনৈতিক চিন্তা দর্শন প্রভৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

[2] সকল মৌলিক অধিকার সমভাবে কার্যকরী নয়: ভারতীয় সংবিধানে কতকগুলি মৌলিক অধিকার আছে যেগুলি সরাসরি কার্যকর হয়, যেমন- ১৪ নং ধারায় বর্ণিত আইনের চোখে সমানাধিকার। কিন্তু কতকগুলি মৌলিক অধিকার আছে যেগুলি সরাসরি কার্যকর হয় না, যেমন-১৭ নং ধারায় বর্ণিত অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের বিষয়টি বা ২৩ নং ধারায় বর্ণিত শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার প্রভৃতি। কারণ অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের প্রকল্পকে কার্যকর করতে হলে বিশেষ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

[3] ইতিবাচক ও নেতিবাচক অধিকারের সংযোজন: সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকারগুলিকে কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং লেখক ইতিবাচক ও নেতিবাচক এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। তাঁদের মতে, যেসকল অধিকার নাগরিকগণ প্রত্যক্ষভাবে ভোগ করে তাকে ইতিবাচক অধিকার বলে, যেমন- জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার, মতামত প্রকাশের অধিকার প্রভৃতি। অন্যদিকে, যেসকল অধিকারের উপর রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তাদের নেতিবাচক অধিকার বলে। যেমন-আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার প্রভৃতি।

[4] মৌলিক ভাধিকারগুলি অবাধ ও নিরঙ্কুশ নয়: ভারতের সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারগুলি অবাধ ও নিরঙ্কুশ নয়। যেমন-ভারতের জাতীয় সংহতি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সামাজিক শৃঙ্খলা, বিদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক প্রভৃতির জন্য ভারত সরকার মৌলিক অধিকার ভোগের উপর কিছু যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। আবার শান্তি- শৃঙ্খলা ভঙ্গের আশঙ্কা, আদালত অবমাননা প্রভৃতির স্বার্থে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ বা খর্ব করতে পারে।

[5] নমনীয়: মৌলিক অধিকারের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এটি নমনীয় প্রকৃতির। সংবিধান অনুসারে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার সংশোধন করতে পারে।

[6] বিচার বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষণ: সংবিধান অনুযায়ী মৌলিক অধিকারগুলি আদালত কর্তৃক সংরক্ষিত। স্বাভাবিক অবস্থায় সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের ৩২ নং ধারা অনুসারে এবং হাইকোর্ট ২২৬ নং ধারা অনুসারে লেখ জারি করে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার ব্যবস্থা নিতে পারে।

ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত এবং লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনার শেষে বলা যায় যে, মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে মার্কিন বিচার বিভাগের তুলনায় ভারতীয় বিচার বিভাগের ক্ষমতা অনেকটা কম। তাছাড়া ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের জন্য লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারগুলির বাস্তবায়নেরও কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।

৬। মৌলিক অধিকারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।

মৌলিক অধিকারের প্রকৃতি

প্রয়োগিক বাস্তবতা ও মূলগত বৈশিষ্ট্যের নিরিখে ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত ও সংরক্ষিত মৌলিক অধিকারসমূহের প্রকৃতি অনুধাবন করা যায়। মৌলিক অধিকারের প্রকৃতির বিষয়টিকে নিম্নরূপে ব্যক্ত করা হল-

[1] আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের ঊর্ধ্বে ত্থাপিত : সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়েছে। তার ফলে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের কোনো কার্যকলাপের দ্বারা মৌলিক অধিকারগুলিকে ক্ষুণ্ণ করা যায় না।

[2] মৌলিক অধিকারগুলি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য : ভারতের সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়ের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন- সাম্যের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রভৃতি কোনোভাবে লঙ্ঘন করা হলে ব্যক্তির মতো গোষ্ঠীও বিচারালয়ে আবেদন করতে পারে।

