মেকলের মিনিটের ফলেই ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক শিক্ষাধারার প্রবর্তন ও বিকাশ ঘটে’- উক্তিটির গ্রহণযোগ্যতা- আলোচনা করো

অনেকে মনে করেন, ‘মেকলের মিনিটের ফলেই ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক শিক্ষাধারার প্রবর্তন ও বিকাশ ঘটে।’- এই উক্তিটি কতটা গ্রহণযোগ্য, তা মেকলের মিনিটকে বিচার বিশ্লেষণ করলে বলা যায়। ইংরেজি শিক্ষা সম্পর্কে বিখ্যাত মন্তব্যের জন্য তিনি সমভাবে নিন্দিত ও প্রশংসিত হয়েছেন। তাঁর মন্তব্য বিচার করলে বলা যায়, তিনি ভারতে-
(1) সম্পূর্ণভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন।
(2) তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ অনুসরণ করে উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
(3) ভারতীয়দের ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান আহরণ করতে চেয়েছিলেন।
মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার আমদানিতে সহায়তা করেছিলেন এবং শিক্ষা সংক্রান্ত পরবর্তী সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করেছিলেন। ফলে অনেকে তাঁকে নতুন যুগের আলোকবর্তিকাবাহী বলে প্রশংসা করেছেন আবার অপরদিকে ভারতীয় ভাষাসমূহের উন্নতির সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছেন বলে তাঁকে নিন্দাও করেছেন। ভারতীয় ধর্ম, ভাষা, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি সম্পর্কে মেকলে বহু অবজ্ঞাসূচক উক্তি করেছেন। ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, বিজ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের অভাবের দরুন বহু ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি করেছেন। এজন্য তিনি ভারতীয়দের নিকট চিরদিন নিন্দনীয় হয়ে থাকবেন।
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, অতিনিন্দা বা অতি- প্রশংসা কোনোটিই তাঁর প্রাপ্য নয়। অনেকে মনে করেন, মেকলের মিনিটের ফলেই ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক শিক্ষাধারার প্রবর্তন ও বিকাশ ঘটে। এই দাবি পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই মেকলে এদেশে আসার অনেক আগে থেকেই এ দেশের জনসাধারণ ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছিল। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য হল-বেসরকারিভাবে মিশনারিদের প্রচেষ্টায় ভারতে ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞান সম্পর্কে – ভারতীয়রা পূর্বেই সচেতন হয়েছিলেন। সুতরাং ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা – প্রবর্তনের সবটুকু কৃতিত্ব মিশনারিদেরই দিতে হবে।
রাজা রামমোহন রায় বহু পূর্বেই ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের দাবি জানিয়েছিলেন। সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে 1823 খ্রিস্টাব্দে লর্ড আর্মহার্স্টকে লেখা রামমোহনের চিঠির মধ্য দিয়েই আধুনিক শিক্ষার প্রতি এদেশের শিক্ষিত শ্রেণির মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিল। মেকলে এদেশে আসার পূর্বেই প্রাচ্য- পাশ্চাত্য বিরোধ তৈরি হয়েছিল। লর্ড বেন্টিঙ্ক এদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন। বোর্ডের কাছে চিঠিতে সেই ব্যাপারে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন এবং বোর্ডও তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিল। এসব বিবেচনা করে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য কি মেকলে-কে দায়ী করা যায়?
এরপর শেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার ছিল বড়োলাটের উপর বড়োলাট – লর্ড বেন্টিঙ্ক যদি তাঁর পরামর্শ গ্রহণ না করতেন, তাহলে তাঁর মতামত সরকারি নীতিরূপে স্বীকৃত হত না। মেকলে তাঁর দৃঢ় সিদ্ধান্ত জানিয়ে বেন্টিঙ্ক-এর কাজে সহায়তা করেছিলেন মাত্র। তাঁর মন্তব্যের পর সরকার আধুনিক শিক্ষার নীতি নির্ধারণ করে। তবে মেকলে-র মিনিটের ফলেই আধুনিক শিক্ষার উদ্ভব ঘটেছে-এ কথা বলা যায় না। মেকলে যখন শিক্ষাসভার (GCPI) সভাপতি রূপে তাঁর মন্তব্য পেশ করেন, তখন এ দেশে মিশনারি ও ভারতীয়দের প্রচেষ্টায় আধুনিক শিক্ষার বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক শিক্ষার বিকাশে মেকলে মিনিটের গুরুত্ব অবশ্যই ছিল। কারণ, তাঁর মন্তব্যের ফলেই আধুনিক শিক্ষার বিস্তার ঘটানো সরকারের নীতি-এ কথা ঘোষণা করে এবং সরকারের সাহায্য ও সমর্থনে ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক শিক্ষার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছিল।
আরও পড়ুন – মধ্যযুগীয় ভারতের শিক্ষা প্রশ্ন উত্তর