মুসলিম যুগের শিক্ষার অসুবিধাগুলি কী কী ছিল
অথবা, ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটিগুলি আলোচনা করো

ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা
(1) ক্ষণস্থায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথা- মক্তব ও মাদ্রাসাগুলি স্থাপন করতেন সাধারণত বিখ্যাত ফকির বা দরবেশগণ। তাঁদের উপরই থাকত এই প্রতিষ্ঠানগুলির দেখাশোনার দায়িত্ব। মৌলবিরাও সাধারণত এই প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিষ্ঠাতাদের থেকেই বেতন পেতেন। এ ছাড়া সরকারি আনুকূল্যও প্রতিষ্ঠানগুলির ভাগ্যে সর্বদা জুটত না। এই অনিয়মিত পদ্ধতির ফলে অনেকসময়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। তাই এই স্বল্পমেয়াদি স্থায়িত্ব মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল।
(2) আধ্যাত্মিক শিক্ষা অবাছলিড: কোরান বা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠ স্বীকৃত হলেও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতি মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো জোর দেওয়া হয়নি। আধ্যাত্মিক শিক্ষার অবহেলা ছিল মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার একটি প্রধান সীমাবদ্ধতা।
(3) সর্বজনীন শিক্ষা অবহেলিত : মুসলিম শিক্ষা সর্বজনীন ছিল না। এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের প্রধান কারণ ছিল ধর্ম ও সাম্রাজ্য বিস্তার করা। ইসলামীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি মূলত মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাতেই গড়ে উঠেছিল। এর ফলে ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু বা অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ লেখাপড়ার সুযোগ পেত না। ফলে সর্বজনীন শিক্ষা অবহেলিত ছিল।
(4) মৌখিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের অসুবিধা: ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রধানত মৌখিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হত। তবে কেবলমাত্র মৌখিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদান শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক ও বাস্তবজীবনের উন্নতিসাধনের পক্ষে উপযোগী ছিল না। এটিও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি বা অসুবিধাজনক দিক।
(5) নারীশিক্ষা অবহেলিত: ইসলামীয় শিক্ষায় নারীশিক্ষা ছিল অবহেলিত। ছেলেদের জন্য শিক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক। মেয়েদের পণ্য হিসেবে ভাবা হত, তাদের যোগ্য সম্মান দেওয়া হত না। ফলে নারীদের শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে তেমন উৎসাহ ছিল না।
(6) লেখা ও পড়ার মধ্যে অসামঞ্জস্যতা: ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুদের বর্ণ শেখানোর পর লেখা শেখানো হত। এতে শিক্ষার্থীদের সঠিক বিকাশ ঘটত না এবং সময়ের অযথা অপচয় হত। যদিও পরবর্তীকালে আকবর এই রীতির পরিবর্তন করেন।
(7) দেশীয় ভাষার অবহেলা: ইসলামীয় শিক্ষায় মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হত না। দেশীয় ভাষাকে অবহেলা করে বিদেশি ফারসি ও আরবি ভাষার মাত্রাতিরিক্ত আধিপত্য মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থাকে ত্রুটিপূর্ণ করে তুলেছিল।
(8) ধর্মাকন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা: মুসলিম শাসকগণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, বিশেষত ধর্ম এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য। ফলে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে এই শিক্ষা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
(9) শাস্তিবিধান: মুসলিম শিক্ষায় ছাত্রদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হত, যা কখনোই কাম্য ছিল না। বহুক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা নির্দয়তার স্তর অতিক্রম করে যেত।
(10) শাসকদের প্রতি নির্ভরশীলতা: মুসলিম শিক্ষা দেশের শাসকদের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল ছিল। ফলে তাদের খেয়ালের প্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রে পড়ত।
(11) যুগোপযোগী নয়: ইসলামিক শিক্ষার পাঠক্রমে ধর্মীয় শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হত। ফলে পাঠক্রম যুগোপযোগী ছিল না।
(12) বস্তুগত দিকের উপর অতিরিদ্র্য গুরুত্ব: মুসলিম যুগের শিক্ষায় বস্তুগত দিকের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা হত।
(13) গণশিক্ষার অভাব : ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় গণশিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব ছিল না, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মক্তবের সংখ্যা যথেষ্ট থাকলেও হিন্দুদের জন্য পাঠশালার সংখ্যা ছিল খুবই কম।
(14) অনুপযুক্ত পাঠক্রম : এই যুগের শিক্ষায় পাঠক্রম উপযুক্ত ছিল না, বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী, পাঠক্রমের পরিবর্তন হত না।
(15) সার্বিক উন্নতিতে বাধা: ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশের প্রতি নজর দেওয়া হত না। তাই সর্বক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হত।
(16) মানাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব : মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থা মনোবিজ্ঞানসম্মত ছিল না। শিক্ষার পদ্ধতি, পাঠক্রম প্রভৃতি ক্ষেত্রে মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল।
(17) সময়ের অপচয়: মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি হল পঠন। ক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট মানে পৌঁছানোর পর লিখন শেখানো হত। এতে অনেক। সময়ের প্রয়োজন হত।
আরও পড়ুন – বিকাশের স্তরসমূহ প্রশ্ন উত্তর