[3] জরুরি অবস্থায় অধিকারগুলি ক্ষুন্ন হতে পারে: এ কে আয়ারের মতে জাতীয় নিরাপত্তার বনিয়াদের উপর ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি প্রতিষ্ঠিত। তাই দেশ ও জাতি যখন সংকটের সম্মুখীন হয়, তখন নিরাপত্তার স্বার্থে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ বা স্থগিত করার ব্যবস্থাও সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সংবিধানের ৩৫৮ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, জরুরি অবস্থা ঘোষিত হওয়ার পর পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করে অথবা শাসন বিভাগ কোনো আদেশ জারি করে ১৯নং ধারায় বর্ণিত মৌলিক অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

[4] প্রকৃতিগতভাবে মৌলিক অধিকারগুলি সামাজিক ও রাজনৈতিক : ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের প্রকৃতি মূলত সামাজিক এবং রাজনৈতিক। নাগরিকদের যাতে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সে যাতে উপযুক্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সেজন্য তাদের কিছু মৌলিক অধিকারের প্রয়োজন হয়। তবে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে নাগরিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে (৩২ নং ধারা)।

[5] সকলের জন্য মৌলিক অধিকার প্রযোজ্য নয়: মৌলিক অধিকারের মধ্যে কিছু অধিকার আছে যা একমাত্র ভারতীয় নাগরিকগণই ভোগ করতে পারেন। যেমন-সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সকলের সমানাধিকার, বাক্ ও মত প্রকাশের অধিকার প্রভৃতি। আবার এমন কতকগুলি অধিকার আছে যেগুলি নাগরিক, অনাগরিক সকলেই সমানভাবে ভোগ করতে সমর্থ, যেমন- আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, ধর্মের অধিকার, শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার প্রভৃতি।

[6] অনিয়ন্ত্রিত নয়: ভারতীয় নাগরিকগণের মৌলিক অধিকারগুলি অনিয়ন্ত্রিত নয়। সংবিধানে বর্ণিত প্রত্যেকটি মৌলিক অধিকারের উপর কোনো-না-কোনো শর্ত আরোপ করা হয়েছে, যেমন-সামাজিক শৃঙ্খলা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য মৌলিক অধিকারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রভৃতি। তবে এগুলি যুক্তিসংগত কি না তা বিচারের দায়িত্ব আদালতের উপরই ন্যস্ত করা হয়েছে।

[7] সরকার ও আইনসভার বিরুদ্ধে প্রযোজ্য: বি আর আম্বেদকরের মতে, মৌলিক অধিকারগুলি আইন প্রণয়নে ক্ষমতাসম্পন্ন অথবা ক্ষমতাধিকারী যে-কোনো কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য।

৭। ভারতীয় সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের প্রকৃতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলি আলোচনা করো।

মৌলিক অধিকারের ইতিবাচক দিক

মৌলিক অধিকারের প্রকৃতিকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মৌলিক অধিকারের মধ্যে কিছু গুণ বা ইতিবাচক দিক এবং কিছু দোষ বা নেতিবাচক দিক আছে। মৌলিক অধিকারের ইতিবাচক দিক বা গুণগুলি হল-

[1] নিবর্তনমূলক আটক আইনের গুরুত্ব: অনেক সমালোচক নিবর্তনমূলক আটক আইনের সমালোচনা করলেও বিভিন্ন সময়ে অস্থির অবস্থার মোকাবিলা এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরনের ক্ষমতার যে প্রয়োজন আছে, তা অস্বীকার করা যায় না।

[2] জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিধিবিধানের গুরুত্ব অপরিসীম : মৌলিক অধিকারগুলি জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে সমালোচিত হলেও সেটি পুরোপুরি ঠিক নয়, কারণ দেশে সুশাসন চালু রাখার স্বার্থে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিধিবিধানের গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা মানেই মৌলিক অধিকারের সংকোচন এই ধারণা ঠিক নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে তখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। সেই সময় নাগরিক অধিকার সংকুচিত হয়নি।

[3] আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য: আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য অধিকারগুলিকে ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নাম দিয়ে সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাই মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে নাগরিকগণ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্রতিকারের দাবি জানাতে পারে।

মৌলিক অধিকারের নেতিবাচক দিক

মৌলিক অধিকারের প্রকৃতির নেতিবাচক দিক বা সীমাবদ্ধতাগুলি হল-

[1] জাতীয় স্বার্থ: ভারতের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা ও বাধানিষেধ এত বেশি পরিমাণে সংযোজিত আছে যে মৌলিক অধিকারভোগের সুষ্ঠু পরিবেশ ভারতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

[2] ক্রমাগত সংসদীয় হস্তক্ষেপ: সংবিধান অনুসারে ভারতীয় সংসদ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মৌলিক অধিকারগুলিকে পরিবর্তন করতে পারে। অথচ বারংবার সংসদের হস্তক্ষেপের ফলে মৌলিক অধিকারগুলির অলঙ্ঘনীয় চরিত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

[3] অর্থনৈতিক অধিকারের অনুপস্থিতি: সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলি চারিত্রিকভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রকৃতির হয়। মৌলিক অধিকারের মধ্যে কর্মের অধিকার কিংবা শ্রমের মান অনুযায়ী পারিশ্রমিক লাভের অধিকার স্বীকৃত হয়নি অর্থাৎ অর্থনৈতিক অধিকারের অনুপস্থিতি মৌলিক অধিকারের ব্যাপকতার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে।

মূল্যায়ন: উপরোক্ত পর্যালোচনার শেষে বলা যায় যে, আইনের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মৌলিক অধিকারের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি হল ভারতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মেরুদণ্ড, তাই মানুষের মানবিক মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় মৌলিক অধিকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে প্রকৃতিগত বিচারে মৌলিক অধিকার ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষার ক্ষেত্রে, – সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের স্বার্থরক্ষার জন্য এবং সকল ভারতীয়দের নিরাপত্তা বিধানে সদর্থক ভূমিকা পালন করে।

৮। ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলিকে লিপিবদ্ধ করার কারণগুলি কী কী? জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে ভারতীয় নাগরিকরা কি মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারে?

ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলিকে লিপিবদ্ধ করার কারণ

[1] সংবিধান প্রণেতাদের ইচ্ছা: ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলিকে লিপিবদ্ধ করার পিছনে সংবিধান প্রণেতাগণের মনে মূলত দুটি প্রভাব কাজ করেছিল, বাইরের রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাংবিধানিক দৃষ্টান্ত এবং সংবিধান রচিত হওয়ার সময়কার ভারতের সামাজিক পরিস্থিতি।

[2] সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ: সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলি লিখিত থাকলে সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব হয়। কারণ শাসন বিভাগ বা আইন বিভাগ এদের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে তা প্রতিরোধ করার জন্য বিচার বিভাগ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

[3] গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ: যে-কোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতেই নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমেই নাগরিকদের মধ্যে অধিকারবোধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঞ্চার ঘটে। ভারতেও তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানের জন্য মৌলিক অধিকারগুলিকে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

[4] জনগণের চেতনার বিকাশ: মৌলিক অধিকারগুলি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে নাগরিকগণ যেমন তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে, তেমনই সরকারও নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে পারে। আবার সরকারের কোনো কাজ সংবিধানে বর্ণিত নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী হলে তার প্রতিকারের জন্য কি করণীয় সে সম্পর্কেও নাগরিকগণ সচেতন হয়ে তা প্রতিরোধ করতে পারে।

[5] মৌলিক আইনের পর্যায়ে উন্নীতকরণ : সংবিধান যেহেতু দেশের মৌলিক আইন, তাই নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ এগুলিকে মৌলিক আইনের পর্যায়ে উন্নীত করা। তার ফলে আইনসভা এগুলিকে অগ্রাহ্য করে আইন প্রণয়ন করতে পারে না। ভারতীয় সংবিধানের ১৩ নং ধারায় এবং ২ নং উপধারায় একথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

[6] গণতান্ত্রিক বিকাশ ও সাফল্যের চাবিকাঠি: গণতন্ত্রের বিকাশ এবং সাফল্যের জন্যই মৌলিক অধিকারগুলিকে সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ রাখা হয়। তাই উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক চিন্তার সঙ্গে চেতনার বিকাশের সামঞ্জস্য রক্ষা করার স্বার্থে মৌলিক অধিকারগুলি লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন আছে।

[7] আদালতের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ: মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে নাগরিকগণ তার প্রতিকার ও প্রতিবিধানের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। তাছাড়া মৌলিক অধিকারগুলিকে আদালতের মাধ্যমে সংরক্ষণ এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়।

জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকার

জরুরি অবস্থায় ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। যেমন-সংবিধানের ৩৫৮ নং ধারানুসারে, জরুরি অবস্থায় সংবিধানের ১৯ নং ধারায় বর্ণিত স্বাধীনতার অধিকারগুলি লঙ্ঘন করে আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করে এবং শাসন বিভাগ সেই আইনের প্রয়োগ করতে পারে। এর ফলে জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকারগুলি অবলবৎযোগ্য হয়ে যায়। তবে, ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৪৪ তম সংবিধান-সংশোধনী অনুযায়ী জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলেও ২১ নং ধারায় বর্ণিত ও লিপিবদ্ধ ব্যক্তিগত জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা যাবে না। রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতাকে অনেকে সমালোচনা করে বলেন যে, ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের উপর অপ্রয়োজনীয় এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার মূলে আঘাত করে। এই প্রচেষ্টা রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে শাসকের রাজনৈতিক স্বার্থ বা দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়।

৯। ভারতীয় সংবিধানে কী কী মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে? অথবা, মৌলিক অধিকার হিসেবে ভারতীয়গণ কী কী অধিকার ভোগ করে আলোচনা করো।

ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ

ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায় ১২-৩৫ নং ধারায় মৌলিক অধিকারগুলি বিবৃত রয়েছে। বর্তমানে ছয় প্রকার মৌলিক অধিকারের উল্লেখ রয়েছে।

[1] সাম্যের অধিকার: ভারতীয় সংবিধানের ১৪-১৮নং ধারায় সাম্যের অধিকারসমূহের বর্ণনা রয়েছে। এগুলি হল- আইনের দৃষ্টিতে সমতা, আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকার, সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সকলের সমানাধিকার, অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধকরণ, উপাধি বা পদবি গ্রহণ নিষিদ্ধকরণ।

[2] স্বাধীনতার অধিকার: ভারতীয় সংবিধানের ১৯-২২নং ধারায় স্বাধীনতার অধিকারের উল্লেখ রয়েছে। আধুনিক যুগে স্বাধীনতার অধিকার গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত। সংবিধানের ১৯(১) নং ধারায় ছয় প্রকার স্বাধীনতার অধিকারের উল্লেখ রয়েছে। এগুলি হল- বাকস্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের অধিকার, শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্রভাবে সমবেত হওয়ার অধিকার, সংঘ বা সমিতি গঠনের অধিকার, ভারতের সর্বত্র চলাফেরা করার অধিকার, ভারতের অঞ্চলে স্বাধীনভাবে বসবাস করার অধিকার, যে-কোনো যে-কোনো বৃত্তি, পেশা গ্রহণের বা ব্যাবসাবাণিজ্য করার অধিকার। 

এ ছাড়াও অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত ও শাস্তিদানের ব্যবস্থাবলি, জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার, গ্রেপ্তার ও আটকের বিরুদ্ধে অধিকার।

[3] শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার: ভারতীয় সংবিধানে শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার একটি তাৎপর্যপূর্ণ মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ২৩ ও ২৪ নং ধারায় উক্ত অধিকারটি স্থান পেয়েছে। এই অধিকার গুলি হল- বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বেগার খাটানো, মানুষ ক্রয়-বিক্রয় করা, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের খনি, কারখানা বা অন্য কোনো বিপজ্জনক কাজে নিয়োগ প্রভৃতিকে আইনগত অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে।

[4] ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার: মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে অন্যতম হল ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার (২৫-২৮ নং ধারা)। এখানে স্বীকৃত অধিকারগুলি হল- বিবেকের স্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ, ① ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সংস্থা স্থাপন, ধর্মীয় সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগুলির অধিকার, জোর করে ধর্মের নামে কর আদায় নিষিদ্ধকরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষাদানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।

[5] সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত অধিকার: সংবিধানের ২৯ নং ধারানুযায়ী, ভারতের যে-কোনো নাগরিকের নিজ নিজ ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করার অধিকার আছে। সংবিধানের ৩০ নং ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের পছন্দমতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে।

[6] সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধালের অধিকার: ভারতীয় সংবিধানের ৩২ এবং ২২৬ নং ধারায় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে সুনিশ্চিত বা বলবৎ করার জন্য শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার ঘোষিত এবং লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্ট লেখ জারি করতে পারে।

১০। ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকারটি আলোচনা করো।

ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকার

ভারতীয় নাগরিকদের সংবিধান প্রদত্ত ছয় প্রকার মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে প্রথম অধিকারটি হল-সাম্যের অধিকার (Right to Equality)।*। সংবিধানের ১৪-১৮ নং ধারা অবধি পাঁচটি ধারার মধ্যে এই অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এই ধারার অন্তর্ভুক্ত অধিকারগুলি চার্ট আকারে নিম্নে দেখানো হল-

[1] আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠা (১৪নং ধারা) :

(i)আইনের চোখে সমানাধিকার: এই ধারণাটি প্রখ্যাত ব্রিটিশ সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডাইসির আইনের অনুশাসন তত্ত্ব (Rule of Law) অনুসরণে রচিত হয়েছে। এর অর্থ আইনের চোখে সবাই সমান, সকলেই নিজের সকল কাজের জন্য আইনের কাছে সমানভাবে দায়িত্বশীল। প্রধানমন্ত্রী বা সাধারণ মানুষ কেউই রাষ্ট্রের কাছে বিশেষ সুযোগ দাবি করতে পারে না।

ব্যতিক্রম: আইনের দৃষ্টিতে সাম্য নীতির কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়, যথা- রাষ্ট্রপতি এবং সকল রাজ্যের রাজ্যপালগণকে তাঁদের কাজের জন্য আদালতের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না (৩৬১ নং ধারা), ⑪ নিজ পক্ষে থাকাকালীন তাঁদের (রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যপাল) বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যায় না এবং সাংসদ বা রাজ্য বিধানসভার সদস্যরা বিশেষাধিকার ভোগ করে থাকেন।

(ⅱ) আইনের চোখে সমান সংরক্ষণের অধিকার: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধন থেকে নেওয়া এই অধিকারবলে সমপর্যায়ভুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য আইন একই হবে এবং একইভাবে প্রযুক্ত হবে। রাষ্ট্র কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না।

[2] রাষ্ট্র কর্তৃক বৈষম্যমূলক আচরণের অনুপস্থিতি (১৫নং ধারা) : রাষ্ট্র ধর্ম, বর্ণ, জাতি, স্ত্রী-পুরুষ, জন্মস্থান প্রভৃতি কোনো অজুহাতে নাগরিকদের মধ্যে কোনো প্রভেদ করবে না। কোনো নাগরিককে দোকান, পাবলিক রেস্তোরাঁ, হোটেল, প্রমোদ স্থান, সরকারি অর্থে নির্মিত বা রক্ষিত কোনো কূপ বা স্নানের ঘাট এবং রাস্তা ব্যবহার করার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না [১৫(২)]।

ব্যতিক্রম: বৈষম্যমূলক আচরণেরও কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়, যথা- মহিলা ও শিশুদের জন্য রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে [১৫(৩) নং ধারা), ⑪ শিক্ষায় অনগ্রসর শ্রেণির জন্য এবং সামাজিক দিক থেকে অনুন্নত শ্রেণির (তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি) জন্যও রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে [১৫(৪) নং ধারা) ও জনস্বার্থে রাষ্ট্র সর্বসাধারণের ব্যবহৃত স্থানে ছোঁয়াচে রোগীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে পারে। [৯৩ তম সংবিধান সংশোধন ২০০৫ খ্রি.]।

[3] সরকারি চাকুরির অধিকার (১৬নং ধারা): জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ, জন্মস্থান, বাসস্থান প্রভৃতির নিরিখে কোনো নাগরিকের প্রতি সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না [১৬ (২)]। এমনকি নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং পেনশন প্রভৃতি ক্ষেত্রেও কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না।

ব্যতিক্রম: সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে রাষ্ট্র স্থায়ী বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দিতে পারে [১৬ (৩) নং ধারা], সরকার প্রয়োজন মনে করলে অনগ্রসর নাগরিকদের জন্য কিছু সরকারি চাকুরি বা পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে (১৬(৪) নং ধারা) ইত্যাদি।

[4] অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে অধিকার (১৭নং ধারা): অস্পৃশ্যতার অজুহাতে কোনো ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির অক্ষমতা বা অযোগ্যতা নির্ধারণ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই সংক্রান্ত অপরাধ ও শাস্তি নির্ধারণের জন্য পার্লামেন্ট ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পাস করে ‘The Untouchability Offences Act, 1955’ যার সংশোধিত রূপের বর্তমান নাম হল পৌর অধিকার রক্ষা আইন (‘Protection of Civil Rights Act’) |

[5] খেতাব বা উপাধির বিলুপ্তি (১৮ নং ধারা): ১৮ (১) নং ধারায় বলা হয়েছে, সামরিক এবং শিক্ষাগত খেতাব ছাড়া রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য কোনো খেতাব প্রদান করতে পারবে না। বৈদেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত কোনো খেতাবও কোনো ভারতীয় নাগরিক গ্রহণ করতে পারবে না [১৮ (২)]। ভারতবর্ষের নাগরিক নয় অথচ ভারত সরকারের অধীনস্থ কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত এমন কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির অনুমতি ব্যতীত বৈদেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত কোনো উপাধি গ্রহণ কিংবা কোনো বেতন, ভাতা বা কোনো পদ গ্রহণ করতে পারবে না [১৮(৪)]।

ব্যতিক্রম: উপাধি বিতরণ সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ হলেও ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারত সরকার চিকিৎসা, বিজ্ঞান, ক্রীড়া প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ ইত্যাদি উপাধি প্রদান শুরু করে।

মূল্যায়ন: সমালোচকদের মতে, সংবিধানের ১৪-১৮ নং ধারার মধ্যে স্বীকৃত সাম্যের অধিকারের প্রকৃতি মূলত আইনগত ও রাজনৈতিক এবং আংশিকভাবে সামাজিক। সংবিধানে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনো ঘোষণা পরিলক্ষিত হয়নি। অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া যেহেতু রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা অর্থহীন সেহেতু আদর্শ গণতন্ত্রের ব্যাপারটিও এক্ষেত্রে অলীক। কিন্তু এইসব সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে সাম্যের অধিকারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

১১। আইনের চোখে সমতা বলতে কী বোঝো? ভারতের সংবিধানে ‘আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার বলতে কী বোঝো?

ভারতীয় সংবিধানে ১৪-১৮ নং ধারায় সাম্যের অধিকার ঘোষিত ও স্বীকৃত হয়েছে। সাম্যের অধিকার সম্পর্কে সংবিধানের ১৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, ভারতের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে আইনের দৃষ্টিতে সমতার অধিকার বা আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার হতে বঞ্চিত করতে পারবে না।

আইনের দৃষ্টিতে সমতা

‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’র অর্থ হল সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান। এই ধারণা অধ্যাপক এ ভি ডাইসি-র ‘আইনের অনুশাসন’ তত্ত্বের দ্বিতীয় নীতির অনুসরণে গৃহীত হয়েছে। ডাইসির বক্তব্য অনুযায়ী, আইনের দৃষ্টিতে সমতার অর্থ হল ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও অবস্থা নির্বিশেষে কোনো ব্যক্তিই দেশের আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত দেশের প্রত্যেক ব্যক্তি সাধারণ আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সাধারণ আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে আইভর জেনিংস বলেছেন যে, আইনের দৃষ্টিতে সমতা বলতে বোঝায়, “সমকক্ষদের মধ্যে আইন সমান ও সমভাবে প্রযোজ্য হবে” এবং ‘একই ধরনের কাজের জন্য’ (‘for the same kind of action’) সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক জাতি, সম্পদ, সামাজিক মর্যাদা কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি নির্বিশেষে আদালতে অভিযোগ করতে বা অভিযুক্ত হতে পারবে।

আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার

‘আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার’ দ্বারা এটা বোঝায় যে, সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আইন সমভাবে প্রযুক্ত হবে। মার্কিন সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধন থেকে এটি গৃহীত হয়েছে।** এই অধিকারের অর্থ হল লোকের অবস্থা বা প্রকৃতির বিভিন্নতা বিচার করে প্রতিটি আইনকে সকল ব্যক্তির ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

১২। আইনের দৃষ্টিতে সমতানীতির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম উল্লেখ করো।

আইনের দৃষ্টিতে সমতানীতির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম

আইনের দৃষ্টিতে সমতার অর্থ হল সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ নাগরিক দেশের প্রত্যেক ব্যক্তিই সাধারণ আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন কিন্তু এই নীতির কতগুলি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম বিদ্যমান, এগুলি হল-

[1] সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় পুলিশ কর্মচারীরা ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।

[2] রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালগণ পদাধিকারবলে যেসকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন এবং যেসকল কার্য ও কর্তব্য সম্পাদন করেন সেজন্য তাঁরা কোনো আদালতের কাছে কৈফিয়ত প্রদানে বাধ্য নন।

[3] সংবিধানের ৩৬১ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দাখিল করা যায় না তবে তাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা দায়ের করতে হলে বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয় এবং মামলা দায়ের করার জন্য ২ মাসের নোটিশ দিতে হয়।

[4] রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালগণ তাঁদের নিজের পদে বহাল থাকাকালীন অবস্থায় তাঁদের গ্রেপ্তার বা কারাবাসের জন্য কোনো আদালত নির্দেশ দিতে পারে না।

[5] প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়।

উল্লিখিত সাংবিধানিক ব্যতিক্রম ছাড়াও আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে আইনের দৃষ্টিতে সাম্য নীতির ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। সেগুলি হল-

[i] বিদেশি রাষ্ট্রের শাসকদের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করা যায় না। কারণ তাঁরা কোনোভাবেই ভারতীয় আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত নন।

[i] যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের ব্যক্তিবর্গরা ভারতীয় আদালতে যেমন মামলা দাখিল করতে পারে না ঠিক তেমনই অন্যান্য বন্দিদের ন্যায় সুযোগসুবিধাও দাবি করতে পারে না।

[iii] সংসদ এবং রাজ্য আইনসভার সদস্যরা বেশ কিছু বিশেষ অধিকার ভোগ করে।

[iv] ৪৪ তম সংবিধান-সংশোধনী অনুযায়ী পার্লামেন্ট প্রশাসনিক আদালত গঠন করে স্থানীয় সংস্থা বা সরকারি সংস্থার কর্মীদের চাকুরি সংক্রান্ত যাবতীয় বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যও পার্লামেন্টের ট্রাইব্যুনাল গঠন করার অধিকার রয়েছে। এ ছাড়া শিল্প, ভূমিসংস্কার, খাদ্য সংগ্রহ ও বণ্টন ইত্যাদি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যও পার্লামেন্টের ট্রাইব্যুনাল গঠন করার অধিকার রয়েছে।

আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment